একটা সময় ছিল যখন দেখতাম দেশের কিছু নাম করা ব্যক্তি, যারা ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিক ছিলেন তারা মৃত্যুর পূর্বে বলে যেতেন তাঁর লাশের কোন জানাজা হবে না, তাঁর লাশ যেন কোন হাসপাতালে দান করে দেওয়া হয়। তাদের মৃত্যুর পর তাই কোন ঝামেলা হতো না; সুন্দর সর্বসাধারণের শদ্ধা জ্ঞ্যপনের পর লাশটা তাদের ইচ্ছা মত কোন হাসপাতালে দান করে দেওয়া হতো। মৃত্যুর পরও প্রচলিত রীতির বাইরে যাওয়ার এই সাহস তাদের ছিল, কারণ নিজ বিশ্বাসের উপর তাদের সেই আস্থা ছিল। তারা আজীবন যেমন নিজের যুক্তি-বুদ্ধির উপর ভরসা করতেন মৃত্যুর পরও যেন তার ব্যত্যয় না ঘটে সে ব্যাপারে তারা ব্যাবস্থা করে যেতেন। উনারা ছিলেন বেশি বুদ্ধি থাকার কারনে নাস্তিক!
ইদানিং কিছু নাস্তিক দেখা যায় যার অধিকংশ কম বুদ্ধির কারনে নাস্তিক। যারা নাস্তিকতাকে আধুনিক যুগের স্মারটনেস বা ফ্যাশন হিসাবে চিন্তা করে। এদের নিজস্ব কোন আদর্শ ধারন করার মত জ্ঞ্যন বুদ্ধি নেই, এরা নাস্তিকতা মানে বুঝে অন্য ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করা গালীগালাজ করা বা বিদ্রুপ করা। উজান রক্তের গরমে বা হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে নাস্তিক সাজে কিন্তু অনেকেরই মনের মধ্যে বাপ-দাদার ধর্ম নিয়ে একটা দুরু দুরু ভাব থেকে যায়; যার ফলে অনেকেই দেখা যায় বয়স ভাটির দিকে যাওয়ার সাথে সাথে দাড়ি রেখে টুপি পরে বিরাট হুজুর হয়ে যায়।
সমস্যা হলো এই প্রজাতির নাস্তিকদের নিয়ে! এরা হঠাত করে মারা গেলে লাশ নিয়ে শুরু হয় টানাটানি- ধর্ম মতে তাদের জানাজা হবে, নাকি তাদের বিশ্বাসের উপর সম্মান দেখানো হবে।
আস্তিক হোন আর নাস্তিক হোন এটা নিশ্চয় সবাই স্বীকার করেন যে মৃত্যুর কোন টাইম টেবিল নাই! যে কোন মুহূর্তে তা আসতে পারে। আর আমাদের মত দেশে তো সেটা আরো অনিশ্চিত! স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নাই। যে কোন মুহূর্তে ঠুস হয়ে যেতে পারে যে কেও! সব লাফালাফি শেষ! আস্তিকদের লাশ নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ যে যত বড় আস্তিকই হোক না কেন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে সে তার বিশ্বাসের মর্যাদা পূর্ণ মাত্রায় দিতে পেরেছে। তাই সে মৃত্যুর পরও আশা করে যেন তার পক্ষ হয়ে তার স্বজনেরা যেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
কিন্তু সমস্যা হলো এই নব্য নাস্তিকদের নিয়ে। সমস্যাটা যে কতটা ভয়াবহ তা সম্প্রতি রাজীব এর ঘটনা থেকে বুঝা গেছে। বেচারা মরে গিয়েও শান্তি পেল না! একদল বিরাট আয়োজন করে তার জানাজা করতে চায়, আরেক দল কয় মুনাফিকের জানাজা হবে না। দুই দলের কারো যুক্তি-ই ফেলনা নয়! প্রথম পক্ষের মতে, ধর্ম নিয়ে সে যত বাজে কথায় বলুক না কেন সে যেহেতু মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়েছে তাই সামাজিক কারনে তার জানাজা হবে। তাছাড়া