[উৎসর্গ : প্রিয় ব্লগার কৌশিককে, যার প্রতিটি লেখা আমাকে আনন্দ দেয়।]
'এই মাতোয়ালা রাইত' শিরোনামে আশ্চর্য-অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান; পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দার মুখ দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন জীবনের এক অসামান্য ব্যাখ্যা।
পুরনো ঢাকার মানুষগুলো যখন সাহিত্যে উঠে আসে তখন এমনিতেই খুব কালারফুল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তাদের ভাষার কারণে। আখতারুজ্জমান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসে আমরা এমন অনেক কালারফুল চরিত্রের দেখা পেয়েছি। কিন্তু কবিতায়? আমার জানা মতে রাহমানের এই কবিতাটিই একমাত্র।
কবিতাটি শুরু হয় খুব হালকা চালে, এক আপাদমস্তক নেশাখোরের জবানিতে-
'হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও'
বোঝা যায়, নেশাখোর এই লোকটি নিশিখোরও বটে- ' রাইতের লগে দোস্তি আমার পুরানা' ; আর রাতের কী আশ্চর্য বর্ণনা দিচ্ছে সে, দেখুন-'কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা রাইতের তামাম গতরে!' রাতের শরীরে 'কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান'! কী অসাধারণ উপমা!
কবিতা আরো কিছুদূর এগোয় হালকা চালেই-
'আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথথি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।'
মনে হচ্ছে, যেন এক রাজা সে, এই রাতের শহরে। কেউ সামনে দাঁড়ালে 'হোগায় লাথথি ' খাবে, অথবা 'চটকানা গালে।' কিন্তু এখানেই থামছে না সে, নিজের পরিচয় দিচ্ছে এইভাবে-
'আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, 'তুমি
ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।'
অর্থাৎ, আমাদের যা যা পরিচয় হতে পারে তার সবই ধরা হলো এই পঙক্তিগুচ্ছে- কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো বা প্রেমিক। এমনকি পেশাগত পরিচয়েও তো পরিচিত হই আমরা! কিন্তু এগুলো কি সত্যিকার অর্থেই আমাদের 'পরিচয়' তুলে ধরতে পারে? পারে না। আর তাই, কবিতাটিও এতক্ষণের হালকা চাল ছেড়ে এবার প্রবেশ করে এক গভীর দার্শনিক জগতে-
'আমার গলায় কার গীত হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোনহানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার, আশক
জমাদার লেইন, বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।'
নিজের গলায়ই সে যেন অন্য কারো 'গীত' শোনে 'ঠাণ্ডা' অশ্রুভরা! এবং প্রশ্ন করে - কে আমি, কোত্থেকে এসেছি এই 'দাগাবাজ দুনিয়ায়?' শেষ পর্যন্ত কোথাযই বা যাবো? যেখানেই যাক, সে তো সে-ই একই মানুষ- 'গোলগাল মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ'! এবং নিজেকে তার মনে হচ্ছে- খুব দূর অতীতের 'আধলি একখান!'
মানুষের অস্তিত্ব-অনুসন্ধানের জন্য প্রাচীন সব প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে একই তালে কবিতা এগোয়, এবং আমাদেরকে উপস্থিত করে আরো গভীর-গভীরতর প্রশ্নের মুখোমুখি-
'আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।'
নিজেকেই নিজের কাছে অচেনা লাগে! এমনকি নিজের হাতের তালুও 'বেগানা' লাগে; নিজের 'কইলজাখান'ও যেন অন্য কারোর, নিজের শরীরে এসে 'ফাল পাড়ে!' আর রাতে নিজেকেও বড় 'ডর লাগে', মনে হয় মাটির ভেতর থেকে সে উঠে এসেছে বহুকাল পর!
কবিতা থামে না, এবার তার চোখে পড়ে এক শবযাত্রা। পুরনো ঢাকার স্বভাবজাত কৌতুকপূর্ণ ভাষায় তার বর্ণনাও দেয় সে, আর মনে হয়-'আজরাইল আইলে' তাকেও অন্ধকার কবরে 'হান্দাতে' হবে! এবং মনে হয় এ-ও যে, মৃত্যু এক নিত্য সহচরের মতোই সত্য আর কাছের-
'এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।'
কিন্তু মৃত্যু তো আসলে আমাদেরকে জীবনের পক্ষেই দাঁড় করিয়ে দেয়! আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়- আমরা বেঁচে আছি; বেঁচে থাকা কী সুন্দর, কী অসাধারণ! সে-ও এবার তা-ই ভাবছে, এবং বেঁচে থাকার গৌরবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে! -
'এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই।'
হ্যাঁ, বেঁচে আছি বলেই তো এখনো ফুলের সুবাস নাকে আসে, চাঁদনি রাত 'দিলে ঝিলিক মারে', আর জীবনের নানা আয়োজনের মধ্যে ফিরে ফিরে যাই- নারী, সুর ও সুরার কাছে! আর তাই- 'মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই!' কী অসাধারণ লাইন!
কিন্তু এখানে এসেও কবিতাটি থামে না। আত্ন-অনুসন্ধানের পরিক্রমা শেষে কোনো প্রশ্নের ঠিকঠাক না পেয়েও যখন সে জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়, বেঁচে থাকার আনন্দে মুখর হয়, তখন আবার ফিরে আসে সেই ভাবনা! অস্তিত্বের অর্থ কি?-
'তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!'
সবই স্বপ্ন তাহলে? এমনকি এই আমিও? আমার অস্তিত্বও?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:১৭