somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'আসলে কেউগা আমি? কোনহানতে আইছি হালায় দাগাবাজ দুনিয়ায়?'

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[উৎসর্গ : প্রিয় ব্লগার কৌশিককে, যার প্রতিটি লেখা আমাকে আনন্দ দেয়।]

'এই মাতোয়ালা রাইত' শিরোনামে আশ্চর্য-অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান; পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দার মুখ দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন জীবনের এক অসামান্য ব্যাখ্যা।

পুরনো ঢাকার মানুষগুলো যখন সাহিত্যে উঠে আসে তখন এমনিতেই খুব কালারফুল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তাদের ভাষার কারণে। আখতারুজ্জমান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসে আমরা এমন অনেক কালারফুল চরিত্রের দেখা পেয়েছি। কিন্তু কবিতায়? আমার জানা মতে রাহমানের এই কবিতাটিই একমাত্র।

কবিতাটি শুরু হয় খুব হালকা চালে, এক আপাদমস্তক নেশাখোরের জবানিতে-

'হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও'

বোঝা যায়, নেশাখোর এই লোকটি নিশিখোরও বটে- ' রাইতের লগে দোস্তি আমার পুরানা' ; আর রাতের কী আশ্চর্য বর্ণনা দিচ্ছে সে, দেখুন-'কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা রাইতের তামাম গতরে!' রাতের শরীরে 'কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান'! কী অসাধারণ উপমা!

কবিতা আরো কিছুদূর এগোয় হালকা চালেই-

'আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথথি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।'

মনে হচ্ছে, যেন এক রাজা সে, এই রাতের শহরে। কেউ সামনে দাঁড়ালে 'হোগায় লাথথি ' খাবে, অথবা 'চটকানা গালে।' কিন্তু এখানেই থামছে না সে, নিজের পরিচয় দিচ্ছে এইভাবে-

'আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, 'তুমি
ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।'

অর্থাৎ, আমাদের যা যা পরিচয় হতে পারে তার সবই ধরা হলো এই পঙক্তিগুচ্ছে- কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো বা প্রেমিক। এমনকি পেশাগত পরিচয়েও তো পরিচিত হই আমরা! কিন্তু এগুলো কি সত্যিকার অর্থেই আমাদের 'পরিচয়' তুলে ধরতে পারে? পারে না। আর তাই, কবিতাটিও এতক্ষণের হালকা চাল ছেড়ে এবার প্রবেশ করে এক গভীর দার্শনিক জগতে-

'আমার গলায় কার গীত হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোনহানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার, আশক
জমাদার লেইন, বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।'

নিজের গলায়ই সে যেন অন্য কারো 'গীত' শোনে 'ঠাণ্ডা' অশ্রুভরা! এবং প্রশ্ন করে - কে আমি, কোত্থেকে এসেছি এই 'দাগাবাজ দুনিয়ায়?' শেষ পর্যন্ত কোথাযই বা যাবো? যেখানেই যাক, সে তো সে-ই একই মানুষ- 'গোলগাল মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ'! এবং নিজেকে তার মনে হচ্ছে- খুব দূর অতীতের 'আধলি একখান!'

মানুষের অস্তিত্ব-অনুসন্ধানের জন্য প্রাচীন সব প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে একই তালে কবিতা এগোয়, এবং আমাদেরকে উপস্থিত করে আরো গভীর-গভীরতর প্রশ্নের মুখোমুখি-

'আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।'

নিজেকেই নিজের কাছে অচেনা লাগে! এমনকি নিজের হাতের তালুও 'বেগানা' লাগে; নিজের 'কইলজাখান'ও যেন অন্য কারোর, নিজের শরীরে এসে 'ফাল পাড়ে!' আর রাতে নিজেকেও বড় 'ডর লাগে', মনে হয় মাটির ভেতর থেকে সে উঠে এসেছে বহুকাল পর!

কবিতা থামে না, এবার তার চোখে পড়ে এক শবযাত্রা। পুরনো ঢাকার স্বভাবজাত কৌতুকপূর্ণ ভাষায় তার বর্ণনাও দেয় সে, আর মনে হয়-'আজরাইল আইলে' তাকেও অন্ধকার কবরে 'হান্দাতে' হবে! এবং মনে হয় এ-ও যে, মৃত্যু এক নিত্য সহচরের মতোই সত্য আর কাছের-

'এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।'

কিন্তু মৃত্যু তো আসলে আমাদেরকে জীবনের পক্ষেই দাঁড় করিয়ে দেয়! আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়- আমরা বেঁচে আছি; বেঁচে থাকা কী সুন্দর, কী অসাধারণ! সে-ও এবার তা-ই ভাবছে, এবং বেঁচে থাকার গৌরবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে! -

'এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই।'

হ্যাঁ, বেঁচে আছি বলেই তো এখনো ফুলের সুবাস নাকে আসে, চাঁদনি রাত 'দিলে ঝিলিক মারে', আর জীবনের নানা আয়োজনের মধ্যে ফিরে ফিরে যাই- নারী, সুর ও সুরার কাছে! আর তাই- 'মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই!' কী অসাধারণ লাইন!

কিন্তু এখানে এসেও কবিতাটি থামে না। আত্ন-অনুসন্ধানের পরিক্রমা শেষে কোনো প্রশ্নের ঠিকঠাক না পেয়েও যখন সে জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়, বেঁচে থাকার আনন্দে মুখর হয়, তখন আবার ফিরে আসে সেই ভাবনা! অস্তিত্বের অর্থ কি?-

'তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!'

সবই স্বপ্ন তাহলে? এমনকি এই আমিও? আমার অস্তিত্বও?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:১৭
৩৬টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×