somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের ফসলের ক্ষেতে ভারতীয় আগ্রাসন

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ-ভারতের কুড়িগ্রাম সীমান্তে এখন আর অন্ধকার নামে না, বরং নামে এক অদৃশ্য উদ্বেগ। সন্ত্রাসী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সার্চ লাইটের তীব্র আলো সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের নিস্তব্ধ গ্রামগুলোতে। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ধান গাছ যেন এই আলোয় চোখ মুছে তাকিয়ে থাকে।
সবজির পাতায় জমে ওঠে বিবর্ণতা, ভুট্টার শীষ কুঁকড়ে যায়। নারিকেল, কলা, আমের মুকুল ঝরে যায়। রাতের অন্ধকারে প্রাণ ফিরে পাওয়া পোকামাকড়গুলো দল বেঁধে নেমে আসে আলোর টানে, তাদের আক্রমণে নুয়ে পড়ে ফসলের গাছ।
মানুষও নিরাপদ নয়। সীমান্তের জরাজীর্ণ ঘরের চালা ভেদ করে ঢুকে পড়ে তীক্ষ্ণ আলো। শিশুর ঘুম ভেঙে যায়, বৃদ্ধের চোখ জ্বলে ওঠে, মাথাব্যথায় অস্থির হয় নারীরা। নিরাপত্তার নামে সীমান্তের এই আলো আজ তাদের জীবন-জীবিকার নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর-রৌমারী-উলিপুর-নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ীর ২৭৮.৭৮ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস কৃষি। কিন্তু সেই কৃষিজমি ও ফসল ভারতীয় আগ্রাসনে হুমকির মুখে পড়েছে।
২০০১ সালে বড়াইবাড়ী যুদ্ধে বিএসএফ-এর পরাজয়ের পর সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে শক্তিশালী কাঁটাতারের বেড়ার পাশাপাশি দু’শো মিটার পর পর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্চ লাইট স্থাপন করে ভারত। সন্ধ্যার পর এসব লাইট জ্বালানো হয়, বন্ধ করা হয় সকাল হলে।
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, লাইটের আলো সীমান্ত থেকে প্রায় চারশো মিটার বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে পড়ে। যতদূর পর্যন্ত আলো যায়, ততদূর অনেকটাই দিনের মতো দেখা যায়।
ভারতীয় এসব লাইটের আলোতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কৃষকদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ফসলি জমির উর্বরতা কমে যায়, মাটি শুষ্ক হয়। ধান গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়, শীষ ছোট হয়। অনেক সময় ধানের পাতা বেশি হয় কিন্তু ফলন কম হয়। পাটগাছ লম্বা কম হয়, গাছের বাকল শক্ত হয় না। ভুট্টার ফুল কম ধরে এবং ঝরে যায়, মোচা ছোট হয়।
আলু, শিম, লাউসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির গাছ কুঁকড়ে যায় এবং বেড়ে উঠতে সমস্যা হয়। ফুল কম ধরে এবং ঝরে যায়, তাই ফলনও কমে আসে। সবজি তেতো লাগে, যার কারণে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। রাতের অতিরিক্ত আলোতে আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করে। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, সাদা মাছি, বিছা পোকা ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসল ও নানা রকম সবজির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে।
ফুলবাড়ী বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী সাজু আহমদ বলেন, সীমান্ত এলাকায় পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হওয়ায় সেখানে আমাদের সার ও কীটনাশক বিক্রিও বেশি হয়।
সীমান্তবর্তী আম-লিচুর বাগানেও তীব্র আলোর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। আম ও লিচুর ফুল কম ধরে, ফুল ঝরে যায় এবং ফলন কম হয়। সুপারি, নারিকেল, কলা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলন কম হয় এবং পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
