গোলাম আযমের লেখা আত্মজীবনি মাত্রই শেষ করলাম। একটা মানুষকে বোঝার জন্যই কষ্ট করে তিন খন্ড জীবনী পড়া। পড়ে বুঝলাম এই লোকটার মতো অভাগা আসলেই কেউ নেই। বুকে পাকিস্তান নিয়ে বাস করতে বাংলাদেশে। তাই সারা বই জুড়েই পাকিস্তান নিয়ে আক্ষেপ। এটা পড়ে বুঝলাম তার আন্ডা-বাচ্চারাও কি পরিমান মনোকষ্টে থাকে।
আসুন দেখি কি লিখেছেন গোলাম আযম।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় অধ্যাপক গোলাম আযম নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলতেন, 'তারা মতা পেলে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) আলাদা করে ফেলতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আপনারা পাকিস্তানের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়ত পাবেন না।' (৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১০৭)
তৃতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সাফাই গেয়েছেন, পাক বাহিনীকে সহযোগিতা করার যুক্তি খুঁজেছেন, বর্ণনা করেছেন শান্তি কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট। তার দাবি, শান্তি কমিটির সঙ্গে জনগণের কোনো শত্রতা ছিল না, মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই জনগণের সঙ্গে তাদের দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
গোলাম আযমের মতে, ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ কোনো গৌরবময় অর্জন নয় বরং তা হলো 'পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনী' (পৃ-২১১)। একই পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, '১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সংকট ছিল বহিঃশক্তি জড়িত দলাদলির ব্যাপার, যাতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উপাদানসমূহ এবং আন্তর্জাতিক উপাদানসমূহ এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির যোগসূত্র ছিল।'
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের সাফাই গেয়ে গোলাম আযম লিখেন, 'সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে জনগণ যে অসহায় অবস্থায় পড়ে আমাদের কাছে আসছে আমাদেরকে যথাসাধ্য তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ পরিস্থিতিতে জনগণের সামান্য খিদমত করতে হলে সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমেই তা সম্ভব (পৃ-১৪৩)।'
জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় ততকালীন সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেই সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে গোলাম আযম পরের পৃষ্ঠাতেই উল্লেখ করেন। টিক্কা খানের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রার আহ্বান জানিয়ে রেডিওতে ভাষণ দেন বলেও তিনি একই পৃষ্ঠায় লিখেন। ভাষণে গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের অজুহাতে ভারত বাংলাদেশ দখল করতে চায় উল্লেখ করে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। এই ভাষণ প্রচারের পরই সারা দেশে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের হুমকির মুখে পড়ে- এটাও উল্লেখ করেন তিনি।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে জামায়াত দেশবাসীর উপকার করেছে- জীবনীতে এমন দাবিও করেছেন জামায়াতের সাবেক আমির। জনৈক সূর্য্য মিয়াকে পাক সেনাবাহিনী তার সুপারিশে ছেড়ে দিয়েছিলে উল্লেখ করে তিনি লিখেন, 'চোখবাঁধা অবস্থায় তাকে (সূর্য্য) জিপ থেকে এক সৈনিক লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে গেল। লাথি মারার সময় নাকি বলল, কোন গোলাম আযম নাকি সুপারিশ করেছে, যা বেঁচে গেলি (পৃ-১৪৫)।' তিনি আরো লিখেছেন, 'শেখ মুজিবের আত্মীয় হওয়া ছাড়া তার (সূর্য্য) আর কোনো অপরাধ নেই (পৃ-১৪৪)'।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নানা অপকর্মের সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধকে নাশকতামূলক ততপরতা উল্লেখ করে তৃতীয় খণ্ডের ১৫০ পৃষ্ঠাতে গোলাম আযম লিখেন, 'যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক ততপরতা থেকে রার জন্য জীবন দিচ্ছে তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?'
গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই পাক সেনাবাহিনীকে হিংস্র হতে বাধ্য হয়েছে বলেও দাবি করেন ১৫২ পৃষ্ঠাতে। তার দাবি, মুক্তিযোদ্ধারা অবাঙ্গালিদের নির্বিচারে হত্যা করেছে এবং এর প্রতিশোধ নিতেই পাক বাহিনী বাঙ্গালিদের প্রতি নৃশংস হতে বাধ্য করেছে। গোলাম আযম পাক সেনাবাহিনীর নৃশংসতাকে 'মোটাবুদ্ধির সৈনিকদের অনর্থক' কাজ বলেও উল্লেখ করে পরের পৃষ্ঠাতে লিখেন, 'মোটা বুদ্ধির সৈনিকরা এভাবে কিছু হিন্দুকে অনর্থক মেরে হিন্দু সম্প্রদায়কে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করল।'
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে শান্তি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে প্রাদেশিক গভর্নর নূরুল আমিনের বাসায় এক বৈঠকে গোলাম আযম বলেছিলেন, 'পাকিস্তান টিকে থাকুক, আমাদের দেশ ভারতের খপ্পর থেকে বেঁচে থাকুক- এটা অবশ্যই আমাদের আন্তরিক কামনা (পৃ-১৫৬)। দুই পৃষ্ঠা পরেই তিনি আপে করে লেখেন, 'মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির সঙ্গে শত্রুতা না করলে জনগণের পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতো না।'
জীবনীর তৃতীয় খণ্ডের '১৬ ডিসেম্বরে আমার অনুভূতি' শীর্ষক অধ্যায়ে গোলাম আযম লিখেন, 'ডিসেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যাবে তা ধারণা করিনি বলে মনের দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলাম না'। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে মাসিক উর্দু ডাইজেস্টের সম্পাদক আলতাফ হোসাইন কুরাইশীকে তিনি বলেছিলেন, 'উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ও শিখ বাহিনীর নিকট প্রায় এক লাখ সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পন করলো। ইংরেজ আমলেও মুজাহিদ বাহিনী শিখদের নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। তারা শহীদ হয়েছেন' (পৃ-২৪২)।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগেই গোলাম আজম '৭১ এর ২২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে পাকিস্তান যান। এরপর তিনি দীর্ঘদিন আর দেশে ফিরেননি।
গোলাম আযমের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে ক্রিকেট খেলা প্রসঙ্গে তার মন্তব্যেও তার পাকিস্তান প্রীতি স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তান দলকে পরাজিত করায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৭১-এর মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে খেলার ফলেই বিজয় সম্ভব হয়েছে। এই মন্তব্যের সমালোচনা করে গোলাম আযম লিখেন, 'খেলা খেলাই। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে টেনে এনে তিনি (শেখ হাসিনা) অযথাই হাস্যষ্পদ হলেন'। অথচ পরের অনুচ্ছেদেই গোলাম আযম লিখেন, 'পাকিস্তান মাঝে মাঝে সাধারণ দলের নিকট পরাজিত হলেও ভারতের নিকট খুব কমই পরাজিত হয়েছে। জানি না পাকিস্তানী দল ৪৭ এর চেতনা নিয়েই ভারতের বিরুদ্ধে খেলে কিনা (পৃ-১২৬)।'
গোলাম আযম এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, ঢাকা স্টেডিয়ামে যতবার ভারত ও পাকিস্তান দলের খেলা হয়েছে প্রতিবারই 'বাংলাদেশী দর্শকের শতকরা প্রায় ৯৯ জনই পাকিস্তান দলের প্রতিই আবেগপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যানার প্রদর্শন করলেও তা দর্শকদের মনে সামান্য প্রভাবও বিস্তার করতে পারেনি। দর্শকরা ঐ ব্যানার দেখে মন্তব্য করেছে ''রাখ মিয়া মুক্তিযুদ্ধের কথা, এখানে মুসলমানদের বিজয় চাই''।
একই খণ্ডে জামায়াতের সাবেক আমির আরো লিখেন, 'ধর্মনিরপেবাদী ও ভারতপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্যের কথা শুনেছি। তারা নাকি বলেন, আমরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে যুবসমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারের জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করি তা স্টেডিয়ামে পাক-ভারত খেলায়ই নস্যাত হয়ে যায় (পৃ-১২৭)।'
স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রমতার অংশীদার করায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন গোলাম আযম। আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডের ১৭৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই তিনি 'স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজন বর্জন করে সকলকেই তার সংগঠনে সমবেত করেন। ৭১-এ তার বিপরীত ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও শাহ আজিজুর রহমানের ওপর প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতার দায়িত্ব অর্পণ করেন।'
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারেরও ঘোর বিরোধী গোলাম আযম। তার মতে, 'মুজিব হত্যার বিচার জনগণের উপর মহা অবিচার।' দ্বিতীয় খণ্ডের তিনি লিখেন, 'কয়েকজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা সফল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশকে উদ্ধার করেন।...এটা যদি সাধারণ হত্যা হয়ে থাকে তাহলে গোটা দেশবাসীকেই আসামি করা প্রয়োজন ছিলো। কারণ এ হত্যায় তারা আনন্দ ও উল্লাস করেছে।'(পৃ-১৭৪)।
কৃতজ্ঞতা ওয়াসেক বিল্লাহ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৪:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




