somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

পথিকরাজপুত্র
আমি মনোযোগী পাঠক। পড়তে ভালবাসি। পড়ে কোথাও কিছু একটা অসঙ্গতি আছে মনে হলে সেটা আলোচনা করি। ভাল লাগলেও আলোচনা করি, খারাপ লাগলেও আলোচনা করি। কেননা আমি বিশ্বাস করি, পাঠকই লেখক তৈরী করে।

তিতাস একটি নদীর নাম

১৮ ই মে, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিতাস একটি নদীর নাম- একটি মহৎ রচনা

এক বন্ধুর সাথে তর্কালোচনায় হঠাৎ বন্ধুটি জিজ্ঞেস করেছিলেন- অদ্বৈত মল্লবর্মণ-মানিক আপনার দৃষ্টিতে কেমন লেখক? তেমন না ভেবেই বলেছিলাম- আমার বিচারে তারা এলিট। তিনি ফের জানতে চেয়েছিলেন, কেন আমার বিচারে তারা এলিট? কোন পর্যবেক্ষণে? তাৎক্ষণিকভাবে এটা আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে এড়িয়ে গেলেও পরে ভেবেছি- আসলেই তো! এলিট লেখক কেনো তারা? কোন পর্যবেক্ষণ থেকে আমি তাদের এলিট-উঁচুমানের সাহিত্যিক বলতে পারি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ।

তিতাসের পাড়ের মানুষের কাছে তিতাস কতটা? কতটা আবেগ-ভালবাসা-ভরসা-আকাঙ্খা তাদের তিতাসকে ঘিরে সেটা বোঝাতেই হয়তো অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছিলেন-

“শুরুতে কে এই নাম রাখিয়াছিল, তারা তা জানে না। তার নাম কেউ কোনদিন রাখিয়াছে, এও তারা ভাবে না। ভাবিতে বা জানিতেও চায় না। এ কোনদিন ছিল না, এও তারা কল্পনা করিতে পারে না। কবে কোন দূরতম অতীতে এর পারে তাদের বাপ পিতামহেরা ঘর বাঁধিয়াছিল একথা ভাবা যায় না। এ যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়া এখানে বহিয়া চলিয়াছে। এ সঙ্গী তাদের চিরকালের। এ না হইলে তাদের চলে না। এ যদি না হইত, তাদের চলিতও না। এ না থাকিলে তাদের চলিতে পারে না। জীবনের প্রতি কাজে এ আসিয়া উঁকি মারে। নিত্যদিনের ঝামেলার সহিত এর চির মিশ্রণ।”

অদ্বৈত মল্লবর্মণ এ কটি কথা বলে তিতাসের পাড়ের মানুষের বুকের কথাগুলো অক্ষরে সাজিয়ে নিয়েছেন কেবল। তিতাস, তার পাড়ের বাসিন্দাদের হৃদয়-অস্তিত্ব। উপন্যাসটির শুরুতে অতিরঞ্জন না থাকলেও অতিবর্ণণ ছিল- এটা পাঠকের মনে হতেই পারে।। মনে হতে পারে- একটি সাধারণ নদীকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে অকারণেই। অকারণে অতিবর্ণন হয়ে পড়ছে অতিরঞ্জন। মনে হতে পারে এ-এক গতিহীন উপন্যাস। কিন্তু, পাঠকের সামনে যখন এই লাইনগুলো ধীর গতিতে সামনে এসে দাঁড়াবে-

“পাঁচপীর বদরের ধ্বনি দিয়া প্রথমে লগি ঠেলা দিল তিলক। সুবল হালের বৈঠা ধরিল। তার জোর টানে নৌকা সাপের মতো হিস্ হিস্ করিয়া ঢেউ তুলিয়া ঢেউ ভাঙ্গিয়া চলিল। তিলকচাঁদ গলূইয়ে গিয়া দাঁড় ফেলিয়াছে। কিন্তু তার দাঁড়ে জোর বাঁধিতেছে না। শুধু পড়িতেছে আর উঠিতেছে। ছইয়ের উপর একখানা হাত রাখিয়া কিশোর মাঝ-নৌকায় দাঁড়াইয়া ছিল। দেখিতেছিল তাদের মালোপাড়ার ঘরবাড়ি গাছপালাগুলি, খুঁটিতে বাঁধা নৌকাগুলি, অতিক্রান্ত উষার স্বচ্ছ আলোকেও কেমন অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে সারাটি গ্রাম, আর গোচারণের মাঠ। অদৃশ্য হইতেছে কালীসীমার ময়দান আর গরীবুল্লার বটগাছ দুইটি। জলের উষ্ণতায় শীতের প্রভাতী হাওয়াও কেমন মিষ্টি। গলুইর দিকে আগাইয়া গিয়া কিশোর বলিল, ‘যাও তিলক, তামুক খাও গিয়া। দাঁড়টা দেও আমার হাতে।”

