১...আমার একটা আব্বু আছে। ভারী মিষ্টি আর আহ্লাদী একটা আব্বু। তার নাম অয়ন। আব্বুটা কর্ডভা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে, মাত্র ৭বছর তার। ও যখন তুলোর পুতুলের মত ছিল তখন সারাক্ষণ ওকে জাপটে বসে থাকতাম, আর যখন সে গুঁড়ি গুঁড়ি পায়ে টুকটুক করে দৌড়াতো তখন সব ভুলে ওর পিছেই দৌড়াতাম। তারপর নিজের পড়াশুনার ব্যস্ততায় প্রায় ১বছরখানেক ওকে কাছে পাইনি। একদিন গেলাম তার কাছে। সে কিন্তু আমায় ভুলেনি। এতদিন পরেও আমায় কাছে পেয়ে ঝাপিয়ে পড়ল সে। অনেক আহ্লাদ, অনেক দুষ্টুমি শেষে বাবাটাকে নিয়ে খেতে বসলাম। কিন্তু তার আব্দার সে কার্টুন না দেখে খাবে না। হেসে উঠলাম, আমার আব্বুটা পুরো আমার মত কার্টুনফ্রিক। তবে তার একটা ব্যাপার আমার খুব খারাপ লেগেছে, সে কথায় কথায় হিন্দি বলে। ভাবলাম সব দোষ ইস্পির(বাবুর মাকে আমি ইস্পি ডাকি), নিজে হিন্দি সিরিয়াল দেখে ছেলের মাথা খাচ্ছে। কিন্তু অয়ন টিভি অন করার সাথে সাথেই বুঝলাম আসল ব্যাপার, আমার আব্বুটা ডোরেমন নামের কুৎসিত, অর্থহীন হিন্দি কার্টুন দেখে। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিচ্ছুক্ষণ।
২...সায়ন্ত আমার ক্লাস ৮এ পড়া স্টুডেন্ট। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেধাবী ছেলে। তার রিপোর্ট কার্ডে ৮০ চেয়ে কম নাম্বার আমি দেখিনি। কিন্তু ও কখনও বাংলা এবং বাংলাদেশ স্টাডিস সাবজেক্টে কিছুতেই ৭০+ পায়না। আমি ওকে সায়েন্স, ম্যাথ আর ইংলিশ পড়াতে যাই। ওকে বাংলা পড়তে বললে 'আপু বাংলা কঠিন, তাও পড়ছি তো' বলে পাশ কাঁটিয়ে দেয়। তাই একদিন ওর মাকে বললাম, 'অ্যান্টি আপনি যদি সায়ন্তর বাংলাটা একটু দেখতেন অথবা আমায় বলুন আমি দেখিয়ে দিব' অ্যান্টি আমায় থামিয়ে বলে উঠলো, 'মা ওটাতে ৮০ পেতে হবে এমন তো কথা নেই, জানলেই চলে। a-level অথবা ভার্সিটিতে তো আর বাংলা লাগবে না।' আমি আবার স্তব্ধ হয়ে গেলাম। :-& :-& :-&
৩...আজ খবরে দেখলাম jscতে gpa5 না পাওয়ায় এক ক্লাস ৮এর বাবু আত্মহত্যা করেছে। এই লজ্জা আমরা কথায় রাখব?? আমাদের এই সমাজের তথাকথিত ভালো রেজাল্টের গ্যাঁড়াকলে আজ কি আমরা এই শিশুদের মৃত্যু চোখ বুজে দেখব?? আজ আমি স্তব্ধ নই, নির্বাক হয়ে গেছি।
প্রাসঙ্গিক সারমর্মঃ কার্টুন তো আমরাও দেখতাম। আমাদের সময় কিছু অসাধারণ কার্টুন দেখাত। tom&jerry, bugs bunny, baby looney toons, donald duck, swat cats, captain planet etc. এসব কার্টুন এখন কোথায়? কেন আজকে এই বাবুগুলো সুকুমার রায়ের মিষ্টি কবিতা অথবা জেরি টমের দুষ্টুমি অথবা লুনিটুনসের মত শিক্ষামূলক কার্টুন না দেখে, বস্তাপচা ডোরেমন দেখে বড় হচ্ছে!! সামাজিক অবক্ষয়, মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় নিয়ে আজ আমরা গলা ফাটাই। তবে বলুন ডোরেমনে বন্ধুদের মাঝে চিটিং, মিথ্যা বলা টাইপ এপিসোড গুলোই বা কেমন মূল্যবোধের সৃষ্টি করছে শিশুগুলোর মাঝে?
আর আজকালকার মা-বাবা যারা কিনা ছেলে মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে মনে করেন মানুষ করার গুরুদায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন। পাশ করে বের হলেই ধরে ধরে বাইরে নিয়ে যাবেন, বড় বড় ভার্সিটিতে পড়ে সফলভাবে বিদেশে সুখে থাকবে। সো বাংলা জানার কি দরকার, তাদের কাছে জানতে চাই> যে বাড়িতে আপনি ভিতই দিলেন না তা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কিভাবে? যে নিজেকে চিনেনা, নিজের দেশকে জানেনা, সে কখনই কোনক্ষেত্রে সফল না। ইংলিশ মিডিয়ামে আমিও পড়েছি, কিন্তু আমি শরৎচন্দ্রও চিনি, তারাশঙ্করও চিনি আর পথের পাঁচালীর অপুকেও চিনি। আমার মা বাবা আমাকে দেশ চিনিয়েছেন, বিশুদ্ধ বাংলা শিখিয়েছেন। আমি তা নিয়ে গর্বিত। তাই অনুরোধ আপনার বাচ্চাকে অন্তত বঞ্চিত করবেন না।
আর আজ আমি সজোরে ধিক্কার জানাই নব্যশিক্ষা ব্যবস্থাকে। যা আমাদের খাঁচা বন্ধী শিশুদের গলায় লোহার ফাঁসী হয়ে চেপে বসছে। সেই তথাকতিথ ভালো রেজাল্ট না করলে একটা বাচ্চাকে যে কি পরিমাণ মানসিক অত্যাচারের মাঝে পড়তে হয় তার প্রমাণ রেখে গেল ছোট্ট শিশুটি । হাতজোর করে অনুরোধ করছি, শিশু একবার ব্যর্থ হলে তাকে অপমান নয় উৎসাহিত করুন। এদের প্রস্ফুটিত হতে দিন।
সর্বশেষে বলব, রুশান বাবুর জন্য এগিয়ে আসুন!
ধন্যবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫৭