somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা, আমার আগে যেও না গো মরে

১০ ই মে, ২০০৯ দুপুর ২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১) খুব ছোটকালের কথা। মা কোথাও বেরুচ্ছেন। আমাকে সাথে নিতে চান না। কিন্তু আমি বায়না ধরেছি, সাথে যাবই। আমার বায়না শুনছেন না মা। ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে কান্না করছি আমি। অবশেষে মা বেরিয়ে গেলেন। আমার কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। মায়ের পিছু পিছু রওয়ানা হলাম। মা প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, যাবই। এক সময় রেগে গেলেন মা। আমাকে ধরার জন্য এগিয়ে এলেন। আমি বুঝলাম, মা আমাকে চড় দিতে পারেন। পিছন দিকে ঘুরে দৌড় দিলাম। মা আমাকে ধরতে পারলেন না।
রাস্তার দিকে রওয়ানা হয়েছেন মা। আমি আবারও পিছু নিলাম। মা বিরক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। আমিও দাঁড়ালাম। মা ঘুরলেন আমার দিকে। ডাকলেন, আয়।
আমি গেলাম না। ভয়, মার খাওয়ার। মা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি আবারও ঘুরে দৌড়।
মা রিক্সায় উঠছেন। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি আর কাঁদছি। মা রিক্সায় ওঠার আগে আমার দিকে তাকালেন এক পলক। আমি থমকে দাঁড়ালাম। রিক্সা ছেড়ে দিল। আমরা কান্নার দমক বেড়ে গেল। এবার দৌড় শুরু করলাম, রিক্সার সাথে পাল্লা দিয়ে। মা রিক্সা থামালেন। বললেন, আয়।
আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। ভয়, মার খাব না তো। মা আবারও ডাকলেন, আয়।
অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে কাছে গেলাম। মা আমাকে রিক্সায় উঠিয়ে নিলেন। আমার কান্না থেমে গেল। মনে হল আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই।

০২) রিক্সায় যাচ্ছি মায়ের সাথে। পাশে বসা আমি। কিশোর বয়স। একটা জায়গায় এসে রাস্তা সরু। পাশে পুকুর। রিক্সা সাইড কাটাতে গিয়ে সোজা পুকুরে পড়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বুঝি নি, আসলে কী ঘটেছে। কেবল দেখলাম, আমি পানিতে পড়ে আছি। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম, আমাকে শক্ত করে ধরে আছেন মা। তিনি প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিলেন, কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু আমাকে ছাড়েন নি। আমাকে টেনে ওঠালেন পাড়ে। পরে জানলাম, মার হাত ভেঙ্গে গেছে।

০৩) স্কুলে যাওয়ার সময় একটি ছোট বক্সে টিফিন সাজানো থাকত। পরোটা বা রুটির সাথে কখনও আলু ভাজি, কখনও ডিম ভাজা, কখনও হালুয়া। আর ছিল তিন টাকা রিক্সা ভাড়া। যেতে দেড় টাকা, আসতে দেড় টাকা। আমার মায়ের ধারণা ছিল স্কুলের বাচ্চাদের হাতে বেশি টাকা দিলে তারা ফাজিল হয়ে যায়। এখনও কোন বাচ্চার টিফিন বক্স দেখলে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, আমার সেই সুন্দর দিনগুলি কোথায় গেল ?

০৪) পরীক্ষার আগে বেশি আদর যত্নে হাপিয়ে উঠতাম। আমি দুধ খেতে পছন্দ করতাম না। তবু রাতের বেলা ১ গ্লাস গরম দুধ খেতেই হত। আমার অনীহার কারণে গ্লাসের দুধ হত অর্ধেক। কিন্তু পরীক্ষা এলে দুধের গ্লাস উপচে পড়ত। সেটা কি শুধু ছিল দুধের গ্লাস ? মায়ের স্নেহ কি মেশানো ছিল না ? এ জন্যই হয়তো পরীক্ষাগুলো ভালো হত।

০৫) মা প্রায়ই পিছল খেয়ে পড়ে যেতেন। কখনও উঠোনে, কখনও পুকুর ঘাটে, কখনও গোছলখানায়। মা বলতেন, তাঁর পায়ের আঙ্গুল নাকি খাটো। তাই তাল সামলাতে পারেন না।
প্রথম বয়সে এসব পড়ায় তার সমস্যা হয়নি। কিন্তু একটু বেশি বয়সে তার সমস্যা হল। আমার বিয়ের কথা যখন চলছিল, তখন মা নানু বাড়িতে গিয়ে টিউবওয়েলের সামনে পিছল খেয়ে পড়ে গেলেন। তার কোমরে ভয়াবহ চোট লাগল। মেরুদণ্ডে সামান্য চিড় ধরল।
মায়ের মনে হল, তিনি বাঁচবেন না। মরার আগে তার ছেলের বউ দেখে যেতে চান। তাই আমার বিয়ে তড়িঘড়ি করে হল। মা তার ছেলের বউয়ের মুখ দেখে মন জুড়ালেন। হয়তো ছেলের বউয়ের মুখ দেখেই সেবার তিনি সেরে উঠলেন।

