একটুকু ছোঁয়া লাগে...
আখতার মাহমুদ
এক একটা দিন আসে অদ্ভুত সুন্দর। শুভ'র কাছে অবশ্য সব দিনই এক। সে চিরকালই হিসেবি, নির্মোহ, ছকে বাঁধা। অন্য সবার মত হঠাৎ উচ্ছ্বাসে ভাসে না। প্রয়োজনে হাসে প্রয়োজন হলে দুঃখিত হয়। তবু শুভ্র'র মনে হতে লাগল আজ দিনটা অন্যরকম, একদম আলাদা। আজ পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। আজ না বলে দেয়া যায় সব্বাইকে। ন'টায় অফিস। সামনে বাস এসে থেমেছে। মানুষ হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে মুহূর্তেই। এই সময়টায় মানুষগুলোর মুখ কেমন যেন হিংস্র হয়ে যায়। প্রায়ই শক্তিমানেরা আগে ভাগে উঠে নিজ অবস্থান বেছে নেয়। সারভাইবাল অব দা ফিটেস্ট!
নিরাসক্ত দৃষ্টিতে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে শুভ্র সরে আসে ফুটপাথের ওপর। তার সাথে ওই মানুষগুলোর কোন তফাৎ নেই। গতকালও সে হুড়োহুড়ি করে কনুই দিয়ে গুতিয়ে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়েছিল নিজের জন্যে। আশে পাশের কারো দিকে তাকানোর ফুসরৎ মেলেনি। আজ সে আলাদা। আজ দিনটাই যে অন্যরকম! শুভ্র ফুটপাথে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা নিল এককাপ। চায়ের কাপ হাতে একটু আনমনা হল সে। কতকাল পর ফুটপাথে চা খাওয়া পাঁচ? সাত? সময়ের হিসেব গুলিয়ে যায়। সেই কত কত কাল আগে সমস্ত নগরী চষে বেড়ানো সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। যেন অন্য কোন জন্মের কথা। চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেটের তেষ্টা পেল ওর। সিগারেট ছেড়েছে আজ তিন বছরের বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে কোনদিন তার এমন ইচ্ছে করেনি। অথচ আজ.... আকাশে চোখ রাখল সে। আকাশটাও আজ একটু বেশি নীল দেখাচ্ছে না?
* * *
মোহিত উল আলম, টি ডি কোম্পানীর চট্টগ্রাম শাখার প্রধান। তাঁর সামনে বসে শুভ্র। সে এই কোম্পানীর চট্টগ্রাম শাখার চীফ এক্সিকিউটিভ। মোহিত উল আলম ঝুঁকে আছেন একটি কাগজের উপর। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু একটা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর কপালের দুপাশের শিরা তিড়িক তিড়িক লাফাচ্ছে। আচমকা টেবিলে একটা চাপড় মেরে তিনি বলে উঠলেন- 'আর ইউ ম্যাড শুভ্র?'
শুভ্র হাসল। 'নো স্যার আয়াম স্টিল ইন সেন্স।'
'কেন তুমি রিজাইন দিতে চাইছ? টেল মি দা ট্রুথ। তুমি কি ভাল অফার পেয়েছ অন্য কোথাও?'
'না স্যার। আমি আসলে কান্ত। আই নিড রেস্ট। অন্তত দু'বছরের রেস্ট।'
'ইউ আর আ গ্রেট ফুল। আই নেবার এক্সপেক্টেড সাচ্ চাইল্ডিশ ম্যানার ফ্রম ইউ। বাট আই লাইক ইউ। দ্যাটস্ হোয়াই আয়াম নট অ্যাকসেপ্টিং দিস। আয়াম গিভিং ইউ ফিফটিন ডেজ এজ মেডিকেল লিভ। ইফ ইউ রিয়েলি থিংক দ্যাট ইউ উইল নট ক্যারি অন ইউর জব হিয়ার, দ্যান ইউ আর এ ফ্রি ম্যান। বাট ইফ ইউ রিয়েলাইজ দ্যাট ইউ শুড নট লিভ দিজ কোম্পানি,দ্যান কাম ব্যাক জাস্ট আফটার ফিফটিন ডেজ। নাউ গেট আউট ইউ ফুলিশ ইয়ংম্যান!'
