somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

অনুপম হাসান
শৈশব আর কৈশোর কেটেছে রংপুরে; আইএ পাসের পর কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল. ও পিএইচডি. ডিগ্রি লাভ। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত আছি।

মোস্তফা তারিকুল আহসানের ‘গল্প গল্প খেলা’ : কতিপয় বাস্তবতার মুখোমুখি

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোস্তফা তারিকুল আহসান (জ.১৯৭০) পেশাজীবনে অধ্যাপনা করলেও অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে সৃষ্টিশীল সাহিত্যচর্চা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন না। কবি স্বভাব তাঁর মজ্জাগত। কবি হিসেবে তিনি নব্বই পথচলা শুরু করলেও কখনোই নিজেকে ছোটগল্প ও প্রবন্ধচর্চা থেকে সরিয়ে রাখেন নি। তিনি কবিতা চর্চার পাশাপাশি গল্প লেখার অভ্যাসও অব্যাহত রেখেছেন। ‘গল্প গল্প খেলা’ (২০১০) তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এ গ্রন্থে মোট সাতটি গল্প আছে সমকালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। নীচের আলোচনায় গল্পগুলোর সদর-অন্দর পর্যবেক্ষণের প্রয়াস গ্রহণ করা হলো।

এক. নিরাপরাধ মৃত্যুদৃশ্য এবং...
‘গল্প গল্প খেলা’ গল্পের ঘটনা উত্তম পুরুষ বহুবচনে বর্ণনা করা হয়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে মাহাবুব ল্যাংটো সেলিমের কেসে জড়িয়ে পড়লে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন সে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছে র‌্যাবের নজরদারিতে তখন বাইরে অপেক্ষায় ছিল তার তিন বন্ধু মুর্তজা, টুনু এবং গল্পের কথক নিজে। এ গল্পের আখ্যানভাগ নির্মিত হয়েছে র‌্যাবের পরিচালিত কার্যক্রমের পোস্টমর্টেম করার মধ্য দিয়ে। র‌্যাবের আদ্যান্ত ইতিহাস এতে বর্ণিত হয় নি, তবে ভেতরে বাইরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন গল্পকার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে। যেমন :
আমরা জানি না র‌্যাব গঠনের সময়, যারা পোশাকের ডিজাইন করেছিলো তারা কেউ আমেরিকান মুভি দেখতো কিনা, কিংবা পোশাকের ওপর তার আমেরিকান ডিগ্রি আছে কিনা। তবে, আমরা নিশ্চিত হলিউড দেখে যেমন বলিউড নকল করে, তেমনি র‌্যাব নকল হয়েছে আমেরিকান মুভি দেখে। (পৃ.১২) র‌্যাব গঠন এবং এর পোশাক নির্বাচন প্রসঙ্গে গল্পের কথকের এই সুনিশ্চিত ধারণার মধ্যে প্রচ- হিউমার আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের নীতি নির্ধারক মহলের যে নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা নেই তারা যে সব সময়ই পরের অনুকরণ করে তা র‌্যাবের এই পোশাক নির্বাচনের ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্পকার ব্যঙ্গ করেছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনী গঠনের পর দেশে বিচার বহির্ভূত যে হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে হচ্ছে সন্ত্রাসীর নাম করে অনেক নিরাপরাধ মানুষকে রাজনৈতিক কারণে মেরে ফেলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তা মাহাবুবের বাবার কান্না বিজড়িত কণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছে :
[...] এই জন্যে কী দেশ স্বাধীন করেছিলাম, রাইফেলের গুলি খেয়েছি, নিরাপরাধ মানুষকে যেভাবে খুমি মেরে ফেলার জন্যই কি...। চাচা ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমরা মূর্খ, ফেল্টুস ছাত্র হলেও কেন যেন চাচার গভীর বেদনা বুঝতে পারি। একজন মুক্তিযোদ্ধার আকাক্সক্ষা স্বাধীন দেশে কিভাবে ধূলিস্যাৎ হচ্ছে বুঝতে পারি। (পৃ.১৪)অতঃপর মাঝ রাতে র‌্যাব বাহিনীর সাজানো নাট্যদৃশ্যের দর্শক হয় মাহাবুবের তিন বন্ধু। যারা বালকসুলভ হেসেখেলে জীবন কাটাতে চেয়েছিল। তারা নাট্যদৃশ্যে দেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের বন্ধু মাহাবুবকে এক নির্জন স্থানে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং গুলি করে হত্যা করার পরের দিন নিত্যকার মতো দৈনিকের হেডলাইন হয় ‘দুর্ধর্ষ মাহাবুব র‌্যাবের এনকাউন্টারে নিহত’। যেহেতু মাহাবুবের তিন বন্ধু তার হত্যাকা- স্বচক্ষে দেখেছিল সে কারণে ‘এনকাউন্টার’ শব্দের অর্থ তাদের কাছে আরো দুর্বোধ্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। অবশ্য তারা এতো কিছু ভাবার অবসর পায় না, তারা অবসন্ন ক্লান্ত দেহে ফুটপাতের ওপর বসে পড়ে। আর একজন মুক্তিযোদ্ধার নিরাপরাধ পুত্র এ দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্মম খুনের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের বাণী নিভৃতে অশ্রু বর্ষণ করলে বাংলা জননীর আকাশ বেদনায় আরো একবার ভারী হয়।

দুই. রাজনীতির পিচ্ছিল পথ...
