রাত এগারোটা।
আরিফ সাহেব কেবল কাজ শেষ করে গ্রীনরোডের অফিসটা থেকে বের হয়েছেন। আকাশে ধূসর মেঘের দলগুলো মাথার উপর একের পর এক ঘুরপাক খাচ্ছে। খুব বৃষ্টি হয়েছে সাথে ঝড়ো হাওয়া। একটু আগে কমেছে। অফিসে থাকতেই দেখেছেন কারেন্ট নেই। রাস্তার সোডিয়াম লাইটগুলো সব মৃতের মতো তাকিয়ে আছে। রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। যদিও এই সময়ই এমনটা দেখা যায় না। শহরটা তো সারারাত জেগে থাকে। তবে আজকের ঝড় পুরো রাস্তা ফাঁকা করে রেখেছে।
লোকটা বিড়ালের মতো নিঃশব্দে একা একা হেঁটে চলছে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসার দিকে। অফিস বিল্ডিংটা পার হয়ে কিছুদূর এসেছে কেবল। হঠাৎ করেই তন্দ্রার সাথে দেখা। তন্দ্রা।
উনার স্ত্রী।
আরিফ সাহেব একটু চমকে গেলেন। চমকানোরই কথা, অনেকদিন পর তাকে দেখলেন। তন্দ্রা এখন আর তাদের সাথে না। তাদের বলতে আরিফ সাহেব এবং তার ছেলের সাথে। সংসারে তিনজন ছিল তারা। তন্দ্রা চলে যাওয়ার পর থেকে এখন দুজন। আলতো পায়ে পাশাপাশি হেঁটে চলছে দুজন। কেউ কোন কথা বলছে না। একটু পর আরিফ সাহেব বলতে শুরু করলো-
কি? হঠাৎ কি মনে করে? আমি জানি তোমার কাছে কোন জবাব নেই। তবে কি জানো! তুমি যতকিছুই করো না কেন আমি রাগ করতে পারিনা, অন্তত তোমার সাথে পারিনা। তবে কষ্ট পাই খুব। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা কি খুব দরকার ছিল? ধ্রুবকে রেখে তুমি একা থাকতে পারলে! এখন তো হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ চাইলে কি না করতে পারে! আমি কিন্তু তোমাকে এখনও ভালোবাসি, ঠিক আগের মতো না হলেও কিছু বেশি হবে।
আজকের আকাশটা দেখো। আমার জীবনের মতোই ধূসর। অথচ তুমি রঙধনু হয়ে সাজিয়ে তুলেছিলে সবকিছু। তন্দ্রা। তোমার চলে যাওয়াটা কি খুব দরকার ছিল? নাকি তোমার অদৃষ্ট-ই এমন ছিল?
জানো?
আমাদের ধ্রুব অনেক বড় গেছে। তুমি এখন দেখলে চিনতেই পারবে না। যদিও চেহারা এখন অনেকটাই তোমার মতোই। তোমাকে সে খুব মিস করে। ও যখন সবকিছু বুঝতে শুরু করে তখন মাঝেমাঝে আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,"বাবা, আম্মু কই?"
আমি ওকে কিছু একটা বলে দিতাম। মাঝেমাঝে বলতাম তুমি বেড়াতে গিয়েছ কিংবা অফিসের কাজে গিয়েছ। এখন তো সে অনেক বড়। নিজে থেকেই সব বুঝে গিয়েছে। আমাকে আর তোমার কথা জিজ্ঞেস করে না। তবে তোমাকে মিস করে খুব। তবে আমি করি না। করবো কেন বলো! এইযে তোমার সাথে তো আমার প্রায়ই দেখা হয়। তবে ধ্রুব তো তোমাকে দেখতে পায় না, তাই একটু-আকটু মন খারাপ করে।
আজকের চাঁদটা দেখো তন্দ্রা। ঠিক তোমার মুখের মতো। যেন অসীম সৌন্দর্য্য বিগলিত হয়ে গড়া তোমার আকৃতি। চোখ দুটো যেন দূর্বাদলের ওপর জ্বলজ্বল করা রুপার মুক্তো। চুলগুলো ঘন অন্ধকার কালো বন, ঠিক আজকের রাতটার মতো। তোমার কম কথা বলা সেই অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে দেখছি।
হিহি।
তোমার ঐ দিনটার কথা মনে আছে? যেদিন তুমি প্রথম আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলে? ঐ যে, মিরপুর রোডের রেস্টুরেন্টে। তুমি ভয়ে কাঁপছিলে। এসির মধ্যেও তোমার কপাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু গড়িয়ে পড়তে চেয়েছিল। তবে আমি যে তোমাকে হৃদয়ের অর্ধেক স্থান দিয়েছিলাম, তাই তো সেই ভয়ের জলবিন্দুকে কোনদিন তোমার চোখ থেকে পড়তে দেইনি।
