somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সোনার মেডেল

২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জীবনে বেশ কয়েকবার সোনার মেডেল পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটার সাথে কাহিনী আছে।

প্রথমবার পেয়েছিলাম মেট্রিক পরীক্ষায় স্কুল থেকে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করার জন্য। মেডেলটা দিয়েছিল জনৈক শিক্ষা-মন্ত্রী। আমি এতটাই হাবলা ছিলাম যে সেই মন্ত্রীর নাম পর্যন্ত জানতাম না। আমি হাবলা রয়ে যাওয়ার কারণে সেই মন্ত্রীর নাম এখনও জানি না। স্কুলে বিশাল অনুষ্ঠান করে মেডেল দেওয়া হয়েছিল। আমি এতটাই হাবলা ছিলাম যে মন্ত্রীর কাছ থেকে মেডেল নেওয়ার কোন ছবি আমি তুলি নাই। ভিডিও থাকার তো প্রশ্নই আসে না। আমিন জুয়েলার্সের তৈরি সেই মেডেলটা অবশ্য এখনো আছে। কিন্তু সেটা দেখালে কেউ বিশ্বাস করে না যে আমার মত একজন বিশিষ্ট হাবলু ওটা অর্জন করেছিল। এমন মেডেল তো জুয়েলারির দোকানে অর্ডার দিয়ে হরহামেশাই বানানো যায়। যেই দেশে মানুষ PhD ডিগ্রীও অর্ডার দিয়ে কিনে নিচ্ছে সেই দেশে আমার সোনার মেডেল তো কোন ছাড়।

স্কুলে যেদিন অনুষ্ঠান করে মেডেল দেওয়া হল সেদিন স্কুলে গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। মাঠে বিশাল প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। সেখানে নানাবিধ অনুষ্ঠান, খেলাধুলা চলছে। কিন্তু মেডেল দেওয়ার অনুষ্ঠান দেখতে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব আসে নাই। ওদের দোষ দিয়ে লাভ কি? আমার নিজের বাপও তো আসে নাই। আর আমার বন্ধুর বাপের নিশ্চয়ই এত তেল নাই যে আমার মেডেল দেওয়ার অনুষ্ঠান দেখতে সপরিবারে উপস্থিত হবেন। বরং এই সময়টা উনারা হয়ত নিজের ছেলেদের পিঠে উত্তম-মধ্যম দিচ্ছিলেন এই কারণে যে আমি মেডেল পেলাম, কিন্তু উনার ছেলেরা তো পেলেন না। উনাদের জ্বালা আমি বুঝতাম। তবে এই মেডেল দেওয়ার অনুষ্ঠানে আম্মা আমার বোনকে নিয়ে এসেছিল। তা না হলে লোকে কি বলবে!

আমি সেই মেডেল দেওয়ার অনুষ্ঠানে স্কুল ড্রেসের সাথে পুরানো জুতা পড়ে গিয়েছিলাম। মানে যেই জুতা দিয়ে স্কুলে ফুটবল খেলতাম সেটা পড়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মন্ত্রীর সামনে যে কালি করা ভালো জুতা পড়ে যেতে হয় সেটা আমাকে কেউ বলে দেয় নাই। আমার হতশ্রী অবস্থা দেখে স্কুলের সবাই ভিতরে ভিতরে একটু বিরক্তই বটে। অবশ্য মেডেল নেওয়ার জন্য তো আমাকে আর মন্ত্রীর সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা নাচ-গান করা লাগবে না। খুব বেশি হলে এক মিনিটের মামলা। বেশি হলে আরো দুই মিনিট নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে হবে। মানে আমাকে বলতে হবে কিভাবে এই মেডেল পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। সেই সাথে শাসক-গোষ্ঠীর সুশাসন কিভাবে আমার ভালো ফলাফলে নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে সেই সবের ফিরিস্তি একটু দিতে হবে। তাই, ময়লা জুতার কারণে সবাই একটু গাঁই-গুই করলেও মেনে নিল। আর মেনে না নিয়েও তো উপায় নাই। আমার মেডেল তো আর অন্য কাউকে দিতে পারবে না। চেহারা আর শ্রী যদি এতই মূল্যবান হয় তাহলে তো ওরা সিনেমার নায়ক এনে মেডেল দিলেই পারে। খুব সম্ভবত ময়লা জামা-কাপড়ের কারণে মন্ত্রী সাহেব আসার আগ-মূহূর্ত পর্যন্ত আমাকে দায়িত্ব দেয়া হল স্কুলের ট্রাফিক কন্ট্রোল করার।