০৬) ডায়াবেটিক তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তিনি টের পান নি। যখন টের পান তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবু সেটা সামাল দেয়া যেত। তার ধাত ছিল না নিজের প্রতি খেয়াল করার। এমনকি ডায়াবেটিক রোগটাকেও বুঝতে চান নি। খাবার দাবারে সতর্ক ছিলেন না। বলতেন, মারা তো একদিন যেতেই হবে।
অবশেষে ডায়াবেটিক অনিয়ন্ত্রিত হল। ডাক্তারের বকাবাজিতেও কাজ হল না। তার প্রিয় ছিল দুধ ও কলা। তিনি দুধভাতে কলা দিয়ে মেখে খেতে পছন্দ করতেন। ডায়াবেটিকের জন্য এই খাবারে তার অরুচি হয়নি।
একদিন হঠাৎ তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আপাতত মনে হল কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এক্সরে করে জানা গেল পায়ের জয়েন্টের হাড়ে চিড় ধরেছে। অপারেশন করা দরকার। তার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক ও বয়সের কারণে ডাক্তাররা অপারেশন করার ভরসা পাচ্ছেন না। অন্য দিকে সিটি স্ক্যান করে ধরা পড়ল, তিনি একটি ছোট স্ট্রোক করেছেন। তাতে ব্রেনের একটি অংশে রক্ত জমে আছে। এই স্ট্রোক করাতেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
এ ঘটনার মাস তিনেক পরে তিনি দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করলেন। তাড়াহুড়ো করে বারডেমে নেয়া হল। ডাক্তাররা তার হাল ছেড়ে দিল। বলল, কিছু করার নাই।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আর হাঁটতে পারেননি। একটি হাসপাতালের বেড ও এয়ার বেড কেনা হয়েছিল তার জন্য। সারাক্ষণ শুয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে বিরক্ত হলে আমার বড় ভাইয়ের নাম ধরে সুর করে ডাকতেন। আমার নাম ধরেও ডাকতেন কখনও কখনও। কাছে গেলে এমন একটা হাসি দিতেন দেখে মন ভরে যেত। কেবল জিজ্ঞেস করতেন, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করি কি না।
মায়ের ডায়াবেটিক আর নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কয়েকবার বারডেমে ভর্তি করিয়েও কাজ হয়নি। অবশেষে গত বছরের আগষ্টে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হল। বারডেমের ডাক্তার শেষবারের মতো তাকে ছেড়ে দিলেন। মা সারা দিন কোন কথা বলতেন না, খেতেন এবং ঘুমাতেন। মাঝে মাঝে তার চেতনা ফিরে এলে আমাদের ভাইদের নাম ধরে ডাকতেন। করুণ সেই ডাক শুনলে কান্না পেত।
মৃত্যুর ১ সপ্তাহ আগে থেকে তার বাহ্যজ্ঞান ছিল না। ডাকলে মাঝে মাঝে সাড়া দিতেন। অবশেষে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টায় মারা গেলেন আমার মা।

০৭) আমাদের ছোটকালে মা দিবস ছিল না। কিন্তু মা ছিল। এখন মা দিবস আছে, মা নেই। এই দিবস থাকুক বা না থাকুক এখনও কোন গভীর রাতে মায়ের মুখ মনে উঠলে চোখের কোণে জমে ওঠে অশ্রু । কত স্মৃতি - একের পর এক মনের আয়নায় ভেসে আসতেই থাকে। আর হঠাৎ করে মনে হয়, করুণ স্বরে মা আমার নাম ধরে ডাকছেন। এই ডাক আর কখনও শুনতে পাব না বলেই হয়তো এত প্রিয়।
চ্যানেল আইতে ছোটদের গানরাজ অনুষ্ঠানে - মা আমার আগে যেও না গো মরে - গানটি শুনে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছিল। আমরা সবাই চাই, আমাদের আগে যেন আমার মা মরে না যায়। কিন্তু জগতের বিধান বদলানোর সাধ্য আমাদের নাই। তাইতো আমাদের নিজের হাতে মায়ের কবরে মাটি দিতে হয়। এর চেয়ে দুঃখের আর কি থাকতে পারে ?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০০৯ দুপুর ২:২৯
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×