‘চাঁদমারি’ গল্পের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটি যখন কলেজ জীবনে নানামুখি বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে গল্পে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি দলের সাথে জড়িয়ে পড়ার পর তার যে আত্মদহন ঘটে তা গল্পকারের ভাষায় নিম্নরূপ :
মা চেয়েছিলেন, আমি ভালো করে লেখাপড়া করবো। ডাক্তার হবো। সংসারে কোনো অভাব থাকবে না। বাবার মতো স্কুলের মাস্টার হয়ে যে কষ্টে জীবনটা গেছে সে রকম হবে না। মার আশা পূরণ হয়নি। আমি পাল্টে গেছি। (পৃ.২১)গল্পের এভাবে পরিবর্তিত জীবন বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে মূলত দেশের সমকালীন মেধাশূন্য যুবসমাজের হালহকিকত সম্পর্কে পাঠকদের জানিয়ে দেয়ার পর পাঠক আরো জানে তাদের চাঁদাবাজ দলের প্রধান হোতার রাজনৈতিক পেশায় যুক্ত হওয়ার ইতিবৃত্ত :
বাপটা বেঁচে থাকলে আমি এই রাজনীতিতে আসতাম না। পুরো সংসার তো আমি চালাই। চাকরি খুঁজলে কোনো শালা দিতো না। এদেশে এ সময়ে এর চেয়ে সহজ পথ আর নেই। (পৃ.২৩)
প্রথমত আমজাদ হচ্ছে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ সক্রিয় দলের নেতা; দ্বিতীয়ত পড়ালেখাটাও সে জানে না ভালো করে। যদিও তার বিএ পাসের সার্টিফিকেট আছে; কিন্তু তা সে পরীক্ষার হলে বই দেখে লিখে অর্জন করেছিল। অতএব আমজাদের কাছে ‘রাজনীতি’ হচ্ছে একটা পেশা জনসেবা তো নয়ই। যে পেশায় আমজাদ নিজেকে নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে তার সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পেরেছে নিশ্চিন্তে। ওপরোক্ত তথ্য সম্পর্কে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আমজাদের মতো মেধাহীন নেতানেত্রী হররোজ। অবশ্য গল্পকার গল্পের পরিণাম এঁকেছেন রোমান্টিকতায় ডুবে গিয়ে। আমজাদকে রাজনীতিতে গল্পকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেন নি। চাঁদাবাজির আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজিব গ্রুপের সাথে রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষে সে নিহত হয়। যদিও সেদিনের ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল না কথক তথাপি ঐ দলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আর পেছনে পড়ে থাকে নীতিবান শিক্ষক পিতার অবসন্ন দেহ এবং ব্যর্থ অশ্রুধারা। বড় ভাই কাঁদতে না পারলেও ছোটবোন সহেলী ধরে রাখতে পারে না চোখের জল-- সজোরে কাঁদে সে। কিন্তু আমজাদের মৃত্যু, রাজীব গ্রুপের চারজন নিহত এবং গল্প কথকের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ঘটনার যে পরিণাম তা যুবসমাজের জন্য দিক্-নির্দেশনাহীন এক অনন্ত শূন্যতার প্রতীক।

তিন. দাম্পত্য জীবনের এপিঠ ওপিঠ...