শুভ্র হেসে অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
বাইরে ঝকঝকে দিন। অন্যরকমের একটি দিন।
* * *
নিশাত ভেতর থেকে নাস্তার ট্রে সাজিয়ে এনে রাখল শুভ্র’র সামনে। শুভ্র বলল- 'কি সাংঘাতিক এত খাবে কে!'
নিশাত বলল- ' খাও খাও। তুমি তো আর সবসময় আসবে না। সময় ও বা কোথায়, তোমরাতো আবার ওপরতলার লোক।'
শেষ কথাটায় স্পষ্ট ব্যঙ্গের সুর। একটু মলিন হল শুভ্র'র মুখ। শেষ তিনবছর আগে এসেছিল নিশাতদের বাসায়। এর ভেতর আর দেখা হয়নি। যোগাযোগও না। নিশাত মুখের একপাশ ঢেকে কৌতুহলি চোখে ওর সামনে বসল।
'তারপর বলো, চাকুরি ছাড়লে কেন?'
একপিস কেকের অর্ধেকটা মুখে পুরে শুভ্র বলল- 'উমম.. ছেড়ে দিয়েছি। ভাল লাগছিল না। মুক্তি চাইছিলাম আসলে। এত বেশি ব্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়েছিলাম যে বিগত সময়ে কখনো ভাবার অবসর মেলেনি কেন ছুটছি, কোন নেশায়।'
'তুমি চেয়েছিলে প্রতিষ্ঠা-সাফল্য। তা তুমি পেয়েছোও। তোমার ব্যস্ততা, তোমার ক্রমাগত সরে যাওয়া অতীত থেকে এসব তো তোমারই চাওয়া ছিল এককালে। এখন কেন আফসোস? তোমারতো অতৃপ্তি থাকার কথা নয় শুভ্র?'
'তবু অতৃপ্তি জমে থাকে নিশাত। জানি না কেন। একদিন হঠাৎ মনে হল আমার যা করার কথা ছিল না এতদিন তা-ই করে যাচ্ছিলাম। আমার অন্য কোন কাজ অসমাপ্ত পড়ে আছে। আমার অন্য কিছু করার আছে।'
কৌতুকের চোখে দেখল নিশাত ওকে। 'অন্য কি করার আছে?'
'জানি না। এমন নয় চাইলেই আগের জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে বা যাব।'
'চাকুরি যে ছাড়লে এখন তোমার চলবে কি করে?'
হাসল শুভ্র। 'অন্তত দুবছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মত যথেষ্ট সঞ্চয় আছে। দুবছর পর ভাবব এ নিয়ে।'
'এ দুবছর কি করবে?'
'জানি না!'
'ইউ শুড নো। তোমার জীবন তুমি জানবে না কেন? জীবন কি নাটক,উপন্যাস?'
'আমি আসলেই ভাবিনি কি করব। তবে কিছু একটা নিশ্চয় করব।’
'তোমরা সব পুরুষই দায়িত্বহীন। যা ইচ্ছে তাই করবে তোমরা। দ্যাটস হোয়াই আই হেইট ইউ অল।'
রেগে যাওয়ায় মুখের একপাশ থেকে ওড়না সরে গেছে খেয়াল করেনি নিশাত। ওর মুখের একপাশের পোড়া দগদগে ক্ষত যেন সম্মোহিত করে রাখল শুভ্রকে। বছর চারেক আগে ক্যামিস্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশে এক সহপার্ঠির অন্যমনস্কতায় কিছু এসিড ছিটকে পড়েছিল নিশাতের মুখে। সেই থেকে নিশাত পুরুষদের প্রতি একধরণের ঘৃণা পোষণ করে আসছে। তবে এতবড় বিপর্যয়ের পরও নিশাত ভেঙে পড়েনি। ঠিকই পড়াশুনা চালিয়ে গেছে। এখন শিক্ষকতা করছে একটা স্কুলে। জীবন সম্পর্কে এই মেয়ের ধারণা তার সাথে মিলবে না। শুভ্র উঠে পড়ল।
'আজ উঠি নিশাত। ভালো থেকো।'
'একটু দাঁড়াও।' মিনিট খানেকের জন্যে ভেতরে গেল নিশাত। ফিরে এল একটুকরো কাগজ হাতে।
বলল- 'জানি তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। এই নাও রুহি'র ঠিকানা। এখানে চাকুরি করে। বিকেল পাঁচটায় ছুটি ওর। রুহি ওর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে বছর দুয়েক আগে। লোকটি পাড় মাতাল ছিল। ছেলেকে নিয়ে এখন একা থাকে রুহি। আমার বন্ধুটি অনেক কষ্ট সয়েছে জীবনে।'
নিজের ভেতরের নীরব ইচ্ছেটা ধরা খেয়ে যাওয়ায় যতটা না চমকে গেল সে তার চেয়ে বেশি চমকাল রুহির ডিভোর্সের কথা শুনে। রুহির বিয়ে হয়ে গেছে শুনে শুভ্র ব্যাপারটা নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিল। তাই খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার মনে হয়েছিল রুহি যেখানেই আছে নিশ্চয় সুখে আছে। কিন্তু একি শুনল। এ সংবাদ কি তার আরো আগে জানা উচিত ছিল না?