এখানে একটা শোডাউনের ব্যাপারও নিহিত আছে, তাই ব্যাপক লোক সমাগমের জন্য তারা তাদাজল খেয়ে লাগলেন। আরেক পক্ষের মতে, সে ছিল চুড়ান্ত ধরনের নাস্তিক। সে শুধু তার ধর্মকে অবিশ্বাসই করেনি; সেই ধর্মের প্রচারক, মোহাম্মদ (সঃ) কে নিয়ে অসংখ্য আজে বাজে কথা বলে গেছেন; মূলত এটাই ছিল তার ব্লগ লেখার মূল বিষয়! তাই তার জানাজা রসূলের নির্দেশিত পথে হতে পারে না। অনেকে বলছেন এটা করলে তার আদর্শের প্রতি অসম্মান করা হবে। (এর বাইরে আর কিছু মানুষ অবশ্য আছে, যারা বিভিন্ন ভাবে প্রমান করার চেষ্টা করছেন যে রাজিবের নামে যে সব লেখা প্রচার করা হচ্ছে তা আসলে রাজীবের না; তারা রাজীবের লেখা গুলো বিভিন্ন ভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন। তাদের আসলে আমি কোন গুরুপে ফেলতে চাই না, তারা হিপোক্রেট! তাদের এই হিপোক্রেসী দেখে রাজীব বেচে থাকলেও নিশ্চয় বিরক্ত হতো!)
একবার মৃত রাজিবের কথা চিন্তা করে দেখেন! যদি মৃত্যুর পর সে বুঝতে পারে যে, সে যেটা বিশ্বাস করত সেটা মিথ্যা আসলেই মৃত্যুর পরে আরেক জীবন আছে, সেখানে তার বিচার হবে। তখন সে নিশ্চয় অনুতপ্ত হয়েছে এবং সারাজীবন যাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে তাদের কে অনুরোধ করে বলছে, ভাই তোরা আমার পক্ষে একটু আল্লাহর কাছে মোনাজাত কর! আমি না বুঝে তার রসূলের সাথে যে বেয়াদবী করেছি সেটা যেন তিনি মাফ করে দেন! আর মৃত্যুর পরে সে যদি দেখে যে, জীবনে যেটা সে বুঝত আসলে সেটাই ঠিক! দোজখ বেহেস্ত বলে কিছু নেই, সব হুজুরদের ভোগাস! মৃত্যুর পরে সেই আসলে বেশী সম্মানিত যার মৃত্যু যত বেশী বিতর্কিত; সেই বড় নেতা যার লাশ নিয়ে বিশাল মিছিল হয়; তার সম্মান বেশী যার কাফিনে যত বেশী ফুল পড়ে বা শহীদ বলে যার নামে রাস্তার নামকরন হয় বা প্রধানমন্ত্রী শদ্ধা জানাতে বাড়ীতে যায় বা যার লাশ ছুঁয়ে কমরেডরা শফত করে বদলা নেওয়ার ইত্যাদি! তাহলে রাজীবের আত্মা নিশ্চয় চিৎকার করে বলছে, ওরে তোরা থাম! আমার জানাজা পড়াস না! আমার সারাজীবনের আদর্শ কে তোরা অসম্মান করিস না! ওসব জানাজা টানাজার কোন দরকার নেই। তার চেয়ে আমার লাশ নিয়ে যত দিন পারিস শহীদমিনারে রাইখ্যা দে, আমার কাফিনে ফুল দিয়ে ঢাইকা দে, আমার লাশ নিয়ে মিছিল কর ইত্যাদি ইত্যাদি ...!
প্রকৃতপক্ষে রাজিব কি বলছে আমরা কেও তার কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
একজন মৃত মানুষের জানাজা হবে কি হবে না এই বিব্রতকর বিতর্কে আর যেতে চায় না। ধর্মে যা-ই থাকুক, আমাদের একটা সুন্দর সামাজিক কালচার হচ্ছে, জীবিত অবস্থায় যত শত্রুই হোক না কেন মৃত্যুর পরে সব ভুলে গিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করা। আমরা আমাদের এই সুন্দর কালচারটাকে ধরে রাখতে চাই।
তাই নাস্তিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে এখনি ডিক্লিয়ার করে যান আপনার মৃত্যুর পরে আপনার জানাজা হবে, কি হবে না!