সীমান্ত এলাকায় পাকা ঘর নির্মাণে নিষেধ থাকায় কাঁচা ঘরে সার্চ লাইটের আলো প্রবেশ করে। এতে ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। মাথা ব্যথা, চোখে কম দেখাসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয় মানুষ।
ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ফকিরপাড়া সীমান্তে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভারতের সার্চ লাইটের আলোতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধানের পাতা হলুদ হয়, শীষ ছোট হয়। ভুট্টার ফুল কম হয় এবং মোচা ছোট হয়। এছাড়াও আলু, মুলা, শিম, লাউসহ বিভিন্ন সবজি গাছ ঝিম মেরে থাকে, ফলন ভালো হয় না।
ওরা ইসরায়েল পন্থী রাষ্ট্র, ওরা আমাদের ভালো চায় না। ওরা ইচ্ছা করলেই লাইটের পাওয়ার কম দিতে পারে কিংবা নিচের দিকে দিতে পারে, কিন্তু দেয় না।
আব্দুস সালামের সাথে কথা বলার সময় তারই ছোট ভাই আবুল কালাম আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দেন। তিনি বলেন, সীমান্তে আমরা ধান-সবজি আবাদ করি। বাতির বাইরে যে ধান আবাদ করি, তা বিঘায় ১৫ থেকে ১৬ মণ হয়; আর বাতি সংলগ্ন জমিতে ৮ মণই জুলুম। আরও সমস্যা আছে, ভাত খাওয়ার উপযোগী না। ভাত তেতো লাগে, খাওয়াই যায় না। এমনকি ওই ধানের খড়ও গরু খায় না।
নিজের ক্ষেতে ছেলেকে সাথে নিয়ে ধান কাটার সময় কথা হয় রৌমারী সীমান্তের বকবান্দা বেপারী পাড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের সাথে।
তিনি বলেন, সীমান্তে বিএসএফ-এর লাইটের কারণে ক্ষেতে পোকার আক্রমণ বেশি হয়। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, সাদা মাছি—এসব ফসল ও সবজির অনেক ক্ষতি করে। অন্যান্য জায়গায় দুইবার কীটনাশক দিলেই হয়, অথচ আমাদের দেওয়া লাগে ৪ থেকে ৫ বার। আবার সারও বেশি লাগে। তা ছাড়া নারিকেল, সুপারি, আম এসবেরও ফুল ঝরে যায়, ফলন কম হয়।
রাতে সীমান্তে টহলরত অবস্থায় কথা হয় কয়েকজন বিজিবি সদস্যের সঙ্গে। তারা বলেন, ভারতের লাইটের কারণে আমাদের চোখের সমস্যা হচ্ছে। সারারাত আমরা ডিউটি করি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লাইটের আলো এসে একদম চোখে পড়ে। পাকিস্তান সীমান্তে লাইট দিলেই ওরা গুলি করে ভেঙে ফেলে, কিন্তু আমরা তো পারি না।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, উদ্ভিদ একটা নির্দিষ্ট সময়ে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে; আবার রাতের অন্ধকারে শ্বসন প্রক্রিয়া চালায়। এই শ্বসন প্রক্রিয়া ও সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চক্রাকারে আবর্তিত হয়। কিন্তু আমাদের সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের যে শক্তিশালী আলো রয়েছে, এর ফলে ওখানে যে ফলদ ও ফসলি উদ্ভিদ আছে, তাদের সালোকসংশ্লেষণ চক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে সেখানে ফসলের অবশ্যই ফলন বা উৎপাদন কমবে। আলোর সাথে কীটপতঙ্গের একটা সম্পর্ক আছে, যার ফলে সেখানে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের জন্ম নেবে এবং ওই এলাকার পরিবেশ অবশ্যই বিপন্ন হবে।
সীমান্তে চোরাচালান ও নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে এসব সার্চ লাইট স্থাপন করা হয়েছে বলে বিএসএফের পক্ষ থেকে বলা হলেও, মূলত বাংলাদেশ সীমান্তের কৃষিকে ঝুঁকিতে ফেলতেই এমনটা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×