সমঝদার পাঠকমাত্রই বুঝবেন, লাইনগুলোর পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই তিতাসের পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রায় তিনি ঢুকে পড়েছেন। আরোপিত-অর্জিত জীবন নয়। জ্বলজ্বলে বাস্তব জীবন। এখান থেকেই কিশোরদের সাথেই যাত্রা শুরু পাঠকেরও। যে যাত্রার শেষে পাঠক উপলব্দি করবেন- জীবন বড্ড করুণ। উপলব্দি করবেন তিতাস কেন তার পাড়ের মানুষদের অস্তিত্ব। শ্বাস-হৃৎপিন্ড বা নিয়তি!

উপন্যাসটিতে ধর্ম এসেছে বারবার। বারবার। ধর্ম সাধারণ মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই এসেছে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই তাদের ভেতর ধর্মের প্রভাব কতোটা ছিলো, অদ্বৈত মল্লবর্মণ একখানে আলতো করে আমাদের জানান-

“বড় মাতব্বরের পরেই একজনের কথা গ্রাহ্য হয়। কায়েত পাড়ার যাত্রার দল হয়, তাতে তিনি মুনি-ঋষির পাঠ করেন। কোপীন পরিয়া নামাবলি গায়ে দিয়া খড়ম পায়ে তিনি যখন আসরে ঢোকেন, ভয়ে তখন কারো মুখ দিয়া কথা ফোটে না। পৈতা ধরিয়া যখন রাজাকে অভিশপ দিবার জন্য গর্জন করিতে করিতে সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন, তখন আসরের চারিপাশের গরিব লোকগুলি তো দূরের কথা অমন যে রাজা, হাতে তলোয়ার গায়ে ঝকমক করা পোশাক, সেও থর থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁর পায়ের কাছে নত হয়। এমন তেজ এই জনের। নাম দয়ালচাঁদ।”

আবার একজায়গায় আমরা পড়ি এবং উপলব্দি করি, সাধারণ মানুষগুলো ধর্ম কতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে-

“কালোর মা-ই নির্দিষ্ট করিয়া দিল, কাল যে কালীপূজা হইবে, তাতে কালোর মা, অনন্তর মা আর বৃন্দার মা সংযমী থাকিবে। সংযমী যারা থাকে তারা আগের দিন নিরামিষ খায়, পূজার তিন প্রাতঃস্নান করে। পূজার জল তোলে, ফুল বাছাই করে, ভোগ নৈবেদ্য সাজায় আর ফুলের মালা গলায় নামাবলী গায়ে যে পুরোহিত পূজায় বসে তার নির্দেশ মতো নানা দ্রব্য আগাইয়া দেয় এবং প্রতিমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত নানা কাজ করে। কম গৌরবের কথা নয়। তারা পুরোহিতের সাহায্যকারিণী। অর্ধেক পূজা তারাই সমাধান করে। পুরোহিত তো কেবল মন্ত্রের জোরে। অনন্তর মার গৌরব বাড়িল। কিন্তু সুবলার জন্য দুঃখ পাইল। সে এসব কাজে কত পাকা অথচ কালোর মা তাকে কিছু বলিল না।”

এখন আপনি যদি এই ধর্মাচার, প্রথা অনুসরণের বর্ণনা দেখে আপনার পক্ষপাতদুষ্ট সেক্যুলার মননে হায় হায় শোরগোল তোলেন- ধর্ম সব খেয়ে ফেলল রে। সাহিত্যের সর্বনাশ করে ফেলল। অরুচিকর ধর্ম সাহিত্যে তুলে আনার মত বিষয় হলো? -এমন যদি সত্যিই বলেন, তবে আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো খুব দরকার। প্রয়োজনে সাইকোলজিস্টের সাথেও দুই-এক সেশন বসতে পারেন। আখেরে আপনারই কাজে আসবে।