* * *
রুহির অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট হাতে শুভ্র বারবার নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছিল। সেইসব দিন যেন ছিল শুধুই ভেসে যাবার উড়ে যাবার দিন। ওই সময়টা কি কোনকালে বাস্তব ছিল? শুভ্র ণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ে যায়। নাকি অলৌকিক কোন স্বপ্ন ছিল শুধু? সেই সময়টা এখনো সত্যি হয়ে থাকতে পারত। শুভ্র বিচার করার চেষ্টা করে কি দায়ী- তার কাপুরুষতা না উপরে ওঠার সুতীব্র লোভ?
সেই দিনটা স্পষ্ট ভাসছে চোখে। জলভরা চোখে ফিরে যাচ্ছে রুহি। সময়টা ছিল এমনই এক বিকেল। শুভ্র দাঁড়িয়ে পাথর মুখে। চলে যাচ্ছিল রুহি এক পা এক পা করে অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে,তবু শুভ্র একবারও ফেরায়নি ওকে। যদি ফেরাত! মা-বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল রুহির। রুহি চেয়েছিল শুভ্র ওকে বিয়ে করুক। কিন্তু শুভ্র বাস্তবতার হিসেব কষে বলেছিল- 'আমার কিছু করার নেই। পারলে অপো করো আর না পারলে মা-বাবার অবাধ্য হয়ো না।'
কি পাষাণের মত সে ফিরিয়েছিল দেবীসম সেই নারীকে! তার কি আসলেই কিছু করার ছিল না? কাপুরুষতা না উপরে ওঠার সুতীব্র লোভ লাগামে বেঁধে রেখেছিল তাকে?
হঠাৎ বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর। ওইতো সে! বেরিয়েছে অফিস থেকে। সেই ধারালো চেহারা। তীব্র চোখ। সেই আগের মতন। কেবল চোখের নিচে দীর্ঘ কান্তির ছাপ। সুতির মলিন শাড়িতে অমলিন দেবী এক হেঁটে আসছে মাপা, অভিজাত পদক্ষেপে। শুভ্র'র মনে হল পায়ে জোর নেই। একটু হেঁটে গিয়ে সামনে দাঁড়ানোর মতন মানসিক শক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না সে। রুহিও দেখল শুভ্রকে। দাঁড়িয়ে পড়ল। শুভ্র'র মনে হল সময় থমকে গেছে। মিথ্যে হয়ে গেছে মাঝখানের এতগুলো বছর। কেবল সত্যি সেই ভেসে যাওয়া উড়ে যাওয়া অস্থির দিনগুলি।
রুহিই এগিয়ে এল। হেসে জিজ্ঞেস করল- ' কেমন আছো?'
'তুমি কেমন আছো?'
'ভালো। অফিস খুঁজে পেলে কি করে?'
'নিশাত ঠিকানা দিয়েছে।'
'ওঃ।
কথা বলতে বলতে দুজনেই হাঁটতে শুরু করেছে।
'অনেক পরিশ্রম করো, না?'