‘স্কেচ’ গল্পের কথক এ গল্পের নায়কের ভূমিকায় তার দাম্পত্য জীবনের ভেতর বাহির, সদর অন্দর ঘটনা পরম্পরায় সরল স্বাভাবিক সোজা কথায় ব্যক্ত করেছেন। ‘স্কেচ’ গল্পের স্বামী একজন নির্বিবাদী মানুষ; পেশাজীবনে শিক্ষক। এ দম্পতির একটি কন্যা সন্তানের অস্তিত্বও গল্পের শরীর জুড়ে আছে। মূলত গল্পে স্ত্রীর সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা নিয়ে দাম্পত্য জীবনে যে নৈমিত্তিক কলহ অনুষ্ঠিত হয় তা কাহিনীর মূল প্রতিপাদ্য। যদিও স্ত্রীর সন্দেহের যৌক্তিক কোনো কারণ গল্পে পাওয়া যায় না; কিংবা সেই সন্দেহ প্রসূত ঝগড়ায় স্বামী বেচারা নির্বাক শ্রোতার ভূমিকা পালন করে এবং নিশ্চুপ থেকে স্ত্রীকেই জিতিয়ে দেয়ার পক্ষে যুক্তি খুঁজে নেয় এভাবে :
রাগের পক্ষে অনেক যুক্তি খুঁজে পাই। আবার যুক্তি হারিয়ে যায়। বিপরীতত যুক্তি দাঁড়িয়ে পরে। মনে হয়, ও তো রাগ করে, ঝগড়া করে, অভিমান করে জিততে চায়। জিতুক। আমি না হয় হারলাম। ও তো আমার ছোট। আমি না হয় আমার মেয়ের মার কাছে হেরেই থাকালমা। (পৃ.৩২)স্বামী এতোটা ঔদার্য দেখাতে পারে বলেই তুমুল ঝগড়ার পর সংসার জীবনে ভাঙনের ঝড় উঠে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় না, কিংবা থেমে যায় না দাম্পত্য জীবনের চাকা। তাই তো অবলীলায় পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকীতে হাতের কাজ করা টিয়া রঙের সিল্কের শাড়ি উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করতে পারে। অবশ্য এখানে স্ত্রীর ব্যাপারটিও প্রাসঙ্গিক; কেন-না সেও তো ভুলে যায় ঝগড়ার কথা অথবা সন্দেহ জনিত রাগ ক্ষোভ অভিমানের কথা। গল্পের স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য এক অর্থে নীরব এক সমঝোতার সম্পর্ক। স্ত্রীকে এজন্য জিজ্ঞেস করে স্বামী বেচার কখনো জানতে পারে নি আদৌ স্ত্রী তাকে ভালোবাসে কিনা! স্বামী তার কথা বললেও বোঝা যায়, সে তার সন্তানের জননীকে কোনভাবেই ত্যাগ করতে পারে না কিংবা আঘাত দিতে পারে না। গল্পটিতে স্বামী স্ত্রীর নৈমিত্তিক জীবনের অম্ল-মধুর ঘটনার অসাধারণ বাস্তবানুগ বিশ্বস্ত ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন গল্পকার।


চার. পেছনের দিনকাল এবং জীবন...
‘শৈশব বিষয়ক নস্টালজিয়া’ গল্পে মোস্তফা তারিকুল আহসান দেখিয়েছেন সময়ের সিঁড়ি বেয়ে মানবজীবন ক্রমাগত এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আর পেছনে পড়ে থাকে নানান ঘটনা, সময় ও স্মৃতি। আনন্দ বেদনা আর কতশত স্মৃতিরাশি থরে বিথরে সাজানো থাকে মানুষের জীবন ঘিরে। এ গল্পের কথা তার জীবনের পেছনের যে স্মৃতি হাতড়ে বের করেছে তা মূলত স্বীয় সহদোর টুনুকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে। বয়সের একটা পর্যায় এসে যখন দুই ভাই আলাদা বসবাস শুরু করে যাদের মাঝে যখন প্রায় চারশ’ কিলোমিটার ভৌগোলিক ব্যবধান গল্পের কথক ঠিক তখন স্মৃতির পাতা ঘেঁটে দুই ভাইয়ের শৈশব কৈশোরে অতিবাহিত করা অম্ল-মধুর স্মৃতিচারণ করেছে। এ গল্পে মূলত টুনু-বুলুর একসাথে অতিবাহিত সময়ের অনেক ঘটনাকে জোড়া দিয়ে আখ্যান ভাগ নির্মাণ করেছেন গল্পকার। শৈশব কৈশোরের আনন্দ বেদনার কথা যখন কাহিনীকার ব্যক্ত করেছেন তখন তাদের মাঝে বিশাল দূরত্ব এবং কমে যাওয়া স্মৃতিকে ঘিরে একরাশ নিঃসঙ্গতা জেঁকে বসেছে। স্মৃতিচারণমূলক এ গল্পটিতে সার্বিক বিচারে গল্পকারেরই জীবনকথার প্রতিফলন ঘটেছে বললে খুব একটা ভুল হবে না।

পাঁচ. নষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক যুবক...