বাংলাদেশের মধ্যবয়সী কবিদের একজন, যাকে বাংলাদেশে চেনেন না এমন কবি বোধহয় নেই। তিনি আমারই এক বন্ধুর মন্তব্য কার্টেসীসমেত পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। বিশেষজ্ঞ মন্তব্যটা ছিল এই-
‘কল্পকাহিনীর সাথে যৌনতা আর ধর্ম দুই হটকেক মিশিয়ে বাজারে ছাড়লেন আর সাহিত্য হয়ে গেলো!?’

বরাবরের মতই আমার মনে হয়েছে, দেশের নেতৃস্থানীয় সম্ভাবনাময় কবি হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিতর্ককেই সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ভুলে। অথচ আমি জানি, তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন! তিনি আবেগে নিজ দর্শনের প্রতি তীব্র প্রেমে অন্ধ হয়ে এটা ভুলে গেছিলেন যে, যেকোনো বক্তব্যকেই একটা সার্বজনীন মানদন্ডে দাঁড়াতে হয়। মানে আপনার বক্তব্য বুমেরাং হয়ে আপনাকেই আঘাত করছে কী-না এটা মাথায় রাখা উচিত। যদিও ফেসবুক আমাদের উচিত অনুচিত বোধ কেড়ে নিয়েছে।

ধর্ম বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা সাহিত্যে ধর্মের অবস্থান শুরু থেকেই ছিল। অস্বীকার করবেন? তবে আপনি প্রকাশ্যে অস্বীকার করুন চর্যাপদ, মনসামঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন –ক্লাসিক সাহিত্যকর্মগুলো। অস্বীকার করুন বিখ্যাত রচনা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ঢোড়াই চরিত মানস’- এসব। বলুন- এসব সাহিত্যের পর্যায়েই পড়ে না। এগুলোর কোথাও ধর্ম আছে কোথাও ধর্ম-যৌনতার মত হটকেক দুটোই আছে, তাই এগুলো বাতিল। সাধ্যে কুলোবে আপনার?

ধর্ম এদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটি বিষয়। একাধিক ধর্মের ‘সাধারণ মানুষেরা’ এদেশে চিরাচরিত এক ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ ছিলো চিরকাল। নিজ নিজ জ্ঞানসীমা অনুযায়ী তারা ধর্মপরায়ণ যেমন ছিলো, তেমনি অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা বরাবরই সমুন্নত ছিলো তাদের মধ্যে। আবার পড়ুন- ‘সাধারণ মানুষেরা’- অসাধারণরা নয়, এলিটরা নয়, রাজনীতিবিদরা নয়, পক্ষপাতদুষ্ট সেক্যুলাররা নয়। সাধারণ মানুষ বাদে বাদবাকিদের কেউ বিকৃত প্রজ্ঞা প্রকাশে ধর্ম বিরোধীতা নিশ্চিত করতে, কেউ নির্লজ্জ ক্ষমতা দেখাতে বা ধরে রাখতে বা কুক্ষিগত করতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে, ধর্মকে উপস্থাপন করেছে ভয়ানকরূপে। একটা বিভেদ বিশৃঙ্খলা তৈরী করেছে এই উপমহাদেশে। এটা বিশেষ করে শুরু করেছে সাদা চামড়ার শয়তানগুলো। তারা দীর্ঘদিন ধরে চতুরতার সাথে একের বিরুদ্ধে অন্যকে লাগিয়ে লাগালাগিটা চিরস্থায়ী করে গেছে। বিদায় নেয়ার আগে তারা রেখে গেছে অসংখ্য উত্তরাধিকারী-স্বেচ্ছাসেবক চ্যালা। যারা বিভেদটা জিইয়ে রাখছে। বিভেদ এখনো তৈরী করে যাচ্ছে। সহাবস্থান নষ্ট করে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত আপনার।

সেই শুরু থেকেই আমরা দেখেছি সাহিত্য-ধর্ম অবিচ্ছেদ্য। কেন অবিচ্ছেদ্য? কারণ ধর্মপালন সাধারণ বাঙালির চিরাচরিত অভ্যাস। বাঙালি নিজ নিজ বোধ অনুযায়ী ধর্ম ভীরু। ধর্মহীন বাঙালি কখনোই ছিলো না। ইতিহাসও আমাদের সে কথা বলে না। ফলে ধর্মীয় সম্প্রীতি তাদের আলাদা করে, ঘটা করে রক্ষার প্রয়োজন হয়নি কখনো। এটা বরং তাদের রক্তেই মিশে ছিলো। আরে ভাই, যে যে ধর্ম অনুসরণ করে, সে সেই ধর্ম নিয়ে লিখবে না? আপনার এতে অস্বস্তি কেন? অথবা আপনিই বা নিজ ধর্ম নিয়ে লিখতে অস্বস্তি বোধ করেন কেন?

আমরা দেখি অদ্বেত মল্লবর্মণ রামধনু অধ্যায়ে/পর্বে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন দুটি ভিন্ন ধর্মের সম্প্রীতির এক অসামান্য রূপচিত্র-

“পাঁচজনেরই ভিজা গা। সঙ্গে একাধিক কাপড় নাই যে বদলায়। ছোট ছইখানার ভিতরে তারা গা ঠেকাঠেকি করিয়া বসিয়া রহিল। কাদিরের ভিজা চুল এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তার সাদা দাড়ি হইতে বিন্দু বিন্দু জল ঝরিয়া পড়িতেছে বনমালীর কাঁধের উপর। কাদির এক সময় টের পাইয়া হাতের তালুতে বনমালীর কাঁধের জলবিন্দুগুলি মুছিয়া দিল। বনমালী ফিরিয়া চাহিল কাদিরের মুখের দিকে। বড় ভাল লাগিল তাকে দেখিতে। লোকটার চেহারায় যেন একটা সাদৃশ্য আছে যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদের সঙ্গে। তারও মুখময় এমনি সাদা সোনালী দাড়ি। এমনি শান্ত অথচ কর্মময় মুখভাব। রামায়ণ পড়া বাল্মীকি ও অন্যান্য মুনি-ঋষিদের যেন রামপ্রসাদ একজন উত্তরাধিকারী। আর এই কাদির মিয়া? হাঁ, তার মনে পড়িতেছে। সেবার গোকন-ঘাটের বাজারে মহরমের লাঠিখেলা হয়। বনমালী দেখিতে গিয়াছিল। ফিরিবার সময় তাদেরই গাঁয়ের একজন মুসলমানের সঙ্গে পথে তার দেখা হয়। তারই মুখে কারবালার মর্মবিদারক কাহিনী শুনিতে শুনিতে বনমালী প্রায় কাঁদিয়াই ফেলিয়াছিল। এর সঙ্গে আরও শুনিল তাদের প্রিয় পয়গম্বরের কাহিনী। সেজন বীরত্বে ছিল বিশাল, কিন্তু তবু তার আপন জনকে বড় ভালবাসিত। কাদির যেন সেই বিরাটেরই একটুখানি আলোর রেখা লইয়া বনমালীর কাঁধে দাড়ি ঠেকাইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বনমালীর বড় ভালো লাগিতেছে। বাস্তবিক, যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ, বিরামপুরের এই কাদির মিয়া- এরা এমনি মানুষ, যার সামনে হোঁচট খাইলে হাত ধরিয়া তুলিয়া অনেক কাঁটাঘেরা পথ পার করাইয়া দিবে। আবার দাড়ির নিচে প্রশান্ত বুকটায় মুখ গুঁজিয়া, ‍দুই হাতে কোমার জড়াইয়া ধরিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিলেও ধমক দিবে না, কেবল অসহায়ের মত পিঠে হাত বুলাইবে। বনমালীর চোখ সজল হইয়া উঠে। তার বাপও ছিল এমনি একজন। কিন্তু সে আজ নাই।”

এছাড়াও কুসংস্কার-প্রচলিত বিচিত্র প্রথা ছিলোই। যেমন আমরা দেখি একখানে লেখক লিখেছেন-

