somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক সন্ধ্যার গল্প

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আব্বাজানের দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যা।এর ভিতর নতুন করে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে।স্থানীয় ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখালেও মন বলছিল,ঢাকায় এনে চেকআপ করালে ভালো হত।যে চিন্তা সেই কাজ।আব্বাজানকে বললাম,“একটু কষ্টকরে হলেও আগামীকালের সকালের ট্রেনে আম্মাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন,আপনাকে ঢাকার বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব”।আব্বাজান যথারীতি সকালের ট্রেনে ঢাকায় চলে আসলেন।দুপুরে দুমুঠো খেয়ে বিকাল পাঁচটার ভেতর এক বড় ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গিয়ে হাজির হলাম।বড় ডাক্তার! তাইতো দুই-তিন আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয়।এক পরিচিত ভাইয়ের সহায়তায় অনেক কষ্ট করে সিরিয়ালে নাম লিখালাম।বড় ডাক্তার সাহেব প্রতিদিন ৭৫ জন রোগী দেখেন,ভিজিট ৭০০ টাকা।আমাদের সিরিয়াল নাম্বার ৭৪। সিরিয়াল ৭৪ হলেও মন খারাপ করলাম না,বড় ডাক্তারের চেম্বারে এসেছি,সিরিয়ালে যে নাম লেখাতে পেরেছি এও কম কিসের।মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম।

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বড় ডাক্তার সাহেব চেম্বারে হাজির হলেন।চেম্বারের সামনের রিসিপসন রুমে একপাশে ৩০ টা চেয়ার সাজানো।আমি দেয়াল ঘেঁষে পাঁচ নম্বর সারির তিন নম্বর কলামের চেয়ারটায় বসলাম।আমার আব্বাজান বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেননা,তাইতো কিছুক্ষণ পর পর চেয়ার থেকে উঠে এদিক ওদিক হাঁটাচলা করতে লাগলেন।আমার ব্যাগে হান্স অ্যান্ডারসনের একটা ছোটগল্পের অনুবাদ ছিল।কলিকাতার নামকরা বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক বইটির অনুবাদ করেছেন।কিন্তু পড়ে একটুকুন সাহিত্যরস পেলাম না।মনে হচ্ছিল যেন বই নয় কুইনাইন গিলছি।ইতোমধ্যে পুরো রিসিপসন রুম প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে।শুধুমাত্র আমার বামপাশের দুটো চেয়ার খালি পড়ে ছিল।হঠাৎ এক মহিলার আর্তচিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

“ ও আল্লাহ ...আমি মরে গেলাম ,আমাকে বাঁচাও ... ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান ...ও আল্লাহ...ও খোদা... আমি মরে গেলাম...লা ইলাহ ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ...লা ইলাহা...”

কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক(পড়ে অবশ্য জানতে পারলাম উনার ছেলে) তাকে ধরে এনে বাইরের দিকের চেয়ারটায় বসালেন।মাঝখানের চেয়ারটা তখনো খালি পড়ে ছিল।উনার আর্তনাদ কিছুটা থামলে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম,“খালাম্মা আপনার কি হয়েছে”?উনি বললেন,বাবা আমার কিডনিতে সমস্যা।একটুকু বলার পর...

“ ও আল্লাহ ...আমি মরে গেলাম ,আমাকে বাঁচাও ... ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান ...ও আল্লাহ...ও খোদা...আমি মরে গেলাম...লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ...লা ইলাহা...”

বইটা যে আর মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারবোনা এটা নিশ্চিত হয়ে যত্ন করে বইটি ব্যাগের ভিতর রেখে দিলাম।চোখ নাকি মনের কথা বলে,তাই আজ এই পরীক্ষা করার জন্য আনমনে কিছুক্ষণ খালাম্মার চোখের দিকে চেয়ে রইলাম।পাশাপাশি বসাতে খুব ভালোভাবে চোখ দেখতে পারিনি তবে যতটুকু বিশ্লেষণ করেছি তাতে মনে হয়েছে,খালাম্মার হৃদয়ের মাঝে যে দুঃখের সাগর প্রবাহিত হচ্ছে চোখের জল সে তুলনায় খুবই নগণ্য।এরই মাঝে এক ষোড়শ বয়সী তরুণী তার মাকে নিয়ে আমাদের খালি চেয়ারটার দিকে আসছিল।সেই তরুণীর মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, তার কিডনিতে যেন প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে ! কিন্তু একদম সুস্থিরভাবে মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলছিলেন।তাকে দেখে কেমন যেন মায়ায় পড়ে গেলাম।ঐদিকে খালাম্মার আর্তনাদ কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে চলছে।চেয়ারের কাছাকাছি এসেই খালাম্মাকে বললেন, “excuse me, aunty.আপনি কি ভিতরের চেয়ারটায় যাবেন ? আমি একটু বসব”।খালাম্মা জবাব দিলেন “আমি অসুস্থ ভিতরে যেতে পারবোনা, এর পর আবারও...ও আল্লাহ... ও খোদা আমাকে বাঁচাও... আমি মরে গেলাম...” মহিলাটি কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে আরও আন্তরিকতার সাথে বললেন, “excuse me, aunty.আপনি কি একটু ভিতরের চেয়ারটায় বসবেন? খালাম্মা যেন আরও ক্ষেপে গেল।ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “আমি ভিতরে যেতে পারবনা”।মহিলাটি বলল, “তাহলে আপনি একটু উঠুন,আমি ভিতরে বসি”।কিন্তু না,তিনি উঠবেনও না।তিনি ঐ মহিলাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, “তুমি এই দুই সারির ফাঁক দিয়ে যেতে পারলে যাও আর না হয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকো,আমি অসুস্থ,ও আল্লাহ আমি মরে গেলাম... ও মা... ও ...”।

এই বয়সী একজন মানুষের আচরণ এমন অমানবিক হতে পারে আমি ভেবে পেলাম না ! অন্যদিকে এত অন্যায় করার পরও ঐ মহিলা কিছু বললনা? উনি কেমন মানুষ ? মনে হচ্ছিল,উনার হয়ে আমি কিছু কথা শুনিয়ে দেই কিন্তু আমি বলতে যাব,ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আস্তে করে বললেন,“খালাম্মা আমিও অসুস্থ,আমরা এ জন্যই তো হাসপাতালে এসেছি”।অবাক করা কাণ্ড,এ কথা শুনে খালাম্মা একদম চুপ হয়ে গেল।আর কোন কথা না বলে চেয়ারটা ছেড়ে দিল।

আব্বাকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে রাঁত সাড়ে এগারটার দিকে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন ভাবছিলাম।“মানুষের অন্তরে যখন প্রশান্তি থাকেনা তখন তার মন-মানসিকতাও ভালো থাকেনা।একজন মানুষ তা যতই লুকানোর চেষ্টা করুক একসময় তা বেড়িয়ে আসবেই।অন্যদিকে অন্তরে প্রশান্তি থাকলে বাইরের আঘাত নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়।পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই সত্যের পতাকাবাহীরা মানুষের সামনে যখন সত্যকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে,তখন তাদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ।কিন্তু এই দৈহিক অত্যাচার তাদের প্রশান্তচিত্ত অন্তরে খুব বেশী প্রভাব ফেলতে পারেনি।যার ফলশ্রুতিতে যুগে যুগে শত অত্যাচারের পরও প্রশান্তচিত্ত মুমিনেরা জয় লাভ করেছে।আর অস্থিরচিত্ত মুমিনেরা দুনিয়ার ভোগবিলাসে মত্ত থেকে হারিয়ে গেছে কালের গহবরে"।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×