‘তরী ডুবে যাবার আগে’ শীর্ষক গল্পের ঘটনা তৌফিক এলাহী টুকু নামের বত্রিশ বছর বয়সী এক তরুণ যুবককে ঘিরে গড়ে উঠেছে। সমকালের নীতি নৈতিকতাহীন সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্ষমতাসী রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মীর ক্লেদক্লিষ্ট জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন গল্পকার তৌফিক এলাহীর জীবন ঘটনায়। টুকুর রাজনৈতিক দল ক্ষমতা হারাবার পরপরই তারই বন্ধু শফিক নির্দয়ভাবে ও নির্মম অত্যাচার করে তাকে হল ত্যাগ করতে বাধ্য করার পরও এলাহী হাতিরপুল এলাকায় তার পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের মেসে উঠে ঢাকাকে কেন্দ্র করেই থাকতে চেয়েছিল। সেজন্য সে একটা চাকরি খুঁজছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হওয়ায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘর্ষে হঠাৎ করেই ক্যাম্পাসে কয়েকজন ছাত্র নিহত হলে এবং ঐদিনের ঘটনার সাথে টুকু প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও তার নামে মামলা হয় এবং তাকে হত্যা করবে এমন আশংকা দেখা দিলে তৌফিক এলাহী টুকু বাধ্য হয় ঢাকা ছাড়তে। অবশ্য ঢাকা ছেড়েও জীবন নাশের আশংকা থেকে অব্যহতি পায় না টুকু। অতএব বাড়িতে অবস্থান নিরাপদ মনে করতে পারে না সে। এজন্য বাবার নিকট থেকে দুই লক্ষ টাকা নিয়ে কলেজ উন্নয়নের নামে নন্দীগ্রাম কলেজের পরিচালক কমিটিকে ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেয়। সেখানেই কলেজের আরেক শিক্ষক জলিল সাহেবের সাথে শেয়ার করা একটি রুমে তার থাকার ব্যবস্থা হলে চলমান সংঘাত ও রাজনীতির উত্তাপ থেকে আপাতঅর্থে রক্ষা পেলেও তৌফিক এলাহী এরপর ক্রমাগত সঙ্গদোষে অধঃপতনের শেষধাপে নেমে যেতে থাকে :
জীবন, শিক্ষা, নৈতিকতা, ধর্মবোধ, বাবা-মা সম্পর্ক, দেশ, রাজনীতি কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। চারদিকে শূন্য মনে হয়, সেই শূন্যতার মাঝে এক ধরনের ভোতা আনন্দ; এটাই কি মাতালের আনন্দ? নাকি জরাক্লিষ্ট সভ্যতার, অসহ্য বর্তমান বাংলাদেশের কিছু বেপথু যুবকের ফ্রিস্টাইল জীবনযাত্রার নমুনা। আমি জানি না, জানতে চাই না। সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ আমরা ভালো মানুষ হয়ে থাকার চেষ্টা করি, সোজা কথায় অভিনয়, আর রাত বাড়লেই আমরা নেশা আর পর্ণগ্রাফির জগতে চলে যাই। (পৃ.৩২)তৌফিক এলাহী টুকুর এই জীবন বাস্তবতা তার পরিবারের চাওয়ার সাথে সম্পূর্ণ বিসদৃশ হলেও রাজনৈতিক হানাহানির এবং স্বার্থপর সমকালে এভাবে নীচের দিকে নেমে যাওয়া ছাড়া অন্য গত্যান্তর ছিল না। তবে রুমমেট জলিল সাহেব ধ্বংসের শেষ ধাপে পৌঁছে গেলেও টুকু তখনো ঋজু দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য সেও জলিল সাহেবের সাথে সাথে নীল ছবি দেখা শুরু করে, মদ গাঁজায় তখন পুরোদস্তুর অভ্যস্ত হলেও নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে নি। আর তাই ভেঙেপড়া জলিলকে তখনো সাহস জোগায় টুকু এবং তারা পরদিন পুনরায় ভালো জামাকাপড় পড়ে সভ্য মানুষ সেজে কলেজের পথে রওয়ানা দেয়।

