সাবের মিয়া চোখ খুলতেই দেখতে পেল অন্ধকার এক ঘরে বসে আছে সে । মাথার উপর ছোট্ট একটা লাইট বাল্ব। হাত পা চেয়ারের সাথে বাঁধা । অন্ধকারের কারনে ঘরের মধ্যে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না, আলোটুকু তার উপরেই আছে শুধু। সাবের মিয়া বুঝে উঠলো না এইভাবে সে কেন বসে আছে। কিছুক্ষণ পর মনে আসলো সব ঘটনা, রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল, পিছনে গাড়ির শব্দ, তারপর নিজেকে এই ভাবে পাওয়া।
সাবের মিয়ার একটা ভাল অভ্যাস নিয়মিত পেপার পত্রিকা পড়া। তার দরুন বুঝতে অসুবিধা হলনা তাকে গুম করা হয়েছে। কিন্তু তার যে অবস্থা তাঁকে গুম করার প্রশ্ন আসে না। আচ্ছা তার সাথে যা ঘটেছে তাকে কি গুম বলা চলে নাকি অপহরণ? গুম আর অপহরণ এর মধ্যে পার্থক্য কতটুকু? এই চিন্তা করতে করতে মোটা গলার স্বর টা কানে আসলো
- কি চেয়ারম্যান সাবের মিয়া? কি অবস্থা?
- স্যার আছি কোনরকম। তবে স্যার চেয়ারম্যান ডাকেন কেন? চেয়ারে বসা তাই?
- বাহ আপনার তেল তো দেখছি ভালই, রঙ্গ করেন আমাদের সাথে?
- স্যার আমি গরীব মানুষ রঙ্গ করব কেমন করে?
- আপনি চেয়ারম্যান সাবের না?
- স্যার আমি সাবের মিয়া, চেয়ারম্যান তো দূরের কথা কোন কমিটির সদস্য আজ পর্যন্ত হতে পারিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আরেকজনের কণ্ঠ শুনতে পেল সাবের মিয়া, “ বস মিস্টেক হয়ে গেছে, ভুল লোক কে ধরে আনছি আমরা”। বসের কণ্ঠ থেকে জঘন্য ভাষায় একটা গালি শুনতে পেল। সাবের মিয়া বুঝলো তাকে ভুল করে তুলে আনা হয়েছে। বেচারা লোকটা তার জন্য বসের কাছে গালিগালাজ শুনলো । কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো সবাই।
- সাবের মিয়া, ৫০ লক্ষ টাকা দিতে পারবে আপনার ফ্যামিলি?
- স্যার ফ্যামিলি বলতে কেউ নেই, সামান্য চাকুরে, কোন মেয়ে আজ পর্যন্ত বিয়ে করতে চায়নি।
- বাপ মা নাই?
- স্যার তাঁরা এ পৃথিবীর মায়া কেটে চলে গেছেন।
- ধুর মিয়া অত কথা বলেন কেন? ৫০ লক্ষ দিতে পারবেন?
- স্যার, ইয়ে মানে ৫০ এর পর কটা শূন্য হয় স্যার, এটা জানলে বলতে পারতাম পারবো কিনা!
- চুপ কর ফকিরের বাচ্চা!
বসের মুখে ফকির শুনে সাবের মিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। আসলেই গরীব বলে গুমকারীরাও আজ তাকে তাচ্ছিল্য করছে। কিছুক্ষণ আরেকজনের কণ্ঠ শুনতে পেল, “বস পুরাই অচল মাল তুলে আনছি, মাফ কইরা দেন, বলি কি কাইটা ভাসায় দেয় পানিতে। দু একটা লাশ ভাসলে লোকে ভয়ে ভয়ে থাকবে , বিজনেস ভালা চলবে ফিউচারে”।
নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো সাবের মিয়া। আর রক্ষা নাই। সারাজীবন লাথি গুঁতা খেয়ে মানুষ। শেষ পর্যন্ত এই ছিল কপালে। ওর লাশ নদীতে ভাসলে কি আর না ভাসলে কি। দুই একটা পেপার পত্রিকায় ছবি আসবে। কেউ কেউ হয়ত চিনতে পারবে। দুদিন পর লোকে ভুলে যাবে। বড় বড় লোক রক্ষা পাচ্ছে না, আর সে তো কোন ছাড়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সাবের মিয়া ভাবলো মরতে যখন হবে তখন একটা বুদ্ধি খাটাই। বসের সাথে একটু কথা বলি। আর স্যার বলা যাবে না তাকে, বস বলেই ডাকি। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না তবে তিনি আছেন মনে হয়।
- বস আছেন, ও বস?
- কিরে সাবেরের বাচ্চা কি বলিস?
- বস আমাকে মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারবেন না।
- কি বলতে চাস
- বস আমি সাধারন পাবলিক। কেউ চিনে না, নদী হোক আর সমুদ্র লাশ ভাসলে কেউ গোনায় ধরবে না
- তাই নাকি? তুই যেই হস হইচই তো হবেই, চিন্তা নিস না।
- বস তাতেও সমস্যা
- কি সমস্যা?
- বস হইচই হলে নাম ও প্রকাশ হবে। তখন আসল সাবের চেয়ারম্যান কিন্তু সতর্ক হয়ে যাবে। আপনাদের প্রজেক্ট কিন্তু কঠিন হবে তখন।
- আমাদের প্রতি তোর এত দরদ?
- বস, কোনদিন তো কারো উপকারে আসেনি, মরার আগে যদি আপনাদের কিছু উপকারে আসি।
- আচ্ছা
সাবের মিয়া আর কথা বাড়াতে পারলো না। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকলো। তারপরে সাবের মিয়া মাথায় কিসের যেন বারি পরল। অজ্ঞান হতে বেশি সময় নিল না সে।
সাবের মিয়া চোখ খুলে দেখে, চারিদিকে আলো। মৃত্যুর পর তাহলে এত আলো আসে চারপাশে এই ভাবতে থাকলো সাবের মিয়া, কিন্তু গাড়ির শব্দ কানে আসে কেন? ধরমর করে উঠে দেখে রাস্তার পাশে এক মাঠে পরে আছে সে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো গুমকারিরা তার কিছুই করেনি, ছেড়ে দিয়েছে। তারাও বুঝতে পেরেছে সাবের মিয়া একটা অচল মানুষ, তাকে দিয়ে কিছুই হবে না।