আমার স্কুলটা ছিল খুব বিশাল। এর মাঠের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। এর মাঝে গাছপালা ঘেরা ছায়া-সুনিবিড় ছাত্রাবাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই রকম একটা স্কুলের ভিতর গোল-চক্করের মত একটা জায়গায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিলাম। মানে অতিথিদের গাড়িগুলোকে হাতের ইশারায় কোথায় পার্ক করতে হবে সেটা দেখাচ্ছিলাম। আমাকে বার বার করে বলে দেওয়া হয়েছে যে মন্ত্রীর গাড়ির সাথে যেন কোনভাবেই বেয়াদবি না করি। একটা গাড়ির সাথে মানুষ কিভাবে বেয়াদবি করে আমার মাথায় তখন ঢুকে নাই, এখনও ঢুকে না, ভবিষ্যতেও ঢুকবে না। আসলে আমি তখনও হাবলা ছিলাম, এখনো হাবলা আছি, ভবিষ্যতেও হাবলা থাকব। তাই এইসব চিন্তা না করে নিষ্ঠার সাথে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিলাম। হাবলাদের ভয়-ডর কম থাকে।

ট্রাফিক কন্ট্রোল করার সময় দেখি একটা বিশাল কালো পাজেরো গাড়ি খুব জোরে স্কুলের গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকল। আমি হাবলা হলেও স্কুলের ভিতরে যে একটা গাড়ি এত জোরে চলতে পারে না সেটা বুঝতে পারা আমার জন্য কষ্টকর ছিল না। তাই হাত তুলে গাড়ি থামালাম। গাড়ির ড্রাইভার জানালা খুলে কর্কশ গলায় বলল, “তুমি জানো, এটা মন্ত্রীর গাড়ি।”

আমি ততোধিক অবাক হয়ে বললাম, “মন্ত্রীর গাড়িতে পতাকা কই?”

বলেই বুঝলাম, আমি আসলে কেন হাবলা। সাথে সাথে অনেকেই দৌড় দিয়ে এসে ড্রাইভারকে স্যার-ম্যার বলে গাড়ি জায়গামত পার্ক করে দিল। মন্ত্রীর ড্রাইভারের সামনে ওদের কাঁপা-কাঁপির কারণে আমাকে আর কেউ আলাদাভাবে লক্ষ্য করে নাই সেদিন।

এরপরে আগডম-বাগডম বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরে ভালয় ভালয় কোনমতে মেডেল গলায় ঝুলিয়ে বাসাতে চলে আসলাম।

পরেরদিন স্কুলে গেলে বন্ধুরা সোনার মেডেল পাওয়ার ছবি দেখতে চায়। আমি বলি, “ছবি নাই।”

সবাই বলে, “এমন একটা ঘটনার ছবি কেন থাকবে না?”

আমি বলি, “আমার ছবি তোলার কথা মাথাতে আসে নাই।”

সবাই বলে, “তোকে কি সত্যি সোনার মেডেল দিয়েছে?”

“সোনার মেডেল” কথাটা বলার সময় সবাই কেমন যেন “সোনা” কথাটা একটু ইঙ্গিতপূর্ণভাবে জোর দিয়ে বলছিল। এক দুষ্ট ছেলে তো বলেই বসেছিল, “মন্ত্রী ওরে সোনা একেবারে ভরে দিছে।”

এই কথাতে কি এমন গভীর তাৎপর্য ছিল বুঝতে পারিনি। কিন্তু সবাই বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হো হো করে হেসেছিল। আমি হাসার তেমন কিছু খুঁজে পাই নাই বলে হাসি নাই। আসলে হাবলা ছিলাম তো!