‘তরী ডুবে যাবার আগে’ গল্পে তৌফিক এলাহী টুকুর জীবন ঘটনার পরিণাম একটি বিশেষ বৃত্তে বন্দী থাকলেও সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় যুব সমাজের বেপথু হওয়ার বিশ্বস্ত চিত্র গল্পকার যেমন অংকন করেছেন তেমনি দেখিয়েছেন এক দুঃসহ সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র। একজন যুবকের পরিণাম তৌফিক এলাহীর মতো হওয়ার জন্য শুধু যুবক নিজেই দায়ী নয়, তার অনৈতিক এবং বিভ্রান্ত পথে যাওয়ার জন্য সমাজের রাষ্ট্রের দায়ভারও আছে। বৃত্তাবদ্ধ এলাহীর জীবন কেতাদুরস্ত জামাকাপড়ের নীচে থাকা কুৎসিত অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসবে কিনা তা লেখক আমাদের জানাতে পারেন নি।

ছয়. একজন পিতার পরিণাম...
‘একটি হত্যা দৃশ্যের পর’ গল্পে বিরোধী দলের কর্মী হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হাতে নিহত হলে নাছোড়বান্দ সাংবাদিক জহুরুলের নিকট থেকে পরিচয় জানা যায় সে গ্রামের নিরীহ ও ভদ্রগোছের এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সেই মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছেলের পড়ালেখার টাকা জোগান দেন অনেক কষ্টে। কিন্তু সেই হত্যাকা- নিয়ে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চুপ থাকে পত্রপত্রিকায় ফিচার রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরও নির্বিকার মন্তব্য করে থানার দারোগা সাহেব এভাবে :
[...] সরকারি দল দু’একজন মানুষ খুন করবে এটাও তো স্বাভাবিক, বিশেষ করে প্রতিপক্ষের লোকজনকে তো ঠাণ্ডা রাখতে হবে ওনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনও এরকম হয়েছে। এটাই তো এ দেশের নিয়ম। (পৃ.৫৯)দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মুখে এমন বক্তব্য শোনার পর নিশ্চয় পাঠক বুঝে ফেলেন সেই দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটা খারাপ কিংবা ভয়াবহতার দিকে গড়িয়েছে। আশফাক চৌধুরীর ছেলে মিজান জানতো না সে যখন দলবল নিয়ে শামীমকে খুন করছিল সেই দৃশ্য তার বাবা বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে প্রত্যক্ষ করছিল। তার ছেলে মিজান মেধাবী এবং ঠাণ্ডা মাথার ছেলে হয়েও কিভাবে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম বর্ষ ঠিকঠাক পড়ালেখা করলেও হঠাৎ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ‘[...] দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। মিটিং-মিছিল চাঁদাবাজি অস্ত্র প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে মশগুল হয়ে যায়।’ (পৃ.৬০) অবশ্য কেন এমন হয়েছিল, তা আশফাক চৌধুরীর সহকর্মী আলতাফ সাহেবের ব্যাখ্যা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। আলতাফ সাহেব তাঁকে জানিয়েছিল :