এত সবকিছুর পড়েও কি তোমার চলে যেতে হলো তন্দ্রা! আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে থাকলেও কোনদিন দিবে না। কিছু কিছু সময় পরিস্থিতি আমাদের পরিবর্তন ঘটায়। চারপাশের ঘটে যাওয়া সবকিছু দেখেও আমরা চুপ হয়ে যাই। প্রাপ্তির ঝুলিটা এমন শূন্য পর্যায়ে চলে যায় যে, অপ্রাপ্তিতে আর বেদনা লাগে না। তবে তখন কিন্তু বেদনা ছাড়াই আত্মা কষ্ট পেতে শুরু করে। আর তখনই আমরা চুপ হয়ে যাই। অনেক কথা বলা মানুষটার বাক্যগুলাও দাফন হয়ে যায় দেহ মৃত্যুর আগেই।
তন্দ্রা দেখো, এই রেস্টুরেন্টে ও তো আমরা এসেছিলাম।
ঢাকার কোনটা বাদ রেখেছি সেটা বলো। জানো তন্দ্রা! তুমি চলে যাওয়ার পর ডাক্তার তোমাকে নিয়ে ভাবতে নিষেধ করেছে। ভাবতে ভাবতে নাকি আমার মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আর মাঝেমাঝে আমি নাকি বাস্তব ছাড়িয়ে কল্পনার জগতে প্রস্থান করি। এটা কেমন কথা বলো? আমি তো তোমার সাথেই আছি, তোমার পাশে। তুমি তো বাস্তব, তোমার সাথে থাকলে আমি কল্পনায় যাই কি করে তুমি বলো! আমি এরকম করি বলে তোমার ছেলেও রাগ করে মাঝেমাঝে। তুমিও কি রাগ করো নাকি?
রাতটা গভীর হচ্ছে সাথে অন্ধকারের তীব্রতা। আরিফ সাহেব ৩২-এর ক্রসিংটার প্রায় কাছাকাছি। হয়তো আর কয়েক মিনিট লাগতে পারে। তন্দ্রা এখনও নিশ্চুপ হয়ে পাশাপাশি হাঁটছে। হয়তো স্বামীর বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙুলটা ধরতে তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে। তবে সেটা এখন তার অধিকারের বাইরে।
আকাশে মেঘগুলো একসাথে জড়ো হচ্ছে। আবারও হয়তো কারো জীবনে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। হয়তো তন্দ্রার কিংবা আরিফ সাহেবের কিংবা অন্যকারো। রাত্রির অন্ধকার গায়ে মেখে দুটো ভালোবাসা হেঁটে চলছে পথের সমান্তরালে। সোজা পথটায় আবছা চাঁদটাও তাদের ভ্রমণের সঙ্গী। তন্দ্রা এখনও চুপচাপ। মুখে একফোঁটা বুলি নেই, পা জোড়া নিঃশব্দে হেঁটে চলছে অসীম ঘোরলাগা অন্ধকারে। গন্তব্য কোথায় সে জানে না তবে পরিণতি জানে। ভালোবাসার গল্পগুলো যে কখনও শেষ হয় না; নিখাদ প্রেমের মালাগুলো কেবলই দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় হয়; টোল খায়; ভেঙে যায়; তবে ক্ষয় পায় না। তার ভালোবাসা যে তার কাছে ফিরে আসবে সেটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে আর বিশ্বাসের শক্তি ধরণীর সবচে' শক্তিশালী। সত্যিকারের ভালোবাসা কোনদিন হার মানতে জানে না; পরাজিত হওয়ার পরেও না।
আরিফ সাহেবের ছেলে ধ্রুব আমার খুব কাছের বন্ধু। ঠিক ঐদিন রাতেই ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় আমাকে বলল-
"দোস্ত, আব্বু আর নেই। একটু আগে ৩২-এর ঐ রাস্তাটা ক্রস করার সময় বাসের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। হাসপাতাল নেওয়ার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আমি সবসময় বলতাম, যে মানুষটা গত তেরো বছর আগে মারা গিয়েছে তাকে সবসময় কল্পনা করো কেন? আমাকে কোন জবাব দিতো না। শুধু চুপচাপ থাকতো। এখন তো সারাজীবনের জন্য চুপ হয়ে গেল।"
আমি সাথেসাথে-ই ওর বাসায় গেলাম। ধ্রুব-র অবস্থাও খারাপ। মাকে হারিয়েছে আগেই, এখন আবার বাবাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন দুজন মানুষের প্রস্থান নিশ্চিত পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখের। ঐদিন রাতেই মায়ের তেরো বছরের পুরনো কবরটার পাশে আঙ্কেলকে কবর দিয়ে আসলাম।
আজকে চুপচাপ বসে ভাবছি আঙ্কেল হয়তো কবরে শুয়ে বলছেন, "দেখো তন্দ্রা, তোমার বিশ্বাসের শক্তিতে তোমার কাছে চলে আসলাম আজীবনের জন্য। এখানে তো তোমাকে হারানোর ভয় নেই, তাই না?"
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৪৮