ফেসবুকে শেখ হাসিনার দুটো ভিডিও দেখলাম। একটাতে দেখা যায় উনি বক্তব্য রাখছেন আর কর্মীরা স্লোগান শুরু করেছে। শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়ে আঙুল দিয়ে মুখ চেপে সবাইকে চুপ করতে বলছেন। সবাই সাথে সাথে চুপ। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যায় উনার বক্তব্যের সময় লোকজন স্লোগান শুরু করেছে। উনি হাওয়া দিচ্ছেন। হাওয়া শেষ লোকজনের স্লোগানও শেষ। এমন দৃশ্য আমি আগে দেখিনি। ওবায়দুল কাদের বা মির্জা ফখরুলকে মাঝেমধ্যে দেখা যায় নেতাকর্মীদের ওপর বিরক্ত হয়ে গালমন্দ করছেন বা উঠে চলে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা কখনও এমন করেছেন চোখে পড়েনি। নেতাকর্মীদের নাড়িনক্ষত্র এভাবে পড়তে পারে এমন রাজনীতিক এখনকার যুগে বিরল। অথচ শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসারই কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনি হয়তো সাধারণ বাঙালি গৃহিণী হয়েই জীবন পার করে দিতেন। ঘটনাক্রমে রাজনীতিতে এসে উনি অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। কেউ কি ভেবেছিল বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ পদ্মা সেতু করতে পারবে? পিতৃহত্যার প্রতিশোধ বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার- এমন অনেক কাজ উনি করছেন, যা করতে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিতে হয়। অবশ্য জীবন হাতের মুঠোয় নেওয়া উনার জন্য নতুন নয়।
গত ১৭ মে গেল শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের ১৭ মে সেনাশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি এমন সময় দেশে ফেরেন, তার পিতা-মাতা, ভাই-ভাবীসহ পরিবারের বেশিরভাগ আত্মীয়র খুনিরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করে রীতিমতো রাজনীতি করছে। শেখ হাসিনা জানতেন তার প্রাণনাশের হুমকি আছে। সব ভয়কে জয় করেছিলেন তিনি। তিনি জানতেন তিনি না ফিরলে পিতার খুনিদের বিচার সম্ভব হবে না কোনোদিন।
দেশে ফেরার পর ধানমন্ডি ৩২ এ তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে উনার আক্ষেপ এখনও নেট ঘাঁটলে জানা যায়। সেই যে দেশে এলেন, তারপর তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। প্রতিবারই বেঁচে গেছেন।আর দুঃসাহসী কাজকর্ম করে গেছেন।
সাপের বিষ যে হজম করতে পারে, তাকে নাকি নীলকণ্ঠী বলা হয়। শেখ হাসিনা এখন বোধহয় সে পর্যায়ে চলে গেছেন। যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারা কি কখনও ভেবেছিল শেখ হাসিনা এমন পর্যায়ে চলে যাবেন?
শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার বদলা নিয়েছেন। দেশের জন্য কী করেছেন সেটা ইতিহাসই সাক্ষী দেবে। তবে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বুঝি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী রাজনীতিকদের একজন তিনি। বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খাওয়ার কাহিনী কেবল পুস্তকে পড়েছে লোকে। শেখ হাসিনা বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। সব বিরোধীকে পায়ের তলায় পিষেছেন। ইনু-মেনন-মতিয়াদের মতো মুজিব বিরোধীরা এখন শেখ হাসিনার পাঁড় ভক্ত।
গত নির্বাচনের সময় ড. কামালের নেতৃত্বে ফখরুল, মওদুদ, মান্না, জাফরুল্লাহরা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। তারপরের ইতিহাস আমরা জানি। যারা দিনরাত শেখ হাসিনার সমালোচনা করত, তারা তার সামনে গিয়ে বেড়াল বনে গেছে।
এসব গেল দেশের কথা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে তুরস্ক, আমেরিকা, মিশরসহ জাতিসংঘ কম চেষ্টা করেছে? শেখ হাসিনা কাউকে গোনায় ধরেছেন? ভারতের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে তিনি চিনের সঙ্গেও বাণিজ্য করছেন। ইদানীং সরাসরি আমেরিকাকে এক হাত নিচ্ছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কখনও হয়েছে?
'৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' নাকি বাংলাদেশে অপারেশন চালাতে চেয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী না করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনচেতা মনোভাব উনার হয়তো ভালো লাগেনি। বঙ্গবন্ধু তাঁবেদারি পছন্দ করতেন না। শেখ হাসিনা হয়তো সে পথেই। কতটুকু সফল বা কতটুকু ব্যর্থ তা ইতিহাসই বলে দেবে।
শেখ হাসিনা যেদিন দেশে ফেরেন, জানা যায় সেদিন ঢাকায় প্রচুর বৃষ্টি উপেক্ষা করে লোকজন তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। এমন স্লোগান উঠেছিল, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথে লাখো ভাই। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তার ওপর গ্রেনেড হামলা হলে তার ভাইয়েরা বুক পেতে তাকে রক্ষা করেছিল। এখনও কিছু হলে জীবন দিতে পিছপা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উনি কি ভাইদের মনে রেখেছেন?
যারা আওয়ামী লীগ করে, যদ্দুর দেখেছি তারা মনে প্রাণে আওয়ামী লীগ করে। কিছু পাওয়ার আশা করে না। যদিও এখন পথেঘাটে সব জায়গায় আওয়ামী লীগ। ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। হাইব্রিডদের ভিড়ে শেখ হাসিনা হয়তো ত্যাগীদের দেখতে পান না, কিন্তু তারা শেখ হাসিনার জন্য মরতেও প্রস্তুত। এটাই বোধহয় শেখ হাসিনার শক্তি।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অথচ উনি তাদের কাছে রাখতে পারেননি। শেখ হাসিনাও নিশ্চয়ই শত্রু-মিত্র চিনে থাকবেন? চিনলেই মঙ্গল। দেশ ও জাতিও যেন তার ওপর ভরসা রাখতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:০০