somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্প্রতি পড়া বইঃ সৈয়দ মুজতবা আলীর চতুরঙ্গ

২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের ছোট জীবনটা অনেকটাই একঘেয়ে হয়ে যেত যদি জীবনে শিল্প সাহিত্য ব্যাপারগুলো না থাকতো। সুলিখিত বই, সুললিত সংগীত কিংবা সুঅংকিত চিত্রকলা নিদেনপক্ষে ভালো একটি সিনেমা, বেঁচে থাকার জন্য মানুষ এর এক বা একাধিকটির আশ্রয় প্রতিনিয়ত নিচ্ছে এবং নেবে।

তবে শিল্পের একটি ব্যাপার হচ্ছে শিল্প বা কলার কোন একটি শাখা থেকে তার ‘মজা’ বা ‘রস’ আস্বাদন করে নেয়ার ক্ষমতাটি সবসময় মানুষের প্রবৃত্তিজাত নয়। উচুমানের একটি সাহিত্য উপভোগ করার জন্য সাধারণ সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন অথবা, সংগীত এর ক্ষেত্রে, শুরুতেই কেউ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উপভোগ বা বুঝতে শিখেনা, উচ্চমার্গীয় এ শিল্পের রস আস্বাদনের জন্য প্রয়োজন কিভাবে রস আস্বাদন করতে হবে সে সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা। সেই দিক থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘চতুরঙ্গ’ বইটি বিভিন্ন শিল্প উপভোগে আগ্রহী পাঠকের ‘এলিমেন্টারি কোর্স’ হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা উঠলে রসগোল্লার কথা মনে পড়ে যাবার কথা। নবম দশম শ্রেণীতে পাঠ্য ছিলো রম্যগল্পটি।
“রসের গোলক! এতো রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়।
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইলো তব পায়।”


সৈয়দ মুজতবা আলী

কে ভুলতে পারে এর কথা! রম্য লেখনীতে মুজতবা আলীর জুড়ি নেই তা তখনই বুঝেছিলাম। তাই এবার যখন তার ‘চতুরঙ্গ’ বইটি হাতে পেলাম তখন উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম বিদগ্ধ এই লেখক সম্পর্কে আরো জানবার জন্য।
বইটির আওতা ব্যাপক এবং নানাবিধ হলেও ৪৩টি অধ্যায়ের বেশিরভাগটিতেই স্থাপত্য শিল্প থেকে শুরু করে সঙ্গীত, চলচ্চিত্র সহ অন্যান্য কলার রস আস্বাদনের নানা দিক বর্ণনা করা হয়েছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বই এর মূল বিষয় গুলি ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ হলেও নানা দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ১৫টি ভাষায় পারদর্শী লেখকের সুলেখনীর কারণে খুটিনাটি গুলো পাঠকের কখনো একঘেয়ে মনে হবেনা বরং ঐ সব বিষয়ে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামতের অন্তর্ভূক্তি অধ্যায় গুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হাসি ঠাট্টা নিয়ে বই এর প্রথম অধ্যায় রবি পুরাণ। লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথের জীবনের লাইটার সাইড গুলোই তার এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।

নসরুদ্দিন খোজার ওপর লিখিত লেখকের একটি পরিচিত রচনা এই বই এর অন্তর্ভূক্ত। যতদূর জানি, এই প্রবন্ধটি আমাদের কোন একটি শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং ওমর খৈয়াম এর উপর তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে একটি অধ্যায়ে। কবিদ্বয়ের মধ্যে নানাবিষয়ে পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু একটি দিক দিয়ে তাদের মধ্যে মিল পাওয়া যায়। তারা দুজনেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তাদের সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে। কবি নজরুল বিরোধিতা করেছিলেন তকালীন ব্রিটিশ শোষকদের অনাচারের আর ওমর খৈয়াম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তখনকার ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে।

ত্রিমূর্তি (চাচা কাহিনী)’, ‘গাঁজা’ সৈয়দ মুজতবা আলীর ট্রেডমার্ক রম্য গল্প। পাঠক তার হাসি আটকিয়ে রাখতে পারবেননা এগুলো পড়লে।
মামদোর পুনর্জন্ম’ নামক একটি অধ্যায়ে লেখক বলেছেন-পূর্ব বাংলাই বাংলা ভাষার চরিত্র আর বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখবে। অতীতে এই ভাষার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝঞ্চা গিয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় কেউ না কেউ উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ভাষাকে রক্ষা করেছে প্রয়োজনে তা বুকের রক্ত দিয়ে হলেও। এই প্রবন্ধের নামকরণ সম্পর্কে লেখক বলেছেন-
“’মামদোরই’ যখন কোন অস্তিত্ব নেই তখন তার পুনর্জন্ম হবে কি প্রকারে? পুব বাংলার লেখকদের স্কন্ধে আরবী ফার্সি শব্দের ‘মামদো’ ভর করবে আর তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আরবী ফার্সি তে অর্থা, ‘যাবনী মেশালে’ কিচির মিচির করতে থাকবে, বিজাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করবে যার মাথা মুন্ডু পশ্চিম বাংলার লোক বুঝতে পারবেনা সে ভয় ‘স্বপ্ন, মায়া, মতিভ্রম’।”