[...] এটা একটা নেশার জগৎ। যুবক মানুষ যুদ্ধ যুদ্ধ মহড়া দেবে, সিনেমার নায়কের মতো মারপিট করবে, মন্ত্রী এমপিদের গাড়িতে ঘুরবে, আলগা টাকা পাবে, কাজে কাজেই এটা তারা লুফে নেবে। (পৃ.৬০)অবশ্য ছেলেকে আশফাক চৌধুরী ফিরিয়ে আনার কথাও ভেবেছিলেন; তিনি মিজানকে বাসায় ফিরে আসার কথা বলেছিলেন; অন্যথায় চিরদিনের মতো সম্পর্কচ্ছেদের হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু মিজান এসব কথা দলের নেতা সালাম ভাইকে জানালে, পাঠক আরো এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয় গল্পে : ‘তোমার এই সাহস, আত্মত্যাগ দলের গোপন দলিলে লেখা থাকছে, ভবিষ্যতে এর প্রতিদান পাবে। দেখছ না, ছাত্র নেতারাই তো মন্ত্রী হচ্ছে, এমপি হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান হচ্ছে। লেখাপড়া দিয়ে কী এইসব হতে পারবে?’ (পৃ.৬১) নেতা যখন তার কর্মীকে লেখাপড়া শিকেয় তুলে অস্ত্রবাজিতে মদদ জোগায় এবং ভবিষ্যতে তারাই মন্ত্রীত্ব পাবে আশ্বাস দেয়। তখন দেশের নষ্ট রাজনীতির মুখোশ পুরোটাই খুলে পড়ে এবং বেরিয়ে আসে রাজনীতির বিভৎস এক ভবিষ্যৎ চেহারা।

আশফাক চৌধুরী স্বচক্ষে তার আদরের সন্তান মিজান কর্তৃক শামীমকে খুন করার দৃশ্য দেখার পর বোবার মতো কয়েকটা দিন ঘরের মাঝে কাটিয়ে দিলে একদিন তার পড়ার দরজায় একটি অপরিচিত যুবককে দেখতে পান : যুবক পরিচয় দিয়ে জানায় তার নাম জহুরুল, সে পত্রিকার রিপোর্টার। জহুরুল অনেকটা নাটকীয়ভাবে আশফাক চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে শামীম খুন হওয়ার ঘটনা সম্বন্ধে এবং জহুরুল একথাও জানায়। হত্যাকারী হিসেবে সে সন্দেহ করে মিজানকে। একথা শুনে মিজানের বাবা হতভম্ব না হয়ে বরং খানিকটা সচকিত হয় এবং সামনে যেন দেখতে পান আশার আলো। তিনি তখনই নিজের ছেলের অপকর্মের কথা এবং তার প্রত্যক্ষীভূত দৃশ্যের কথা স্বীকার করে থানায় ছেলের নামে অভিযোগ দায়ের করার জন্য বেরিয়ে পড়েন অসুস্থ শরীর নিয়েও জহুরুলকে আরো তিনি বলেন শামীমের বাবার নিকট তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। অবশ্য থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরপরই হার্টএ্যাটাকে মারা যান আশফাক চৌধুরী। ছেলের বিরুদ্ধে থানায় হত্যার অভিযোগ দেয়ার সময় নিরীহ এই বাবাকে দারোগা সাহেব শোনায় : ‘[...] এ রকম বাবা আমার ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে প্রথম দেখলাম। আপনি নিজে নিজের ছেলেকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলার ব্যবস্থা করলেন। আমরা তো কেইসটা গায়েব করে ফেলেছিলাম। আপনি বাবা হয়ে এটা কী করলেন?’ (পৃ.৬৮) আশফাক চৌধুরী পিতা হয়েও সন্তানের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উত্থাপন করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস নিয়েছিলেন তার পরিণাম সম্পর্কে গল্পকার আমাদের অবহিত করেন নি কিংবা মিজানের বাবাও জেনে যেতে পারেন নি। তার ছেলের শাস্তি হয়েছিল কিনা! তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পাঠক অনুমান করে নিতে পারেন ঘটনার পরিণাম সম্বন্ধে। ‘একটি হত্যা দৃশ্যের পর’ গল্পে মূলত একটি হত্যাদৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পকার দেশের প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি এবং একজন পিতার ন্যায়বোধের যে চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তা একদিকে মধ্যবিত্ত মানুষের অস্তিত্ব সংকট অন্যদিকে বেসামাল রাজনীতির কথা পাঠককে আশার কোনো আলো দেখাতে পারে না।

সাত. সুস্থ জীবনের জন্য সংগ্রাম...