হাসল রুহি। 'দু মুঠো খেয়ে বাঁচতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। এ কথাতো তোমার মতো বাস্তববাদী মানুষের না জানার কথা নয়।'
খোঁচাটা নীরবে হজম করল শুভ্র। 'তোমার ছেলে কত বড় হয়েছে?'
'অন্য কথা বলো। তোমার কি খবর। বেশ ভাল আছ, না? শুনি অনেক রোজগার করো। অবশ্যই তোমার মতো বাস্তববাদী লোক অনেক আয় করবে এটাই স্বাভাবিক।'
'শুনলাম একা থাকো।'
'হুঁ।'
'তোমার একা নিশ্চয় কষ্ট হয় অনেক।'
'হাহঃ ,কষ্ট! তুমি বোঝ শুভ্র কষ্ট কি? বোঝনা। বাস্তববাদীরা কষ্ট খুব একটা চেনে না। এনিওয়ে বাদ দাও এসব। তোমার ভাই-ভাবী কেমন আছে?'
'ভাল।'
এরপর অনেকণ নিশ্চুপ হাঁটল ওরা পাশাপাশি। শুভ্র ভেবে পাচ্ছিল না ঠিক কি বলা যায়। যে কথা সময়ে বলা হয় না সে কথা অসময়ে বড় বেখাপ্পা, বেমানান। কিছু একটা বলতে গিয়েও সে থেমে গেল। রুহির সাথে দেখা করার আগে মনে হচ্ছিল অনেক কথা জমে আছে। অন্তত রুহিকে মন খুলে সব বলা যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আসলে রুহিকে কিছুই বলার নেই। সব বলা না বলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
'শুভ্র তুমি কি কিছু বলবে?'
'তোমাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঠিক গুছিয়ে নিতে পারছি না।'
'বাস্তববাদী লোকেদের আবার কথা গুছিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয় নাকি।'
আহত চোখে তাকাল শুভ্র। 'খোঁচা দিয়ে কথা না বললে হয় না?'
শব্দ করে হেসে উঠল রুহি। 'খোঁচা লাগে নাকি তোমার? ওহ, এই যা! আমার বাস এসে গেছে। যাচ্ছি, ভালো থেকো। আর তোমার কথা পরে কখনো শুনব সময় হলে, কেমন?'
'কিছুক্ষণ থাকো? কোথাও বসে কথা বলি।'
'না আমাকে ফিরতে হবে, শুভ্র বাসায় একা।'
'শুভ্র?'
'আমার ছেলে। ওর নাম রেখেছি শুভ্র,' একটু থেমে ব্যস্ত রাস্তায় চোখ রাখল। 'এই একটি নামই কেবল আমার জীবনে ধ্র“ব হয়ে আছে এখন। আর সব মিথ্যে। আচ্ছা চলি।'
বাসে ওঠার জন্যে পা বাড়াল সে। শুভ্র খপ করে হাত চেপে ধরল ওর।
'রুহি.... রুহি...' কিছু একটা বলতে চাইছিল শুভ্র। কিন্তু গলার ভেতর কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে বারে বারে।
রুহি শীতল গলায় বলল- 'ন্যাকামি করো না। কাছেই আমার অফিস। কেউ দেখলে চমৎকার কিছু কথা রটবে। হাত ছাড়ো!'
'শোনো আমি ভুল করেছিলাম....'
'ব্যস! আর কিছু বলো না। কি ভুল কি ঠিক তা বিচারের সময় পেরিয়েছে অনেক আগে।'
রুহি শুভ্র'র হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে দ্রুত বাসে উঠে পড়ল। শুভ্র সেখানেই স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে রইল। রুহির বাস ছেড়ে গেলেও নড়ল না। সে কিছু ভাবছিল না, দেখছিল না। কেবল দাঁড়িয়েই রইল এক ভঙ্গিতে। গুঁড়ি মেরে রাত নেমে আসছে। আঁধারে ঢেকে গেছে সব। শুভ্র তবু ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে। শৈশব কৈশোর পেরিয়ে এসে অনেক কাল বাদে সে কাঁদছে। খুব কাঁদছে।