তো এই ঘটনার পর টুকটাক অনেক কিছু পেলেও সোনার মেডেল অনেকদিন পাইনি। এরপরের সোনার মেডেল পেলাম প্রায় এক দশক পর মালয়শিয়াতে। সেটাও এক মালয়শিয়ার মন্ত্রীর কাছ থেকে। আগের মত হাবলা থাকার কারণে এইবারেও মন্ত্রীর নাম আমি জানতাম না। এইবারেও ক্যামেরাতে ক্লিক করতে ভুলে গেছি। কিন্তু ততদিনে দুনিয়া বেশ এগিয়ে যাবার কারণে সবার হাতে-হাতে ক্যামেরা চলে এসেছে। তাই রক্ষা। ছবি চাইলে এবার হয়ত দেখানো যাবে। সেই গল্প এখন বলছি।

***

২০১০ সালের এক শেষ বিকেলে আমি আর সিলেং তে ল্যাবে বসে কফি খাচ্ছি আর গল্প করছি। এমন সময় সুপারভাইজার ফোন করে দুজনকেই উনার রুমে আসতে বললেন। কফি শেষ করে ধীরে-সুস্থে উনার রুমে গেলাম।

সুপারভাইজারকে দেখে খুব খুশি মনে হল। এর মানে উনি আমাদের কোন কাজ দিবেন। উনি বললেন কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে একটা এক্সিবিশন হবে যার নাম International Invention, Innovation and Technology Exhibition (ITEX)। উনি চান আমি আর সিলেং তে যেন সেখানে পার্টিসিপেট করি। আমাদের দুই জনের কাজ এক করে কিছু একটা সাবমিট করার আইডিয়াও উনি দিলেন। উনার মতে এটা খুবই প্রেস্টিজিয়াস এক্সিবিশন। পুরস্কার হিসাবে সোনার মেডেল আছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও গবেষণাগার থেকে হাজার হাজার ছাত্র, গবেষক, বিজ্ঞানী সেই এক্সিবিশনে যোগ দিবেন।

আমি আর সিলেং তে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। এক্সিবিশনের আছে আর মাত্র দুই-সপ্তাহের মত। এর মাঝে কাজ ঠিক করতে হবে, প্রোটোটাইপ বানাতে হবে, পোস্টার তৈরী করতে হবে, কাজের ছোট্ট লিফলেট মানুষকে বিলানোর জন্য বানাতে হবে এবং বলা বাহুল্য আরো হাজার রকমের প্যারা সামলাতে হবে। এর মানে আগামী দুই সপ্তাহ আমাকে আর সিলেং তে-কে ল্যাবকেই ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলতে হবে।

কি আর করা! দিন-রাত খাঁটা-খাটুনি করে দুইজনে মিলে কিছু একটা দাঁড় করালাম। এরপর পোস্টার বানালাম। হাবলা মানুষজনও যেন আমাদের কাজ-কর্ম বুঝতে পারে সেজন্য একেবারে অমানুষিক পরিশ্রম করে লিফলেট বানালাম যাতে একেবারে অজ্ঞ লোকেও এই লিফলেট দেখে বুঝতে পারে এই কাজের কি মাহত্ম্য। কত যে ভাষাগত জ্ঞান, মানুষের সাইকোলজির উপর জ্ঞান, জটিল জিনিস কয়েকটা রেখার মাধ্যমে চিত্র এঁকে প্রকাশ করার জ্ঞান সহ আরো বিবিধ রকমের জ্ঞান এই লিফলেট বানাতে প্রয়োগ করা লাগল তা বলার মত না। এমন কি লিফলেটের ব্যাকগ্রাউন্ড কালার এর উপর কি রঙের অক্ষর কোন ফন্টে ব্যবহার করলে মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে সেই বিষয়েও বিস্তর গবেষণা চলল।

***

অবশেষে শুরু হল বেশ কয়েকদিন ব্যাপী সেই বিশাল এক্সিবিশন।

আমাদের সুপারভাইজার প্রথম দিনের সকালে কিছুক্ষণের জন্য এসে আবার চলে গেলেন। আমাদের বলে গেলেন যে আমাদের গ্রুপের সবকিছু আমাদের দুইজনকেই সামলাতে হবে। আমরা বললাম, “তথাস্ত। আপনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।”