এছাড়াও ‘দিল্লী স্থাপত্য’ নামক অধ্যায়ে স্থাপত্য শিল্প, তার কম্পোজিশন, ভারতের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।‘ফরাসি বাংলা’, ‘ইভান সের্গেভিচ তুগেনফ’ ও অন্যান্য প্রবন্ধ থেকে বিদেশি শিল্পের ওপর লেখকের পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। Abstract বা Modern Art নিয়ে মজাদার আলোচনা করা হয়েছে একটি অধ্যায়ে। সুইডেন এর একটি exhibition এর ঘটনা যেখানে কর্তৃপক্ষ শিল্পীর তুলি পোছার কাগজটিকে অমূল্য কোন Abstract চিত্র ভেবে শো তে লটকিয়ে দিয়েছে। লেখকের প্রশ্ন শিল্প কি তাহলে শুধু সৃজনশীলতা নয় দুর্ঘটনার মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে??

হিন্দি ফিল্ম এর উদ্ভট প্লট, ডায়লগ আর ইন্ডিয়ান দের বেহুদা স্বজাত্যভিমান এর জন্য হিন্দি ফিল্ম এর প্রতি আমার একটু চুলকানি আছে। কিন্তু মুজতবা আলীর মত কাউকে বলতে শুনিনি আজ পর্যন্ত! হিন্দি মুভি সম্পর্কে তাঁর এই মন্তব্যটি বাঁধিয়ে রাখার মত!

-“আমি এ জীবনে তিনখানা হিন্দি ছবিও দেখিনি এবং অন্য কোন পাপ করিনি বলে এই পূণ্যের জোরেই স্বর্গে যাবো বলে আশা রাখি। তবে বলা যায়না, সেখানে হয়তো হিন্দী ছবি-ই দেখতে হবে। যদি প্রশ্ন শোধান, সে কি করে হয়? – তুমি হিন্দী ফিলিম বর্জন করার পূণ্যে স্বর্গে গেলে, সেখানে আবার তোমাকে ঐ ‘মাল’ই দেখতে হবে কেন? তবে উত্তরে নিবেদন, কামিনীকাঞ্চনসুরা বর্জন করার জন্য আপনি যখন স্বর্গে যাবেন তখন কি ইন্দ্রসভায় ঐ গুলোরই ছড়াছড়ি দেখতে পাবেননা?”

একটি দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সবচাইতে অকাজ এর অংশটি সম্ভবত এর সেন্সর বোর্ড। আমাদের দেশেই দেখুন না এমন সেন্সর ই তারা করে যে মেহেরজান এর মত ছবিও মুক্তি পেয়ে যায়! লেখকের এ বিষয়ক একটি মন্তব্য তুলে দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

“সেনসর বোর্ড ফোর্ড ও তখন শিশু, এখনকার মত জ্যাঠা হয়ে উঠেনি, কাজেই হরেক রুচির ফিল্ম তখন এদেশে অক্লেশে আসত এবং আমরা সেগুলো গোগ্রাসে গিলতুম, তার ফলে আমাদের চরিত্র সর্বোনাশ হয়েছে সে কথা কেউ কখনো বলেনি এবং আজ যে সেন্সর বোর্ডের এত কড়াকড়ি, তার ফলে এ যুগের চ্যাংড়া চিংড়িরা যীশুখেস্ট কিংবা রামকেষ্ট হয়ে গিয়েছে এ মস্করাও কেউ করেনি”

হায়! সেন্সর বোর্ড যুগে যুগে একই রকম ছিলো!
সব মিলিয়ে বলা যায় সুখপাঠ্য একটি বই যা যা আপনাকে অবসরে বিনোদনের পাশাপাশি তথ্য এবং বেচে থাকার উসাহের খোরাক যোগাবে। চতুরঙ্গের মতই এ বই এর আওতা ও নানা দিকে বিস্তৃত। কাজেই নামকরণ ও স্বার্থক তা বলাই বাহুল্য।


এক নজরেঃ
নামঃ চতুরঙ্গ
লেখকঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
জেনারঃ প্রবন্ধ/নন-ফিকশন
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৫৮
বাংলাদেশে বর্তমান প্রকাশকঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশকালঃ বইমেলা’২০১২
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা।
পৃষ্ঠাঃ ১২৮
মূল্যঃ ১৫০ টাকা।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৪০
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×