‘মদিনা বিবির প্রত্যাবর্তন’ গল্পের প্রধান চরিত্র মদিনা বিবি একদিন শিশির ভেজা গ্রামের মেঠোপথ ধরে বাড়িতে এসে পৌঁছালে শোকাহত মা খুশিতে আত্মহারা হলেও তার বাবা মেয়ের দিকে তাকাতে পারে না কিংবা কাছে যায় না মেয়ের, কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারে না তাকে। কারণ, পাঁচবার মদিনা বিবির বিয়ে দেয়ার পরও যখন তার সংসার ভেঙে যায় তখন রহিম মোল্লা ভেবেই নিয়েছিল স্বামী সংসার মেয়ের কপালে নেই। এখন সময় শ্যালক সম্পর্কের আবু হানিফ মেয়ে নিয়ে তার কাছে যাওয়ার কথা বললে রহিম মোল্লা বোধ হয় খানিকটা ভারমুক্ত হয়েছিল :
মেয়ে সেখানে কারখানায় কাজ করবে, মাঝে মাঝে বেতন পাবে এবং তার বর্তমান চিন্তা দূর হবে। এসব তথ্য মদিনার জানা, কাজে কাজেই বাপকে সে গালিও দেয় না, কাছেও যায় না। হয়তো তার অপরাধ অথবা তার বাপের অপরাধ, তবে তা ভেবে এখন তো কোনো লাভ নেই। এখন সে কী করবে সেটাই তার ভাবনার বিষয়। (পৃ.৭১)এরপর সেই দূরসম্পর্কের মামা তাকে সপ্তাহখানেক নিজের বাসায় রেখে ভোগের পর বিক্রি করে দেয় সোনাগাছির পতীতাপল্লীতে। সেখান থেকে মদিনা বিবি গিয়ে পড়ে বম্বে শহরে। শুরুর দিকে মদিনার খারাপ লাগতো, কষ্ট হতো। কিন্তু পরে সয়ে যায়। তারপরও মদিনা থেমে যায় না, হাল ছাড়ে না সুন্দর জীবনে ফেরার। তার অব্যাহত চেষ্টা একদিন তাকে সেই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়; অবশ্য এজন্য তার অর্জিত টাকাপয়সা সব সর্দারনীকে দিয়ে শুধু গায়ের গোটাকতক গহনা নিয়ে মদিনা বিবি কলকতা হয়ে ফিরে আসতে পারে গ্রামে। গ্রামে আসার পর তার ওপর নজর পরে গ্রামের নামকরা লম্পট জলিলের। জলিল অবশ্য গ্রামের অন্য মেয়েদের যত সহজেই নিজের বশ করে ফেলতে ওস্তাদ মদিনার বেলায় সেরকম হয় না। কিন্তু তারপরও জলিল নিরস্ত হয় না বরং ভেতরে ভেতরে কামবাসনা বাড়তেই থাকে তার। অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজের চেলাচামুণ্ডারা ধর্ম ও সমাজ রক্ষার নামে মদিনাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয় পিতা রহিম মোল্লাকে। কিন্তু পিতার স্নেহপ্রবণ অন্তর কন্যাকে গৃহছাড়া করার পক্ষে সায় দেয় না। এজন্য গ্রামের দশজনের সামনেই মাতবর মোল্লাদের বিরোধিতা করে রহিম মোল্লা : ‘আমার মেয়ে খারাপ হয়ি গিছে ভালো কথা, সে আমার বাড়িতে থাকপে, তোমাদের কোনো খেতি না করলেই তো হলো।’ (পৃ.৭৪) একথা ঠিক পিতার অফুরান স্নেহধারা শেষাবধি রক্ষা করতে পারে নি মদিনা বিবিকে সমাজের প্রভাবশালীদের শাস্তির হাত থেকে। জিয়াউল মুনশী পরদিন শালিসে তাকে একশ’ দোররা মারাসহ মাথার চুল নেড়ে করে দেয়ার শাস্তি ঘোষণা করে। এরপর মদিনা তার সাথে আনা গহনাগুলো বিক্রি করে রাস্তার ধারে একটা মুদি দোকান দেয়। কোথা থেকে এসে জোটে সবুর নামে এক যুবক। বয়সে সে হয়তো মদিনার ছেলের চেয়েও ছোট হবে। সে মদিনার সাথে ঐ দোকানে চা বানায় গঞ্জ থেকে দোকানের মালামাল নিয়ে আসে। ভালোই চলে তাদের। এক সময় ভুলে যায় সবাই তাদেরকে। অসম বয়সী এই নারীপুরুষের যাপিত জীবন সম্পর্কে পরিণিামে গল্পকার জানিয়েছেন :
সবুর মদিনার ছেলে আসাদের চেয়েও কয়েক বছরের ছোট হবে। তারা কেমন আছে তা কেউ জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। তবে, দাঁতভাঙার বিল থেকে হুহু করে যে বাতাস প্রতিদিন ঢোকে তাদের ছাপড়ায়, তাতে তাদের অসমবয়সী দুটো হৃদয় জুড়িয়ে যায়, কারণ, সে বাতাসে কলকাতা বম্বের গন্ধ আসে না, মাতব্বরের চোখ রাঙানি আসে না, জলিলের অশ্লীল প্রস্তাবও আসে না। (পৃ.৭৭)অর্থাৎ গল্পকার মদিনা বিবির জীবনের পরিণাম সুখকর না হলেও অশোভন কিংবা কুৎসিত সমাজবাস্তবতার বাইরে এক ভিন্নমাত্রায় চিত্রিত করেছেন। এই বিবেচনায় বলা যায় মদিনা বিবি বোম্বে কলকাতার বেশ্যা পল্লী থেকে বেরিয়ে যে সুস্থ জীবনে ফিরতে চেয়েছিল শেষপর্যন্ত তার জীবনের সে আশা পূরণ হয়েছির। এই অর্থে তার প্রত্যাবর্তন সার্থক; যদিও এজন্য তাকে তথাকথিত ধর্মীয় বিচারের মুখোমুখি কঠিন ও অপমানকর শাস্তি গ্রহণ করতে হয়েছিল। তারপরও মদিনা বিবি জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারায় নি, শুরু করেছে নতুন করে এক মানবিক সংসারজীবন।

আট.