উনি অবশ্য অতটা আশ্বস্ত হলেন না।

এই এক্সিবিশনে তামাম দুনিয়া থেকে বিশিষ্ট গবেষকেরা এসেছে। সবাই নিজের কাজ নিয়ে মহা গর্বিত। এইদিকে আমার আর সিলেং তে-এর ভিতর তেমন কোন উত্তেজনা নাই। গত দুই সপ্তাহে ইউনিভার্সিটির একঘেঁয়ে জীবন থেকে এক্সিবিশনের কয়দিন আমাদের জন্য হয়ে এল এক বিশাল ব্রেক হিসেবে। আমরা সেটাই উপভোগ করছিলাম। আমরা এক্সিবিশনে যাই বলতে গেলে ঘুরতে। লাঞ্চ ব্রেকের সময় পাশের টুইন টাওয়ারে গিয়ে ফটোশেসন করি, হরোস্কোপ মেশিনে হাত ঢুকিয়ে নিজেদের ভাগ্য গণনা করি, ভিডিও গেম খেলি। বিকালবেলা এক্সিবিশনের পরে টুইন টাওয়ারের লেকের আশেপাশে ছবি তুলি, মুভি দেখি। তারপর বেশ রাতে ট্রেনে করে বাসাতে ফিরি। এটাই আমাদের আনন্দ। এদিকে ফটোশেসন করতে গিয়ে কয়েকটা দামী ব্রান্ডের দোকান থেকে আমাদের রীতিমত বের করে দিয়েছে। দামী দোকানের ভিতরে ছবি তুললে নাকি তাদের এক্সক্লুসিভ কালেকশন মানুষ কপি করে ফেলবে। এইদিকে হরোস্কোপ মেশিনে ভাগ্য গণনা করতে গিয়ে আমাদের কাছে কয়েন না থাকার কারণে সিলেং তে রীতিমত অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে কয়েন চেয়ে আনছে। ওজন মাপার মেশিনে আমার ওজন সিলেং তে দেখলেও হাজার চেষ্টা করেও ওর ওজন আমাকে দেখতে দেয় নি। একবেলা আমি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ওকে লাঞ্চ করালে সে আমাকে ডিনার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে করিয়েছে।

এইদিকে এক্সিবিশনে অন্য সবার চেহারা খুব সিরিয়াস। এক-একজন যেন নিজের কাজ দিয়ে দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলার বাসনা নিয়ে এই এক্সিবিশনে এসেছে। ওদের সাথে বেশিক্ষণ কথা বললে আমাদের নিজেদের মূর্খ-মূর্খ লাগতে থাকে। তাই ওদের থেকে তফাতে থাকি।

এই এক্সিবিশনের এক কোণে বাচ্চাদের জন্যও একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের স্কুলের বাচ্চারা ওদের প্রজেক্ট নিয়ে এই এক্সিবিশনে এসেছে। আমি আর সিলেং তে বরং বাচ্চাদের প্রজেক্টের সামনে গিয়ে জ্ঞান ফলাই। আমাদের জ্ঞান দেখে বাচ্চারা নিজেদের মূর্খ-মূর্খ ভাবতে থাকে। যেমন, একটা উদাহরণ দেই।

একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা তাইওয়ান থেকে এসেছে। হ্যাংলা শরীর, চোখে চশমা। আমি আর সিলেং তে সেই বাচ্চাকে গিয়ে বললাম, “বৎস, তোমার প্রজেক্ট দেখাও।”

বৎস মহা আগ্রহে তার প্রজেক্ট দেখানো শুরু করল। তার প্রজেক্ট একটা বিশেষ রকমের নুডলস যেটা নাকি খুব স্বাস্থ্যপ্রদ, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। নুডলসের বিভিন্ন নমুনাও সামনে রাখা। সিলেং তে বৎসকে বলল, “তোমার এই নুডলস খেলে কি হয়?”

“স্বাস্থ্য ভালো হয়, বাচ্চাদের পুষ্টির ঘাটতি দূর হয়।”

“তাহলে তোমার স্বাস্থ্যের এই অবস্থা কেন? তোমার চোখে চশমা কেন? তুমি তোমার নুডলস খাও না?”

সিলেং তে-র এই প্রশ্ন শুনে বাচ্চাটা কেমন বিহবল হয়ে যায়। সে অনেক কিছুই বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। আমি আর সিলং তে “কিচ্ছু হয় নাই, কিচ্ছু পারে না” এই রকম ভাব নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।

আবার আরেকটা হংকং-এর বাচ্চার সাথে দেখা। সে নাকি এমন সেফটি কাটার তৈরি করেছে যেটা দিয়ে কাগজ-টাগজ ইচ্ছামত কাটলেও আঙ্গুল কাটবে না। সেই বাচ্চার ডান হাতের তর্জনিতে একটি ব্যান্ডেজ। ওকে যতই বলি যে তার সেফটি কাটার দিয়ে নিজের আঙ্গুল কাটছে কি না, সে ততই বলে ঘটনা নাকি অন্য জায়গায়। ঘটনা কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে খালি মিটিমিটি হাসে।

পরে আমি আর সিলেং তে বাচ্চাদের এইসব কান্ড নিয়ে হাসাহাসি করি। অনেকেই ভাবতে পারে আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ। হতে পারে। আমরা আমাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও হাসাহাসি করি। এটা সবাই পারে না। মানসিকভাবে অসুস্থরাই নিজেদের অসুস্থতা নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে।

***

দেখতে দেখতে এক্সিবিশন শেষ হবার দিন চলে এল। এইদিন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার কথা।

সবার কাছেই একটা খাম চলে এসেছে। খুলে দেখি আমাদের গ্রুপ সোনার মেডেল পেয়েছে। আমাদের পাশের দল ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছিল। ওদের কি অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম? ওরা জানাল ওরাও নাকি সোনার মেডেল পেয়েছে। সামনের এক কোরিয়ান গ্রুপকে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কি অবস্থা? ওরাও হাসতে হাসতে বলল সোনার মেডেলে পেয়েছে। এরপরে, যাকেই জিজ্ঞেস করি সেই বলে হয় সোনার, না হয় রুপার অথবা ব্রোঞ্জের মেডেল পেয়েছে। সেই নুডুলসওয়ালা বৎসের সাথে দেখা। সেও আমাদের দেখে বিরক্ত হয়ে জানাল যে সে সোনার মেডেলে পেয়েছে। আমরা তাকে তার বানানো নুডুলস বেশি বেশি খাবার পরামর্শ দিলাম। সে খুবই বিরক্ত হল। আবার সেই আঙ্গুল কাটা ছেলেটাও সোনা পেয়েছে। কাটা আঙ্গুল আর গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে সে মিটিমিটি হাসছে।

যেটা বুঝলাম সেটা হল এই এক্সিবিশনে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের অর্ধেকই হয় সোনার, না হয় রুপার অথবা ব্রোঞ্জের মেডেল পেয়েছে। যদিও সোনার মেডেল তেমন বেশি সংখ্যক গ্রুপ পায়নি, কিন্তু তাও সংখ্যাটা নেহায়ত কম না। একি পাগলের কারবার! কারা কিছুই পায় নাই আমরা তাদের খুঁজতে থাকি।

সেই সিরিয়াস গ্রুপগুলোর সাথে দেখা হয়ে গেল। বললাম, “তোমরাও কি সোনার মেডেল পেয়েছ?”

