somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ্যাডভেঞ্চার কেওক্রাডং

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-চাচা সিগারেটটা দয়াকরে ফেলে দেবেন কি?
-ক্যান সিগারেট ফেলম্যু ক্যান?
-সিগারেটের ধোয়ায় সমস্যা হচ্ছেতো, যদি ফেলতেন তবে সুবিধা হত।
-ট্যাকা দিয়া কিনছি কি ফেইলা দিবার জন্য!
-চাচা, ট্রেনে সিগারেট খাওয়া তো নিষেধ, আপনি জানেন না? সিগারেটটা দয়াকরে ফেলে দেন।

একটানা ট্রেনের দুলুনিতে মাত্র চোখদুটো বন্ধ হয়ে এসেছিল কিন্তু পরক্ষনেই ঘুম চটে গেল দুই পক্ষের উত্তেজিত কথাবার্তায়। কথা কাটাকাটি হচ্ছিল নামনা জানা এক মধ্যবয়স্ক লোক আর জাহাঙ্গীরনগর এ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সদস্য হাবীবের মধ্যে। ইতিমধ্যে হাবীব ভাইয়ের সাথে আরো কয়েকজন ক্লাব সদস্য যোগ দিল এবং নাছোড়বান্দা চাচাও একাই তার সিগারেট রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকলেন। ক্লাব সদস্যদের উত্তেজনা টের পেয়ে বুঝলাম, ঘটনা আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। আমি উঠে গিয়ে চাচাকে বললাম “চাচা চলেন, ওদিকে যেয়ে একটু কথা বলি” চাচা আরো ক্ষেপে গেলেন আর বললেন, “ঐ দিক যাইতে হইব ক্যান? যা বলার এইখানেই বলেন” আমি চাচার কানে ফিসফিস করে কিছু বলতেই তিনি চুপসে গেলেন। জ্বলন্ত সিগারেটটাও ফেলে দিলেন জানালা দিয়ে। আমি নিজের আসনে ফিরে এসে আবার ঘুমানোর পায়তারা করতে থাকলাম।

জাহাঙ্গীরনগর এ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের আয়োজনে ‘এ্যাডভেঞ্চার কেওক্রাডং’ এ অংশ নিতে ঢাকা মেইল ট্রেনে চেপে আমাদের ১৫ জনের অভিযাত্রী দলটি যাচ্ছিল চট্রগ্রাম। পথে এধরনের আরো অনেক ঘটনা, সব বাদ দিয়ে মূল অভিযানের গল্প সংক্ষেপে বলি।

ক্লাব সভাপতি ফিরোজ ভাই, সহ-সভাপতি সবুজ ভাই দুজনেই শেষ মূহুর্তে তাদের এ্যাডভেঞ্চারে অংশগ্রহনে অপারগতা প্রকাশ করায় দলের নেতৃত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে, সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে পেলাম জিমি কে। মনে অনেক শঙ্কা নিয়ে ১৭ ই মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের ১৫ জন অভিযাত্রীর টিম ক্যাম্পাস ত্যাগ করে কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। রাত নয়টায় আমরা কমলাপুর রেলষ্টেশনে পৌঁছি আর রাত ১০ টার ঢাকা মেইল ট্রেন যখন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল, তখন রাত ১০:৩০। চট্টগ্রাম রেলষ্টেশনে পৌঁছলাম ১৮ মার্চ সকাল ৬:৩০ মিনিটে। এরপর বাসে করে বান্দরবান। চট্রগ্রাম- কক্সবাজার হাইওয়ে থেকে গাড়ী বান্দরবান রোডে প্রবেশ করতেই শুরু হল চড়াই-উৎড়াই এর খেলা। আমাদের অধিকাংশ অভিযাত্রীর জন্য পাহাড়ি রাস্তায় বাসে চড়ার এটিই ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। ভয় আর আনন্দ একসাথে গ্রাস করল আমাদের।

