বেশ কিছু দিন হলো বিএনপি সহ বেশ কিছু দল এক সাথে মিলিত হয়ে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফন্টে যারা আছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আমাদের চেনা মুখ বা বিভিন্ন সময় নাম শুনেছি বা দেখেছি। এর মধ্যে একটি নাম মাহমুদুর রহমান মান্না। তাকে নিয়েই আজকের ব্লগ।
মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্য নামে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্টাতা, অনেক দিন ধরেই তার নাম শুনছি কিন্তু আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। গুগোল এর খোজ করে উইকিপিডিয়াতে যা পেলাম তা আরো জানার আক্ষেপ বৃদ্ধি করে দিলো। তাই ভাবলাম তার সম্পর্কে যাযা জানতে পেরেছি তার কিছু লিখি। তিনি এক সময় আওয়ামী লীগ এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।পরে সংস্কার পন্থি হওয়ার কারলে দল থেকে বহিস্কৃত হন।
আসুন তার সম্পর্কে জানি।
জন্ম ও বেড়েঊঠা মাহমুদুর রহমান মান্নার জন্ম বর্তমান বগুড়া শহরের চকলোকমানে, ১লা নভেম্বর ১৯৫১ সালে। পিতা আফসার উদ্দিন আহমদের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জের বিহার ফকিরপাড়া। ১১ ভাইবোনের মধ্যে বোন সবার বড় । তিনি বলেন, নিকটতম অগ্রজের জন্ম হয়েছিল ভারত বিভাগের সময়। যদিও তার কথা মত তার জন্ম সাল হওয়ার কথা ৫০-এর শুরুতে। ১১ ভাইবোনের মধ্যে মান্না ৫ম। ভাই-বোন সবাই সমাজ ও পারিবারিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত। সবাই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন।
শিক্ষা জীবন বগুরা শহরের সূত্রাপপুরের মালতিনগর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ও বগুড়া জেলা স্কুলে পড়েছেন মান্না। বগুড়ায় জন্ম নেওয়া মান্না ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন। মান্নার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় থেকেই মেজভাই-এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো ছাত্রসভায় যেতেন। সেই থেকেই তার রাজনীতির হাতে খরি। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন আরমানিটোলা স্কুল থেকে। ঢাকা কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯৬৮ সালে। এরপর ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে বিভাগে।
রাজনৈতিক জীবন মান্না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন অর্থনীতিতে বিভাগে ভর্তি হয়েই যোগ দেন রাজনীতিতে। ১৯৬৮ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আহবায়ক হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পরপর চ্যাম্পিয়ন হয়ে ছাত্রদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ভালো বক্তৃতা করতে ও লিখতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ছিলেন, নিজে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়েছিলেন এবং তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরে যোগদান করেন জাসদে। ১৯৭২-এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসভায়—চাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার অসাধারণ ছাত্রপ্রিয়তার কারণেই তিনি সমস্ত চাকসুতে ছাত্রইউনিয়ন জিতলেও তিনি জাসদপন্থী ছাত্রলীগের থেকে জি.এস. জিতেছিলেন।
চাকসুর জি.এস থাকা অবস্থায়ই তিনি জাসদপন্থী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। অল্পদিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯-’৮০ এবং ’৮০-’৮১-তে পরপর দুইবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
এরই মধ্যে জাসদ ভেঙে খালেকুজ্জামান ও আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে বাসদ গঠিত হলে মান্না থাকেন তাদের সঙ্গে। তিনি দ্বিতীয় বার বাসদ ছাত্রলীগ থেকে ১৯৮০ সালে ডকসু নির্বাচন করে ভিপি নির্বাচিত হন । দুবারই তার সঙ্গে জিএস ছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা আকতারুজ্জামান।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন তিনি। এরপর এক সময়ের জাসদ নেতা মীর্জা সুলতান রাজার নেতৃত্বে জনতা মুক্তি পার্টি গঠিত হলে ওই দলের নেতা হন মান্না। এই দলটি ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে সাথে একাত্ত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় আর মান্না হয়ে যান আওয়ামী লীগের নেতা। সেই থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগ এর নেতা হিসেবেই ছিলেন। নিজের এলাকা বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে একাধিকবার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও জিততে পারেননি মান্না। ২০০১ সালে সর্বশেষ আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রার্থী হয়ে ৪৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি। সেবার বিএনপির প্রার্থী রেজাউল বারী ডিনা ১ লাখ ১৬ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন। ভোটে হারলেও কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে আসেন মান্না। ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা জারির সময়ও দলের ওই পদেই ছিলেন তিনি।