বেচারারা বিরক্ত হয়ে জানাল, ওরা কোন মেডেলই নাকি পায়নি। ঠিক এই সময় আমার স্কুল জীবনে পাওয়া সোনার মেডেলের কথা আর বন্ধুদের ইঙ্গিতপূর্ণ “সোনা” বলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলার চেয়ে একটু চালু হবার কারণ ওসব ইঙ্গিত এখন ভালোই বুঝতে পারি। শুধু তাই না একটু বেশি চালু হয়ে যাবার কারণে যেইসব সাধারণ কথাতেও কোন ইঙ্গিত নেই সেখানেও বিশেষ ইঙ্গিত খুঁজে পাই। যেমনঃ সেইদিন এক জার্মান প্রবাসী ভাই উনার বাসার উঠানে লাউ গাছ লাগিয়েছেন শুনে মুখটা কেমন হাসিহাসি হয়ে গেল। “লাউ গাছ” শুনে মাথাতে দুষ্ট ভাবনা এসেছিল। তারপরে ধরেন, “চারা গাছ”, “কলা গাছ”, “কলা খাওয়া”, “বিচি ছাড়া ফল”, “ডাল ভাংগা”, “ফুল ফোটা”, “ফল ধরা”, “ভালো ফলন”, “পানি বের হওয়া”, “ডাবের পানি”, “গরম পানি”, “ভিজে যাওয়া”, “খেলাধূলা করা”, “পাশা খেলা”, “ফিতা কাটা”, “চুল কাটা”, “মাল ফেলা”, “মালের গাড়ি”, “গাড়িতে চড়া”, “পাহাড়ে চড়া”, “দুধ খাওয়া”, “লাউ খাওয়া”, “রস খাওয়া”, “রসের হাড়ি”, “বুনো মোরগ”, “দেশি মুরগি”, “পাগলা ঘোড়া”, “ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়”, “বুড়ো সিংহ”, “শিকার ধরা”, “ধানক্ষেত”, “পাটক্ষেত”, “আস্তে-আস্তে”, “জোরে-জোরে”, “ব্যাথা লাগে”, “আরাম লাগে”, “সুখ লাগে”, “নরম-নরম”, “গরম-গরম”, “নোনতা-নোনতা”, “ঝাল মরিচ”, “গরম মসলা”, “ট্যাংকির ফুটা”, “খাটের তলা”, “চৌকির তলা”, “লেপের তলা” ইত্যাদি এমন সাধারণ শব্দ যাই শুনি না কেন সবকিছুর ভিতরেই কেমন যেন একটা দুষ্ট-দুষ্ট ইঙ্গিত পাই। আর ওসব মনে পড়তেই আমার মুখটা দুষ্ট-দুষ্ট হাসিময় হয়ে উঠল। আমার এই হাসিহাসি মুখ দেখে সিরিয়াস গ্রুপের একটা মেয়ে বলে উঠল, “আমরা সোনার মেডেল পাই নাই বলে তুমি কেন হাসছো?”

কিছু বললে অভদ্রতা হতে পারে ভেবে চুপ ছিলাম। মেয়েটা গজগজ করতে থাকল। এভাবেই সারাটা জীবন সবাই আমাকে ভুল বুঝে গেল।

একটু পরে আমাদের সাথে এক্সিবিশন কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করে জানাল, আমাদের গ্রুপে যেহেতু চারজন সদস্য (আরো একজন সুপারভাইজর ছিলেন), তাই একটা মেডেল দিলে আমরা সেটা নিয়ে নিজেদের ভিতর মারামারি করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। বস্তুত, দুনিয়ার সবাই জানে যে গবেষকদের বাচ্চাদের মত চুল টানাটানি করে মারামারির অভ্যাস। তাই এক্সিবিশন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে গ্রুপে যতজন আছেন তাদের সবাইকেই আলাদাভাবে মেডেল দেয়া হবে। তাই নো মারামারি, ডু ফুর্তি। আমি মনে মনে, “সোনা ঠিক আছে তো, নাকি ভেজাল আছে। কারবার তো সুবিধার না।” আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এদের কাছে সোনার মেডেলের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবার জন্য মানুষকে দিয়ে কুল পাচ্ছে না।

এইদিকে রাতের বেলা আমাদের ডিনারের দাওয়াত করা হয়েছে। ডিনারে মালয়শিয়ান এক মন্ত্রী থাকবেন। মন্ত্রী সাহেব নাকি সব গবেষকদের সাথে ডিনার করবেন। খাবারের মান ফাইভ স্টার। সেই সাথে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এক্সবিশন হলের উপরের তলার হলরুমে এই বিশাল আসর বসবে।