মোস্তফা তারিকুল আহসান ‘গল্প গল্প খেলা’ গ্রন্থের সাতটি গল্পে সমকালীন সমাজঘনিষ্ঠ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে প্রবহমান মধ্যবিত্ত মানুষের যাপিত জীবনের বিশ্বস্ত চিত্র এঁকেছেন। গ্রন্থের ‘গল্প গল্প খেলা’, ‘চাঁদমারি’, ‘তরী ডুবে যাবার আগে’, ‘একটি হত্যা দৃশ্যের পর’ শীর্ষক গল্পে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি এবং যুবসমাজের অধঃপতনের অসামান্য বাস্তবানুগ চিত্র অংকন করে প্রথাগত ছাত্র-রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ‘স্কেচ’ এবং ‘শৈশব বিষয়ক নস্টালজিয়া’ শীর্ষক গল্প দুটোতে ব্যক্তি মানুষের দাম্পত্যজীবনের অম্লমধুর সম্পর্ক এবং পেছনে ফেলে আসা দিনকালের দিকে তাকিয়ে একরাশ স্মৃতিকাতর ঘটনার কথা ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া ‘মদিনা বিবির প্রত্যাবর্তন’ গল্পে হতদরিদ্র পিতার এক কন্যা সন্তানের জীবনে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনার বীভৎস বাস্তবতার চিত্র আঁকতে গিয়ে ধর্মান্ধ মুসলিম সমাজকে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি একজন মদিনা বিবিকে মানবিক প্রত্যাশায় সংসারে প্রতিস্থাপন দৃশ্য পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।

সামগ্রিক বিচারে মোস্তাফা তারিকুল আহসানের ‘গল্প গল্প খেলা’ গল্পগ্রন্থের বর্ণনারীতি প্রথানুগ, বৈচিত্র্যহীন। তিনি গ্রন্থের নাম শীর্ষক গল্পের ঘটনা বর্ণনায় খানিকটা ভাষাগত বৈচিত্র্য আনতে চাইলেও শেষাবধি তা ধরে রাখতে পারেন নি। তবে ‘স্কেচ’ গল্পের বর্ণনায় দাম্পত্যজীবনের খুঁটিনাটি গল্পকার অত্যন্ত বিশ্বস্ততায় উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া ‘শৈশব বিষয়ক নস্টালজিয়া’ গল্পের বিস্তৃত আখ্যানভাগের শিথিল উপস্থাপনা, ‘তরী ডুবে যাবার আগে’ ও ‘একটি হত্যা দৃশ্যের পর’ গল্পের নাটকীয়তায় এবং লেখক প্রকল্পিত পরিণামে পাঠক হোঁচট খেয়েছে। গল্পের পরিণাম আরোপিত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। তারপরও ‘গল্প গল্প খেলা’ গ্রন্থের সাতটি গল্পের সামগ্রিক বিচারে বলা যায়, মোস্তাফা তারিকুল আহসানের ভাণ্ডরে প্রচুর গল্পোপাদান আছে যা বাংলাদেশের ছোটগল্প শাখায় সংযোজিত হলে এ শাখা আরো সমৃদ্ধ হবে।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×