ব্যাংক থেকে আর ঋণ নেবে না সরকার। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে বেশি সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের সামনে আর কোন বিকল্প না থাকায় বন্ড ছেড়ে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহের একমাত্র বিকল্প ভাবা হচ্ছে। একটি দেশের ঋণমানের ওপর নির্ভর করে বন্ড ছেড়ে এ ধরনের ঋণ গ্রহণ করা হয় বলে এটিকে সার্বভৌম (সভরেন) ঋণ বলা হয়। এ ধরনের ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। আর্থিক সংকট মারাত্মক না হলে কোন রাষ্ট্র এ ধরনের ঋণ নেয়ার বিষয়ে চিন্তা করে না। বাংলাদেশে কোন সরকারই এর আগে এ ধরনের সার্বভৌম ঋণ গ্রহণ করেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় এ ধরনের ঋণের প্রভাব সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরকে পরামর্শ দেন অর্থমন্ত্রী।
সূত্র জানায়, সভরেন ঋণ নেয়ার ব্যাপারে গত মাসে সরকার আগ্রহ দেখানোর পর অর্থনীতিবিদরা বিষয়টিকে বিপজ্জনক বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু সরকারের ব্যয় যেভাবে বাড়ছে সে হারে আয় হচ্ছে না। এর ওপর রয়েছে অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপ। সব মিলিয়ে ব্যয় সামলাতে আর কোন বিকল্প দেখছে না সরকার।
জানা গেছে, সরকারের সামনে এখন নানামুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় সামলাতে নগদ টাকা দরকার, অন্যদিকে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের দায় মেটাতে দরকার বৈদেশিক মুদ্রা। অভ্যন্তরীণ ঘাটতি ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলেও বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সরকার পদ্মা সেতু বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পে যে ধরনের বৈদেশিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছিল সে পরিমাণ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতু নিয়ে অনিশ্চয়তা সংকট আরও গভীর করেছে। এ অবস্থায় আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছে বাজেট সহায়তা পাওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চলছে। তবে দাতা সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপসহ প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতার কারণে এখন দেশের বাইরে বেসরকারি খাত থেকে সভরেন ঋণ গ্রহণের বিষয়টিকে একমাত্র বিকল্প ভাবছে সরকার।
জানা গেছে, সভরেন ঋণ নিতে গেলে সরকারকে অতিরিক্ত সুদ গুণতে হবে। এর ফলে সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাবে বাজেটে। কিন্তু বিওপি চাপ আর সরকারের ব্যয় মেটাতে আর কোন বিকল্প না থাকায় অধিক সুদে বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। সূত্র জানায়, সভরেইন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। মূলত এ ধরনের ঋণের সুদের হার নির্ণয় হয় দেশটির ঋণমানের ওপর। গত দু'বছর ধরে বাংলাদেশের ঋণমান নির্ণয় করে আসছে আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর ও মোদি। এই ঋণমান অনুসারে সভরেন ঋণ নিলে সুদের হার কত হতে পারে এবং তাতে বাজেটে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে ১০ বছর মেয়াদে বন্ড ছেড়ে এ ধরনের ঋণ গ্রহণ করেছে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ঋণমান সমপর্যায়ের হওয়ায় সুদের হার কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সামগ্রিক মুদ্রাপ্রবাহ (এম২) এবং ঋণপ্রবাহ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মুদ্রানীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ধরে সামগ্রিক মুদ্রাপ্রবাহ ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ঋণপ্রবাহ ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৮ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু ব্যাংক খাত থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে মুদ্রানীতিতে মুদ্রাপ্রবাহের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্ক করা হয়েছে। যে হারে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে, সেটি অব্যাহত থাকলে মুদ্রা প্রবাহ আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে সেটি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। এর বাইরে ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ বাড়লে একদিকে যেমন বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হবে অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা অসম্ভব হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব কিছু বিবেচনা করেই সরকার শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের সভরেন ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর করবে। তিনি বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর ঋণে নীতিগত শর্ত থাকলেও সুদের হার কম কিন্তু সভরেন ঋণে যে ধরনের সুদের হার সেটি সরকারের দায় বাড়িয়ে দেবে। আর অনুন্নয়ন ব্যয় বিশেষ করে ভর্তুকি সামাল দিতে যদি এ ঋণ নেয়া হয় তবে সরকারের দায় আরও বেড়ে যাবে।
সূত্র : সংবাদ , ২৮ নভেম্বর ২০১১