আমাদের সুপারভাইজরা আজকেও আসবেন না। আমার আর সিলং তে-এর জন্য এটা পরম পাওয়া। সস্তা রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে আমাদের পেটে চড়া পড়ে গেছে। আজকে কজ্বি চুবিয়ে গলা পর্যন্ত খেতে হবে যাতে আগামী দিনের দুপুর পর্যন্ত আর কিছু খাওয়া না লাগে।

কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না। বেশি ভালো খাবার খেয়ে আমাদের অবস্থা তাই হল। ফাইভ-স্টার খাবারে কি এমন ছিল জানি না কিন্তু আমরা দুইজনেই আউলিয়ে গেলাম। তবে পেট না আউলিয়ে মাথা আউলিয়ে গেল। কারণ মন্ত্রীর কাছ থেকে মেডেল ঠিকই নিলাম, কিন্তু ছবি তোলার চিন্তা মাথাতেই আসল না। মাথাতে তখন খালি খাবারের চিন্তা। কারণ, খাবারের কিস্তি তখনও অনেক বাকি। এভাবেই আমার দ্বিতীয় মেডেল ছবি ছাড়া চলে গেল।

রাতের বেলা মেট্রো ট্রেনে করে ফিরছি। ব্যাগে চার চারটা সোনার মেডেল আর আমরা গল্প করছি খাওয়া নিয়ে। যাই দেখছি তাতেই হাসি পাচ্ছে। আমাদের হা-হা, হো-হো হাসি শুনে ট্রেনের অন্য মানুষেরা বুঝতে পারছেনা কি কারণে আমরা হাসছি।

***

এর দুই বছর পরে আবার এই এক্সিবিশনে সোনার মেডেল পেয়েছিলাম। সে আর এক কাহিনী। তবে এবার সিলেং তে আর আমাদের সাথে ছিলো না। ততদিনে সে PhD করতে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছে। তখন আমি সিলেং তে-এর দেশে পরবাসী আর সিলেং তে নিউজিল্যান্ডে পরবাসী। ও আমাকে ফোন দিয়ে মালয়শিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে।

জীবনটা বড় অদ্ভুত।

***
সমাপ্ত
***

আমার অন্যান্য লেখাঃ ইন্দোনেশিয়া সিরিজ - ১ঃ মেদানের পথে পথে

ফেসবুকে পড়তে চাইলে ক্লিক করুন।

ট্রাভেল বিষয়ক ইউটিউব চ্যানেল


- মারামারি করতে পারি বলে সবাইকে গোল্ড মেডেল দিছিল।

- সোনার মেডেল

- এক্সিবিশন বাদ দিয়ে আমরা টুইন টাওয়ারে ঘুরতাম। বামের বিল্ডিং-এ এক্সিবিশন ছিল।

- এক্সিবিশন বাদ দিয়ে টুইন টাওয়ারে গিয়ে গেম খেলা।

- এক্সিবিশন বাদ দিয়ে টুইন টাওয়ারে গিয়ে গেম খেলা।

- এই রকম অনেক দোকানে গিয়ে ওদের টুপি জামা কাপড় পড়ে ছবি তুলতাম। অনেক দোকান আমাদের রীতিমত বের করে দিছিল। কারণ, ওরা জানত আমরা কিনতে আসি নাই।

- বাপরে আমার ওজন ছিল প্রায় ৬৮ কেজি সেই সময়। এগারো বছর পরে ওজন আরো ৫ কেজি বাড়ছে।

- সেই তাইওয়ানিজ বৎসের তৈরি নুডুলস যেটা কিনা অনেক সুস্বাদু, স্বাস্থ্যপ্রদ ও পুষ্টিকর।

- আংগুল কাটা সেফটি কাটার এর ডিজাইনার। ওর ডান হাতের আংগুলে ব্যাণ্ডেজ। সেই হাতের ছবি সে তুলতে দিবে না। তাই বাম হাতে ভি সাইন দেখাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে।

- মন্ত্রী আসার কারণে পুলিশের বহর। এটা শেষ দিনের ছবি। জাস্ট এর পরে আমাদের মাথা আউলিয়ে যাবার কারণে আর কোন ছবি তুলতে পারি নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×