somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপেক্ষিত ও বিস্মৃত ‌অচ্ছুৎ হরিজনের ১৯৭১

২৪ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোহাম্মদপুর টাউন হলের পেছনে সুইপার কলোনির সামনে ফুটপাতে বসে ১০ পয়সায় একটি পরোটা, ভাজি আর এক কাপ চা কিনে নাশতা খাওয়ার উদ্যোগ করছিলেন গঙ্গামা। ২৫ মার্চ রাতভর শহরজুড়ে গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আহাজারির পর আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধতা নিয়ে এসেছে বিষন্ন ভোর।
ঢাকা আতঙ্কে নিথর। ধাঙ্গড় বা মেথর নামে যাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়, সেই পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রতিটি পাড়ায় আতঙ্ক যেন বাতাসে অনুভব করা যায়। এই সম্প্রদায়ের সবাই হিন্দু। আর পাকসেনাদের হিন্দুবিদ্বেষের কথা ততদিনে সুস্পষ্ট।
ভাজি-পরোটার প্রথম গ্রাসটি মাত্র মুখে তুলেছেন গঙ্গামা। ভারী বুটের শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠেন তরুণী গঙ্গামা। পালাবার পথ খোঁজেন তিনি। কিন্তু ততণে দেরি হয়ে গেছে।
ততণে পাকসেনাদের আরেকটি দল সুইপার কলোনির ভেতরে ঢুকে বন্দুকের মুখে বের করে এনেছে প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষকে। আতঙ্কিত গঙ্গামা দেখেন, পিঠে রাইফেলের নলের গুঁতো খেয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে আসছেন তাঁর স্বামী বজরঙ্গি পাইড়িয়া। কর্কশ কণ্ঠে উর্দুতে আদেশ আসে, শহর পরিষ্কার করতে হবে।
২৬ মার্চ সকালে ঢাকা শহরের রাজপথে লাশের স্তূপ, রক্ত। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বাংলাদেশে নৃশংস যে গণহত্যা হয়েছিল, ঘাতক পাকবাহিনী বিশ্ববাসীর চোখ থেকে তা আড়াল করতে চায়। দ্রুত শহর পরিষ্কার করা, রাজপথে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো সরিয়ে ফেলা একান্ত প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাসে অস্পৃশ্য ‘মেথর’দের কথা বিন্দুপরিমাণ স্থানও কি পেয়েছে? অথচ যুদ্ধের সময় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকবাহিনীর হাতে তাঁদেরও প্রাণ দিতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের পরিবারের কাছে। রাজধানীর বিভিন্ন সুইপার কলোনিতে আজও ইতিহাসে উপেতি প্রবীণ-প্রবীণারা সেসব দিনের কথা মনে রেখেছেন।

হটাও লাশ, সাফ কর চিহ্ন: বৃদ্ধা গঙ্গামা, নুকামা, ভেঙ্কিয়ামা, রাভানামা ও আপ্পা লারা সামা এখন থাকেন আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের পাশের সুইপার কলোনিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা নগর কর্তৃপরে চাকরিতে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। বৃদ্ধ গাড্ডাম নাইড়–, বজরঙ্গি পাইড়িয়া, রামুসহ আরও অনেকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাঁরা বিদায় নিলে হারিয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের না-জানা একটি অধ্যায়।
ভাঙা ভাঙা বাংলা, তেলেগু আর উর্দু ভাষা মিশিয়ে কথা বলেন গঙ্গামা। আজও যেন চোখের সামনে দেখতে পান, এভাবে তিনি বলে চলেনÑ২৬ মার্চ সকালে শহরের নানা জায়গায় ছিল লাশের স্তূপ। তাঁদেরকে বড় বড় ট্রাকে লাশগুলো তুলতে বাধ্য করে পাকসেনারা।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কুড়িয়ে তোলা লাশগুলোর সঙ্গে গঙ্গামাদেরও ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজারে। সে সময় ওই এলাকা ছিল জনবসতিশূন্য বিল অঞ্চল। ট্রাক থেকে মৃতদেহগুলো বিলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলতে বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
গঙ্গামার মনে নেই, কতগুলো মৃতদেহ সেদিন বহন করেছিলেন। কিংবা হয়তো এই বিপুল সংখ্যা গণনা করার মতো বোধ তখন তাঁর ছিল না। তবে মৃতদেহের সঙ্গে পড়ে থাকা আধমরা বাঙালিদের কাতর প্রাণভিার কথা মনে করে এখনো চোখ ভিজে ওঠে তাঁর।
গঙ্গামা বলেন, রাস্তায় পড়ে থাকা আধমরা মানুষেরা ‘পানি পানি’ বলে কাতরাচ্ছিলেন। বর্বর পাকসেনাদের কেউ কেউ রাজপথে প্যান্ট খুলে তাঁদের মুখে পেশাব করে দেয়, এরপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে হতভাগ্যের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
আজকের ৫৪ বছরের আপ্পাও তখন টগবগে তরুণ। প্রতিদিন ঝাড়– আর বালতি নিয়ে কাজে যেতেন তিনি। যুদ্ধ চলাকালে একদিন পাকসেনারা তাঁকে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে, যেটি এখন গণভবন। সেখানে গুলিবিদ্ধ বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল। প্রথমে ঝাড়– দিয়ে রক্ত পরিষ্কারের নির্দেশ আসে। তারপর লাশ সরানোর পালা।
২৬ মার্চ থেকে প্রায় প্রতিদিন এভাবে মৃতদেহ বহন করতে হয়েছে এই পরিচ্ছন্নকর্মীদের। অনেক সময় ট্রাক পাওয়া না গেলে ময়লা ফেলার ঠেলাগাড়িতে লাশ নিয়েছেন। কখনো কাঁধে করে মৃতদেহ বহন করতে হয়েছে।
পচা-গলা লাশ তুলতে সামান্যতম দেরি দেখলেই নেমে আসত অকথ্য গালি, বুটের লাথি। মদের বোতল তুলে দেওয়া হতো হাতে। জোর করে মাতাল করে তারপর বাধ্য করা হতো মৃতদেহ বহন করতে।