“ঝড় খুব শক্তিশালী সন্দেহ নাই। কিন্তু এ নারীও কম শক্তিশালী নহে। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া সমানে সে চেঁচাইয়া চলিয়াছে, ‘দোহাই রামের দোহাই লক্ষণের, দোহাই বাণ রাজার; দোহাই ত্রিশ কোটি দেবতার।’ কিন্তু ঝড় নির্বিকার। দাম্ভিক আঙ্গুলি হেলনে ত্রিশ কোটি দেবতাকে কাত করিয়া বহিয়া চলিল। এবার তার গলার আওয়াজ কাঁপাইয়া অন্য অস্ত্র বাহির করিয়া দিল, ‘এই ঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছুঁইসনা ছুঁইসনা- এই ঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছুঁইসনা ছুঁইসনা। কিন্তু ঝড় এ বাঁধাও মানিল না। পাশব শক্তিতে বিক্রম দেখাইয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটা কাপাইয়া দিয়া গেল। সে নারীও দমিবার নয়। এবার সুর সপ্তমে চড়াইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘যা বেটা যা, পাহাড়ে যা, পর্বতে যা, বড় বড় বিরিক্ষের সনে যুদ্ধ কইরা যা!’ এ আদেশ অগ্রাহ্য করিতে না পারিয়াই বুঝিবা ঝড়টা একটু মন্দা হইয়া আসিল এবং ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া এক সময় তারও দম বন্ধ হইয়া গেল। অনন্ত বিস্ময়ভরা চোখে তাকাইয়া রহিল তার মুখের দিকে। কি কড়া আদেশ। এমন যে ঝড়, সেও এই নারীর কথায় মাথা নত করিল।”

এই যে প্রচলিত প্রথা-কুসংস্কার যখন আমি দেখি অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখায়; আমি বুঝি- কিংবা আমার মনে হয়েছে, এতে তিনি জীবনের রূপই এঁকেছেন। যে রূপে কুসংস্কার একটা দিক মাত্র। সমস্ত কিছু নয়। অদ্বৈত মল্লবর্মণ জীবন যেমন তেমনটাই তুলে ধরছেন, মতাদর্শ চাপান নি। অথচ অনেক লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, গ্রাম-বাংলার চিরায়ত রূপ ধরতে গিয়ে কুসংস্কারকেই এর আসল রূপ বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক। যেনবা তারা বলতে চেয়েছেন এটাই এই জনপদের ধ্রুব চিত্র। যেমন শাহাদুজ্জামানের ‘নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডে’, ‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’, ‘ঘাসের উপর সবুজ বাতাস’ ইত্যাদি গল্প পড়ে আমার এই কথা বারবার মনে হয়েছে। যদিও অনেকেই দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এটা, আর আমি ধ্রুব না-ও হতে পারি! এছাড়াও তার কতিপয় গল্প আমাকে কেনো যেন বুঝিয়েছে, গল্পের চরিত্রগুলোকে তিনি পশ্চিমের চোখ দিয়ে দেখছেন। তার অনেক গল্পেই, আমার পড়া বেশি সংখ্যক গল্পেই কোনো কোনো না অভিজাত-বিদ্বান-রুচিশীল চরিত্র গল্প বর্ণনা করছে। অথচ অভিজাতের চোখে নিম্ন শ্রেণীর গল্প কতটা ফোটে সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর চরিত্রগুলোকেও বা অভিজাত-শিক্ষিত-মার্জিত-রুচিশীল হতে হবে কোনো সে বিষয়েও আমার তীব্র আপত্তি আছে। সে সন্দেহ-আপত্তি আপাতত তোলা থাক অন্য কোনো দিনের জন্যে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আমি চিনি কেবল মাত্র আলোচ্য উপন্যাসটি দিয়ে। এই উপন্যাসে তিনি যা তুলে এনেছেন তা জীবন ছেঁকে নেয়া। তিনি তুলে এনেছেন কেবল মালো সম্প্রদায়ের করুণ-সংগ্রামবহুল জীবন নয়, নিজ আহাজারি-হাহাকারও। ঠিক একারণেই তাকে আমি বলতে রাজি আছি এলিট/উঁচুমানের সাহিত্যিক। তিনি তার নিজ বিশ্বাস-বোধ-মতামত চাপাতে চাননি পাঠকের ওপর, উপন্যাসে কোথাও সেই চেষ্টা আছে বলেও মনে হয়নি আমার। মনে হয়েছে তিনি কেবল তিতাসের মানুষের চোখভরা জল-সংগ্রামের-হাসি-কান্নার পরিষ্কার ছবি তুলে ধরেছেন। কোথাও কিছুই মেকি মনে হয়নি।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’- প্রাসঙ্গিক আলাপ