ঘড়িতে দুপুর ২:৩০, আমরা পৌঁছলাম বান্দরবান শহরের বালাঘাটায় অবস্থিত যুব প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। সেখানে আমাদের খাবার পর্ব শেষ করে বিশ্রাম নেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শহরের নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছা কারোর না থাকায় বিকালে চলে গেলাম বান্দরবানের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধ স্বর্ণমন্দিরে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত বৌদ্ধ প্যাগোডা। যুব প্রশিক্ষন কেন্দ্রে রাত কাটিয়ে ১৯ তারিখ সকালে লোকাল বাস সার্ভিসে করে আমরা রওয়ানা হই রুমা ঘাটের উদ্দেশ্যে, আবার সেই পাহাড়ি রাস্তা। এবারের রাস্তা আগের চেয়েও ভয়ংকর সুন্দর। ভয় বুঝি আর পিছু ছাঁড়লনা। পৌঁছতে বাজে বেলা ২:৩০। রুমা ঘাট থেকে নৌকায় চেপে স্বচ্ছ সাঙ্গুর বুক বেয়ে রুমা বাজার। রুমা বাজার থেকে ভাড়া করা চাঁন্দের গাড়ীতে করে রওয়ানা হলাম বগালেকের উদ্দেশ্যে।
জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ছিল এ চাঁন্দের গাড়ীতে চড়ে পাহাড় ডিঙিয়ে চলা। রাস্তার ঢাল সমতল ভূমির সাথে প্রায় ৫০ ডিগ্রি হবে। পাহাড়ী রাস্তা এমন খাড়া হবে এটাই স্বাভাবিক, তাই বলে এ রাস্তা দিয়ে গাড়ী চলবে! ড্রাইভারের বিন্দুমাত্র অসতর্কতার পরিনাম আমাদের নির্ঘাত মৃত্যু। যাহোক শেষপর্যন্ত কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই গাড়ী গিয়ে থামল বগালেকের নিকটবর্তী এক পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আমরা সবাই বগালেকে উঠলাম। বগালেক বাংলাদেশের সবচেয়ে উুঁচুতে অবস্থিত লেক, সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফিট। কষ্টকর গাড়ীর জার্নি শেষে এই ১৮০০ ফিট উঠতেই সবাই হাপিয়ে উঠলাম কিন্তু উঁঠার পর পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বগালেকের সৌন্দর্য আমাদের সব ক্লান্তি নিমিষেই মুছে দিল।

বগালেকে ভাড়া করা কটেজে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল অর্থাৎ ২০ মার্চ সকাল ৭:৩০ মিনিটে শুরু হয় কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে ট্রেকিং। আমাদের গাইড আলমগীর ভাই সবার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি করে লাঠি, কারণ ট্র্রেকিং এর রাস্তা ছিল অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ। অকাশচুম্বি মনোবল নিয়ে আমাদের টিম একের পর এক ক্ষুদ্রতর পাহাড় অতিক্রম করে ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝ পথে সাক্ষাত মিলল পাহাড়ী ঝরণার। ঝরণা হতে প্রয়োজনীয় খাবার পানি সংগ্রহ করে আবার রওনা হলাম লক্ষ্যপানে। পথে তিন বার যাত্রা বিরতি দেয়া হল, কারণ ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উচ্চতায় পাহাড় বেয়ে উঠা সত্যিই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। কেওক্রাডং এর চূড়ার কাছাকাছি অবস্থানে এসে আমাদের মধ্যে শুর– হল ঠাণ্ডা প্রতিযোগিতা; কে কার আগে পৌঁছতে পারে চূড়ায়। অবশেষে আমাদের দল মাত্র ৩ ঘন্টা ৫৪ মিনিট সময় নিয়ে বেলা ১১:৪৬ এ পৌঁছে গেল সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩১৭২ ফুট উচুতে অবস্থিত কেওক্রাডং এর চুড়ায়। প্রায় দীর্ঘ চার ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ে আরোহনের যে ক্লান্তি, তা ভূলে গেছে আমাদের টিমের সকলেই। আমাদের টিম মেম্বার জিমি, কাসিফ, আজিজ, তানভীর, পলাশ, দ্বীপ, জবা, রিফাত, হাবীব, ইশতিয়াক, কামরুল, মিঠু, রাসেল, শুভ্র আর মনির মুখে তখন বিজয়ের যে তৃপ্তির হাসি, তাকে ছাড়িয়ে ক্লান্তির ছাপ বিন্দুমাত্র উঁকি দিতে সাহস পায়নি।