বন্দিশিবিরে গোপন বন্ধু: মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষ্ণা দাসের বয়স ছিল ১৮। এখন লালবাগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন তিনি। একাত্তরে ঢাকা পৌরসভার কর্মী কৃষ্ণা দাস কাজ করতেন ফার্মগেট এলাকায়। এখন যেটা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সেখানে তখন পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সহায়তাকারীদের নিয়ে আসত।
এই বন্দীদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এখান থেকে কেউই জীবিত ফিরতে পারতেন না। কৃষ্ণা দাসসহ ফার্মগেট এলাকার পরিচ্ছন্নকর্মীদের এই লাশগুলো মাটিচাপা দিতে হতো। ঘরের মেঝে থেকে রক্ত ও বন্দীদের মলমূত্র পরিষ্কার করতেন তাঁরা।
ধাঙ্গড়দের পাকসেনারা ততটা গুরুত্ব দিত না, তাঁদের ব্যাপারে সতর্কও থাকত না। আর তাই মলমূত্র সাফ করার সময় বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেতেন কৃষ্ণা। এভাবেই একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পরিবারের সদস্যদের ঠিকানা নিয়ে অসহায় বন্দীর শেষ বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের পরিবারের কাছে।
একবার কৃষ্ণা এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার খবর পৌঁছে দেন মালিবাগ এলাকায় তাঁর পরিবারের কাছে। কিন্তু অকুতোভয় ওই কিশোরের বাবা বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর আগেই নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করা হয়। এমনি অনেক স্মৃতি জমা হয়ে আছে কৃষ্ণার মনে।

ইতিহাসে বিস্মৃত, উপেক্ষিত: নাজিরাবাজার, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় দলিত বা হরিজন পরিচ্ছন্নকর্মীরা প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের পে কাজ করার জন্য পাকসেনাদের হাতে তাঁদের যে স্বজনেরা নিহত হয়েছিলেন, শহীদের তালিকায় তাঁদের নাম ওঠেনি। কোনো স্বীকৃতি পাননি তাঁরা, পাননি ন্যূনতম কোনো সুবিধা।
পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার সুইপার কলোনিতে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে ২২ নভেম্বর পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে ১০ জনকে। এঁদের মধ্যে কাঁধে গুলি নিয়ে প্রাণে বেঁচে যান রামদীন। পরে তিনি যুদ্ধ চলাকালেই ভারত চলে যান।
নাজিরাবাজারে সুইপার কলোনিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১০ জন পরিচ্ছন্নকর্মীর নাম বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্তম্ভ। একাত্তরের ২২ নভেম্বর পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে এ সম্প্রদায়ের মাহাবীর সামুন্দ, আনবার লাল, নবেন্দু লাল সরদার, ঈশ্বর লাল, ঘাসিটা, শংকর হেলা, লাল্লু, নান্দীলাল ও রামচরণকে। তাঁদের স্মরণে ১৯৭২ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে হরিজন সেবক সমিতি।

বি.দ্র. সাংবাদিক থাকাকালে কয়েক বছর আগে পত্রিকায় এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। ব্লগের পাঠকদের জন্য এখানে তুলে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে হরিজনদের ভূমিকা নিয়ে নিজ উদ্যোগে একটি গবেষণা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ১০:৩২
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×