অবধারিতভাবেই নদীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসটির আলোচনায় মানিক এসে পড়েন। না চাইলেও একটা তুলনা আমরা আনমনে করেই ফেলি। শান্তনু কায়সার দুটি উপন্যাসের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন-

“নদীকেন্দ্রিক বাংরা সাহিত্যের উপন্যাসসমূহের মধ্যেও অন্য যে উপন্যাসটি প্রাকৃত জীবনকে ধারণ করেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির সঙ্গে তুলনা করলেও তিতাস একটি নদীর নাম অনন্য হয়ে ওঠে। তিতাস-এ জীবনের চিত্র যে অধিকতর ঘনিষ্ঠ তার কারণ শুধু এই নয় যে, অদ্বৈতর অভিজ্ঞতা মানিকের মতো ‘অর্জিত’ নয়, ঔপন্যাসিক স্বয়ং ঐ অভিজ্ঞতার শরিক। বরং এটাও অন্যতম প্রধান কারণ যে, অদ্বৈত প্রাকৃত জীবনের ঐ শিকড়কে ঐতিহাসিক ও জীবনসংলগ্নতার আরও গভীরে ছড়িয়ে দিয়েছেন।”

তিনি আরো বলেন,

“ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ যে সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল, যাতে কুবের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘গরিবের মধ্যে সে গরিব, ছোটলোকের মধ্যে আরো বেশি ছোটলোক’ কিংবা তাদের প্রসঙ্গে তুলনা করে জানানো হয়েছে ‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’, যদিও ঐ ভাষা ঔপন্যাসিকের বটে এবং সে কারণে আন্তরিকতায় ঋদ্ধ হলেও দূরত্বজ্ঞাপক, তা শেষ পর্যন্ত কুবের ও কপিলার নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে পরিণতি লাভ করে।”

মানিক সম্পর্কে শান্তনু কায়সারের এই কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত যে, মানিক বঞ্চিত জনগোষ্ঠির জন্য যথেষ্ট আন্তরিক হলেও তার সেই আন্তরিকতা দূরত্বজ্ঞাপক ছিলো। এই যে তার বর্ণিত জীবনগুলোর সাথে দূরত্ব, একটা অনাত্মীয়তা- সেটা সম্ভব করেছে ফ্রয়েডীয়-মার্ক্সসীয় মতাদর্শের প্রভাব। আপনি তার অন্যান্য কিছু উপন্যাস যেমন- পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, চতুষ্কোণ, হলুদ নদী সবুজ বন ইত্যাদি যদি পর্যালোচনা করেন তবে পরতে পরতে ফ্রয়েড, মার্ক্স পাবেন।

এসব রচনা গভীর মনোযোগে পাঠ করলে আপনার মনে হবে- আপনার কথা বলছেন না মানিক। নিজ দর্শনের মাহাত্ম্য গাইছেন! নিজের ভাবাদর্শ চমৎকার দক্ষতায় মানিক তার লেখায় মিশিয়ে রেখেছেন। তবুও তাকেও আমি এক মহৎ-এলিট/উঁচুমানের শিল্পী বলেই জানি। কেননা বাংলায় পাঠকের অজান্তে নিজ মতাদর্শ-বিশ্বাস এক অসাধারণ দক্ষতায়-যাদুতে লেখায় ছড়িয়ে দিতে আর কোনো লেখক সক্ষম হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

শেষতক, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-কে আমি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ওপরেই রাখবো। আর অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বলবো- অকপট এক জীবন শিল্পী। আমাকে যদি সর্বকালের সেরা দশ বাঙালি ঔপন্যাসিকের তালিকা করতে বলা হয়, তার ভেতর অদ্বৈত থাকবেন, মানিক থাকবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৭ রাত ৮:০৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×