চূড়ায় এসে শুরু হল ফটোসেশন আর পরিচ্ছন্নতা অভিযান। চূড়ায় তৈরী মঠাকৃতির বসার স্থানে বসে আমরা সবাই হালকা খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলাম। অনেকে বিশ্রামের সময়টা নষ্ট না করে চলে গেল পার্শ্ববর্তী দার্জিলিং পাড়ায়। স্বচক্ষে দেখে আসল সেখানকার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবন ধারা। সৌভাগ্য বসত আমরা কেওক্রাডং চুড়ায় টেলিটকের নেটওয়ার্ক পেয়েছিলাম। সুযোগে সবাই যে যার প্রিয়জনদের কাছে কেওক্রডং জয়ের অনুভুতি শেয়ার করল।

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল; এবার ফেরার পালা। বেলা ১ টা ৩০ মিনিটে আমরা রওনা দিলাম আমাদের বেস ক্যাম্প অর্থাৎ বগালেকের উদ্দেশ্যে। নামার সময়টা ছিল তুলনা মূলক ভাবে বেশী বিপদজনক। তারপরও মাত্র ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম বগালেকে।

পরদিন, অর্থাৎ ২১ তারিখ সকাল বেলা বগালেক থেকে যাত্রা শুরূ করলাম রূমা বাজারের উদ্দেশ্যে। এবার আর গাড়ীতে চড়ে নয়, পাহাড় আর ঝিড়ি পথের মধ্য দিয়ে ট্রেকিং করে। সবাই বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, শেষ বারের মত বগালেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ করে নিচ্ছিল চোখ দুটি। মনে হচ্ছিল আমরা যত দূরে সরে যাচ্ছি লেক, পাহাড় আর কটেজ গুলোর সৌন্দর্য্য যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘ ৫ ঘন্টা ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছলাম রূমা বাজারে। সেখানে গাইডকে বিদায় দিয়ে প্রথমে নৌকা এবং পরে বাস যোগে চলে এলাম বান্দরবান শহরে। বান্দরবান থেকে রাত সাড়ে আটটায় আমাদের বাস যাত্রা করল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ২১তারিখ সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে আমাদের টিম ক্যাম্পাসে পৌঁছল রক্তিম সূর্যকে জাগিয়ে।
সকাল বেলা ক্লাবের সভাপতি সহ অনেকেই অপেক্ষা করছিল আমাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য। শেষ হল আমাদের সফল অভিযান।

এ অভিযান ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সংগঠনের পক্ষ হতে প্রথম কেওক্রাডং অভিযান এবং সেই সাথে ক্লাবের এযাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ এ্যাডভেঞ্চার। এ এ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের নতুন ধরনের আনন্দ দান, সেই সাথে এ্যাডভেঞ্চার করার মানসিকতা তৈরী করা যা আমাদের দেশে খুব কমই করা হয়ে থাকে। এ এ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে তরুন প্রজন্মের মধ্যে ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা তৈরী ও পরিপুষ্ট হবে সেই সাথে সহায়ক হবে দেশ তথা জাতির কল্যানে মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের পথে বাধাকে ঝেড়ে ফেলে লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রত্যয় সৃষ্টিতে।


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫১
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×