ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম
(পরম দয়ালু, করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। আমরা তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি । অন্তরের অনিষ্ট (কুমন্ত্রণা) এবং মন্দ আমল হতে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যাকে আল্লাহ হিদায়েত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর যে গোমরাহ হয়ে যায় তাকে কেউ হিদায়েত দিতে পারে না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো মাবুদ নেই এবং তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।
পূর্ব যুগে মানুষের দু:খ-দুর্দশা বিশেষত: মুসলমানদের কষ্ট-মুসিবত, যুদ্ধ-ফেতনা ইত্যাদির কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তাওহিদ সম্পর্কে জ্ঞানের অপ্রতুলতা, উদাসীনতা ও নানা শিরকি কাজে জড়িয়ে পড়াই ছিল এর মূল কারণ। শিরকমুক্ত তাওহিদের চর্চ-অনুশীলন না থাকার সুযোগটি শয়তান গ্রহণ করেছে । এবং তাদের বিভ্রান্ত করে বিভিন্ন বিপদে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাই আমরা এ ছোট্ট বইটিতে তাওহিদ, শিরকসহ ইসলামের বেশ কিছু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্ট করেছি। এবং বইয়ের মাধ্যমেই বিশ্বের সকল ইসলাম অনুসারীকে যাবতীয় শিরকি কর্মকাণ্ড হতে বিরত থেকে খালেছ তাওহিদের ছায়াতলে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। পাঠকের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি বিষয় সংক্ষেপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি যাতে তারা বিষয়গুলো সহজে বুঝতে পারে।
এটি রচনার মাধ্যমে আমরা -মুক্তি প্রাপ্ত দলের আক্বিদাহ ও সাহায্যপ্রাপ্ত দলের রাস্তা- খোঁজার চেষ্টা করেছি যাতে ঐ রাস্তায় চলে জয়যুক্ত ও কামিয়াব হতে পারি।
মহান আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে নাযাতপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভূক্ত করে নাও।
শায়খ মুহাম্মাদ বিন জামীল যাইনু
শিক্ষক, দারুল হাদিস
মক্কা,সৌদি আরব।
জয়যুক্ত দল
১। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا (آل عمران ১০৩)
অর্থাৎ : আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান, ৩: ১০৩ আয়াত)।
২। অন্যত্র বলেন :
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿৩১﴾ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ﴿الروم৩২﴾
অর্থাৎ : তোমরা ঐ মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না, যারা দ্বীনকে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে এবং যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা ছিল তাই নিয়েই খুশি। (সূরা রূম, ৩০: ৩১ ও ৩২ আয়াত)।
৩। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
وَقَالَ صلى اللّه عليه وسلَّمَ: أٌوْصِيْكُمْ بتَقْوَى اللَّه عَزَّ وَجَلَّ وَالسًّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإنْ تأمَّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌ فَإنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرى اخْتِلافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلفَاءِ الرَّاشِدينَ الْمَهْديِّينَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَ عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَاِيَّاكُمْ وَ مُحْدَثاتِ الأمُوْرِ فَإنَّ كُلَّ مُحْدَثةٍ بِدْعَةٌ وَ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ وَ كُلُّ ضَلالَةٍ فِى النَّارِ (رواه أبو داود وغيره)
অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহকে ভয় করার, শোনা ও মান্য করার, যদিও তোমাদের আমীর হয় কোনো হাবশি দাস। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে নানা মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের করণীয় হবে, আমার সুন্নত এবং হেদায়েত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নতকে নিজেদের উপর অপরিহার্য করে নেওয়া। সেসব সুন্নতকে মুজবুতভাবে, চোয়ালের দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার ন্যায় আঁকড়ে ধরবে । দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো আমল সংযোজনের ব্যাপারে খুবই সাবধান থাকবে; নিশ্চয়ই সমস্ত নতুন আমলই বিদআত এবং সমস্ত বিদআতই গোমরাহী এবং সমস্ত গোমরাহি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে)। (আবু দাউদ এবং অন্যান্য, ছহীহ)।
৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ
وَقَالَ صلى اللّه عليه وسلَّمَ: ألاَ وَإنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوْا عَلى ثِنْتَيْنِ وَسِبْعِيْنَ مِلَّةً وَإنَّ هذهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ على ثَلاثٍ وَسَبْعيْنَ: ثِنْتَانِ وَسَبْعِوْنَ فى النَّارِ وَوَحِدَةً فى الْجَنَّةِ وهِىَ الْجَمَاعَةُ. (رواه أحمد وغيره وحسنه الحافظ))
অর্থাৎ: ওহে! তোমাদের পূর্বে আগত আহলে কিতাব (ইহুদি ও নাসারা)-রা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল এবং এ উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। ৭২ দল যাবে জাহান্নামে এবং একটি মাত্র দল প্রবেশ করবে জান্নাতে। তারাই হল (আহলে সুন্নাত ওয়াল) জামাআত। (আহমদ, হাসান)।
অন্য হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
كُلُّهُمْ فى النَّارِ إلاَّ مِلّةٌ واحِدَةٌ ما أنا عَلَيْهِ وَأصْحَابيْ (الترمذي حسن)
আর্থাৎ,একমাত্র আমি এবং আমার সাহাবিদের মতের অনুসারী দল ব্যতীত সকলেই জাহান্নামে যাবে। (তিরমিযি, হাসান)।
৫। ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিতঃ
خَطَّ لَنَا رَسُوْل الله صلى اللّه عليه وسلَّمَ خَطًّا بِيَدِهِ ثُمَّ قَالَ: هذا سَبِيْلُ الله مُسْتَقِيْمًا. وَ خَطّ خُطُوْطًا عَنْ يَمِيْنِهِ وَ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ: هذه السُّبُلُ لَيْسَ مِنْها سَبِيْلٌ إلا عَلَيْهِ شَيْطَانٌ يَدْعُوا إلَيْهِ ثُمَّ قَرَأَ قَولهُ تَعَالى: (وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ) ﴿الانعام১৫৩﴾(رواه أحمد والنسائي صحيح)
অর্থাৎ : আমাদের জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দাগ টানলেন। তারপর বললেন: এটা আল্লাহর সোজা (সঠিক) রাস্তা। তারপর তার ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন। তারপর বললেনঃ এ রাস্তাগুলোর সবকটিতে শয়তান বসে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে। এরপর কুরআন থেকে পাঠ করলেন: আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (আহমদ, নাসাঈ, হাকেম। সহিহ)।
৬। আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ তাঁর গুনিয়াতুততালেবীন গ্রন্থে বলেছেন : জয়জুক্ত দল হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং তাঁদের একমাত্র নাম হল আসহাবুল হাদিস বা হাদিসের অনুসারী। অর্থাৎ যারা হাদিস ও কুরআন মত চলে।
৭। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হুকুম করছেনঃ আমরা যেন সকলে কুরআনকে আঁকড়ে ধরি এবং ঐ মুশরিকদের মত যেন না হই যারা তাদের দ্বীনের মধ্যে দলে দলে, গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়েছে। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানাচ্ছেন, ইহুদি ও খৃষ্টানরা বহু দলে বিভক্ত হয়েছে। আর মুসলিমরা তাদের থেকেও বেশী দলে বিভক্ত হবে। এই দলে দলে বিচ্ছিন্নতার কারণে তারা জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। তাদের এ বিভক্তির কারণ হচ্ছে সঠিক পথ হতে বিচ্যুতি, আল্লাহ তাআলার কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকা। তাদের একদল মুক্তি পেয়ে জয়জুক্ত হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাঁরাই সে দল যারা আল্লাহর কালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহিহ হাদিসকে আঁকড়ে ধরবে এবং সাহাবিদের রা. আমলসমূহ অনুসরণ করবে।