somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা কেন শিক্ষক হলাম?

২৩ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আদনান মান্নান, ইরফান নেওয়াজ খান, মো. মোমিনুর রহমান, ফাতেমা জোহরা, অলক বিশ্বাস, সজল চৌধুরী |

লেখকেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি, আইআইইউসি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েটের শিক্ষক।

যাত্রার শুরুটা অনেক বিশাল স্বপ্ন নিয়ে, অন্য রকম লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য বাসনা নিয়ে। সে কারণেই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ বেতনের হাতছানি, বিদেশে পড়তে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ, মিডিয়া ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝলমলে আলোর আকর্ষণ উপেক্ষা করে আমরা চলে এসেছিলাম শিক্ষকতা পেশায়। যখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. আনিসুজ্জামান, ড. হাসিনা খান কিংবা ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো স্বাপ্নিক শিক্ষকদের কথা শুনতাম, তখন উদ্বুদ্ধ হতাম এবং ভাবতাম, আমাকেও শিক্ষক হতে হবে। শিক্ষক হয়ে স্বপ্ন দেখব, স্বপ্ন দেখাব—এগিয়ে যাব গবেষণার অদম্য অনুপ্রেরণায়। কিন্তু সেই ভিন্ন পথের পথিক এই আমরাই আজ নির্বাক, বিধ্বস্ত। যখন দেখি, দেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন ছাত্রী। যখন দেখি, একজন শিক্ষক ধর্ষণ করে তার ছাত্রীকে, উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকেরা যখন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে একজন আরেকজনকে জুতাপেটা করেন। যখন শুধু ক্লাসে প্রশ্ন করার অভিযোগে শিক্ষিকার হাতে প্রহূত হয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো ছাত্রী—তখন সত্যিই নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে পড়ি। সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে আমাদের শিক্ষক পরিচয়, বারবার মনে একই প্রশ্ন উঁকি দেয়—আমরা কেন শিক্ষক হলাম?
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। শিক্ষক পরিচয়টি বারবার এবং বারবার হচ্ছে কলঙ্কিত। নৈতিকতা ও মানসিক বিকৃতি কতটুকু নিম্ন স্তরে নামলে একজন মাদ্রাসাশিক্ষকের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তার ছাত্র? যে শিক্ষকের সবাইকে আলো দেখানোর কথা, মানবিকতা ও সত্যের শিক্ষা দেওয়ার কথা, সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নবিরোধী আইন তৈরি হচ্ছে। এই বাস্তবতায় নিজেকেই নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। বিষণ্নতার মুহূর্তগুলো আরও বেশি দীর্ঘ হয়, যখন দেখি একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন হয়ে যায় শিক্ষকের ডেস্কবন্দী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২৮ ভাগ শিক্ষকের পড়ানোর মান সন্তোষজনক নয়। অজান্তেই মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, আমরা কি আসলেই ঠিকভাবে পড়াতে পারছি? নিজেদের মানের ব্যাপারেই সন্দিহান হয়ে পড়ি। কবি আবুল হাসানের মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘আমার কেবলই রাত হয়ে যায়...।’
এমন কেন হচ্ছে? প্রশ্নটি বারবার আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একজন শিক্ষককে চাকরির শুরুতে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে কোনো উদ্বুদ্ধকরণ বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য কোনো রকম প্রশিক্ষণেরই ব্যবস্থা নেই। যেকোনো শিক্ষককে শিক্ষকতা শুরু করার আগে নৈতিকতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধের ঠিক কোন স্তরে তার অবস্থান—এ সম্পর্কে অবহিত করা উচিত, ছাত্রছাত্রীদের সহযাত্রী হয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি থাকা উচিত। আমরা বলছি না যে এ ধরনের কর্মসূচি বা প্রশিক্ষণ অনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারবে, কিন্তু একজন শিক্ষককে অন্তত তার দায়বদ্ধতা ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করবে।
আমরা সবাই শিক্ষকতা শুরু করেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর মধ্যে শিক্ষকতার মানোন্নয়ন এবং কার্যকরভাবে ক্লাস নেওয়া কিংবা যথাযথ পাঠদান বিষয়ে আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই একদিন ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিতে হলো যোগদানের পরপরই। এভাবে কি শিক্ষকদের মানোন্নয়ন সম্ভব? আমাদের প্রস্তাব হলো, তরুণ শিক্ষকদের জন্য চাকরির শুরুতেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ইউজিসি এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তরুণ শিক্ষকদের পেশাগত জীবনের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতি ও গবেষণার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটি শিক্ষকতার মানে উৎ কর্ষ অর্জনে সহায়তা করে। আমাদের দেশেও কি এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় না?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ নামক একটি বিধান থাকলেও তাতে এ বিষয়ে কী আছে, আমাদের তা জানা নেই। আমাদের এসব জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, প্রস্তাবিত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হলে, আগামী ১০ কিংবা ১৫ বছর পর আমাদের তরুণ শিক্ষকদের প্রজন্মটি যখন নৈতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মান অর্জন করে নেতৃত্বে আসবে, সেদিন হয়তো বা আর ছাত্রী নির্যাতন হবে না, জুতা ছোড়াছুড়ি হবে না, পরীক্ষার খাতা ডেস্কবন্দী থাকবে না কিংবা পড়ানোর মান অসন্তোষজনক হবে না।
শরীরের কোনো অংশে যদি ক্যানসার হয়, তা খুব দ্রুত পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকতার জায়গাটিও সমাজে তেমন। এটি প্রোথিত আছে সমাজের শেকড়ে। শিক্ষকতায় পচন ধরলে অতিদ্রুত তা ছড়িয়ে যাবে পুরো সমাজে। তার মানে এই নয়, পুরোটাই চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। আমরা বিশ্বাস করি, এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের মধ্যে এখনো অনেক শিক্ষক আছেন নিজের মাহাত্ম্য, স্বাতন্ত্র্য ও আলোকিত সত্তা নিয়ে। আমরা আলোর সন্ধানে আপনাদের পথ চেয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি সঠিক পদক্ষেপের।

:((:((:((
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×