তবে ওই সময়ে বাংলাদেশ সেনা নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় দলে সংস্কারের দাবী তুলে ফের আলোচনায় আসেন মান্না। তার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও তখন সংস্কারপন্থী বলে চিহ্নিত হন। পরে ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল, সুরঞ্জিত কাউকেই মন্ত্রিসভায় নেননি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলেও নীতি-নির্ধারণী পদ হারান তারা।
২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে বাদ পড়ে কার্যত আওয়ামী লীগে ছাড়া হয়ে পড়েন মান্না; আমু-তোফায়েলরা পরে মন্ত্রিসভায় ফিরলেও দলে ফেরা আর হয়নি মান্নাসহ কয়েকজনের।
এরপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন টক শোতে তাকে দেখাা যাওয়া শুরু হয় আর তখন থেকেই হয়ে পরেন আওয়ামী লিগ এর সমালোচক। টক শো এর নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেন মান্ন। কোন দল ছাড়া মান্নার টক শোই হয়ে উঠে তার রাজনীতি চর্চার স্থান।
আর এর মাধ্যমে হয়ে উঠেন নাগরিক প্রতিনিধি আর তা থেকেই ২০১২ সালে গড়ে তুলেন নাগরিক ঐক্য। যদিও প্রথমে এই দল নাগরিক সংঘটন হিসেবেই ছিলো পরে এটি রাজনৈতিক দল হয়ে ঊঠে।
বৈবাহিক জীবন ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরই বিয়ে করেন। তার বড় বোন অনেকটাই জোড় করে তার বিয়ের ব্যাবস্থা করেন। বিপ্লবি মান্না চাইতেন কখনো বিয়ে করবেন না। মাহমুদুর রহমান মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই ছাত্রীকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন। নানাভাবে মান্নাকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী। বাসায় অল্প-স্বল্প হলেও স্ত্রীকেও সহযোগিতা করেন মান্না। তবে রাজনীতির ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না মেহের নিগার। রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা ভালো না হলেও রাজনীতিবিদ মান্না সম্পর্কে মেহের নিগারের ধারণা অনেক ভালো। এই দম্পতির দুই সন্তান। ছেলে নিলয় মান্না ও নীলম মান্না। লেখাপড়া করছেন কানাডায়। পাশাপাশি সেখানে কাজ করছেন তারা।
তার রচিত গ্রন্থ সমূহ ছাত্র জীবন থেকেই মাহমুদুর রহমান মান্নার লেখা লিখির খুব হাত ছিলো। আর তা থেকে তার বই লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় । আর সেই থেকেই লিখেন
১। গণতন্ত্র ও নাগরিক আন্দোলন ২। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ৩। বিপ্রতীপ রাজনীতি।
৪। আটকে পড়া শব্দরাজি। ৫। কোথায় যাব।
পরিশেষেঃ ৬৭ বছর বয়সী মান্না এখন জাতীয় ঐক্য এর সাথে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। যদিও এর মাঝে বিভিন্ন সময় তিনি কারাবাস করেছেন, জিয়া ও এরশাদ এর সময় জাসদ এর গন বাহিনীর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাবাস করেছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় চোখে স্প্লিন্টারের আঘাত পান মান্না।
নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিআলাপের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশের পর ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গুলশান থানায় সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে মামলা করা হয়। পরদিন মান্নাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বৈধ সরকারকে অবৈধভাবে উচ্ছেদের চেষ্টার অংশ হিসাবে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানোর পরিকল্পনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যাচেষ্টার মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।
এরপর ২০১৬ সালের ৫ মার্চ একই থানায় দায়ের করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা। ওই মামলাতেও মান্নাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বেশ কিছু দিন কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পান।
(সবাইকে অসংখ্যা ধন্যবাদ। অনেক দিন পর ফিরে আসলাম প্রিয় সামুতে।)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৪৯