ব্যাংকক এয়ারপোর্ট
১/
সেবার বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে বুয়েট থেকে একটা বিশেষ কাজে চীনে যাবার প্রয়োজন পড়ল।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সেই প্রজেক্টটির জন্য বেশ কয়েক কোটি টাকা দামের যন্ত্র কিনতে হবে। সেই যন্ত্র বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো হচ্ছে চীনের একটা প্রতিষ্ঠানে। সেই যন্ত্র বানানোর কি হাল-হকিকত এবং সেটা আমাদের দেয়া ডিজাইন অনুসারে তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্যই চীনে যাওয়া। আমার সাথে আছে বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কর্ণধার রফিক ভাই। আরো আছে বুয়েটের স্বনামধন্য কিছু শিক্ষক। পরে আমাদের সাথে যোগ দিবেন বাংলাদেশের আরেক স্বনামধন্য ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক, যার নাম আমি কখনোই আর কোন অবস্থাতেই বলব না। কারণ তাঁর নাম বললে আমার চাকরি থাকবে না। শুধু এতটুকু বলতে পারি তাঁর ইন্ড্রাস্ট্রির বার্ষিক রেভেনিউ হাজার কোটি টাকার উপরে। উনার ইন্ড্রাস্ট্রি বাংলাদেশে সবাই এক নামে চেনে, উনাকেও সবাই চিনে। আমার মত চুনোপুটির সাথে এত বড় রথি-মহারথি আর রাঘব বোয়ালেরা ভ্রমণ করছেন, সেটা সবাইকে জানানো উনাদের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। তাই তাঁদের নাম-পরিচয় গোপন থাকুক।
আমাদের প্রথম গন্তব্য চীনের হেবেই প্রভিন্সের Zhuozhou শহরে। শহরের নাম হিসাবে বেশ কঠিন একটা নাম। Zh এর পরে একবার uo আবার পরেরবার Zh এর পরে ou। যা উচ্চারণ করি তার কোনটাই সঠিক হয় না। আমি আবার কঠিন শব্দ ভালো উচ্চারণ করতে পারি না। আমার মুখে শব্দ জড়িয়ে যায়। একবার বুয়েটে থাকতে সকালে ক্যাফেতে নাস্তা করতে গিয়ে খাবারের অর্ডার দেয়ার সময় তাড়াতাড়ি বলতে গিয়ে “পরোটা”-কে “পারাটা” বলে ফেলেছিলাম। তাতে বন্ধু-বান্ধবীদের সেকি হাসাহাসি। বুয়েটের সনজলা তো সারাজীবন আমাকে দেখে “রুটি-পারাটা” বলেই পার করে দিল। তাই চীনের ব্যাপারে সাবধান থাকি। ভুলেও Zhuozhou শহরের নাম উচ্চারণ করি না। সব কথা “বিশেষ বিশেষ বিশেষণ” দিয়ে এমনাভাবে বলি যাতে Zhuozhou শহরের নামটা উচ্চারণ করতে না হয়। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।
কেউ যদি জিজ্ঞেসে করে, “আরাফাত চীনের কোথায় যাচ্ছ?”
“চীনের হেবেই প্রভিন্সের প্রভিন্সিয়াল রাজধানী থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের এক শহরে। অবশ্য বেইজিং হয়ে পরে আরো অন্য কিছু শহরে যাবো।”
“আচ্ছা, শহরের নাম কি?”
“খুব ছোট শহর তো। নাম বললে চিনবেন না।”
“তাও নামটা বলনা? চিনতেও তো পারি।”
“চীনে শহর আছে হাজারখানেক। আপনি কি চীনের সব শহর চিনেন? চিনেন না। তাহলে এই শহরও আপনার চেনার কথা না। আচ্ছা ভাই, আমার একটু তাড়া আছে। এখন আসি। পরে কথা হবে।” এসব বলে তাড়াতাড়ি সটকে পড়ি।
মানুষে ভাবে আমি “ভাব” দেখাচ্ছি। আসলে যে আমি আমার দূর্বলতা ঢাকছি সেটা কেউ বুঝে না। আর আমিও ভুলেও Zhuozhou শহরের নাম উচ্চারণ করি না। পাছে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলি, আর মানুষের আরো হাসাহাসির শিকার হই।
এভাবে দেশে ভালো চললেও, বেইজিং এয়ারপোর্টে কিভাবে চললাম সেটার গল্পে পরে আসছি। তার আগে থাইল্যান্ডে ট্রানজিটের গল্প একটু করে নেই।
২/
আমরা থাই এয়ারওয়েজে করে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিলাম। আমার পাশে সিট পড়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপকের। ভদ্রলোক সম্ভবত এর আগে কখনো বিমান-ভ্রমণ করেন নাই। উনি জাপান যাচ্ছেন কোন এক কাজে। যখন শুনলেন আমরা চীনে যাচ্ছি, উনি হৈ হৈ করে উঠে বললেন, “আরে আমি তো তাহলে ভুল প্লেনে উঠেছি। আমি ভাবেছি এই প্লেন জাপান যাচ্ছে। এখন আমার কি হবে?” আমি উনাকে আশ্বস্থ করলাম যে উনি ঠিক প্লেনেই উঠেছেন। থাইল্যান্ডে গিয়ে আমরা চীনের প্লেনে উঠব আর উনি গিয়ে জাপানের প্লেনে উঠবেন। উনার কেন জানি ধারণা হয়েছিল যে এই প্লেনে সবাই উনার মত জাপান যাচ্ছেন। আমি আশ্বস্থ করার পরেও ভদ্রলোকের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া সরছিল না।
আমাদের ফ্লাইট ছিল রাতের বেলা। আমি কেন জানি রাতের জার্নিতে কখনোই ঘুমাতে পারি না। এই জার্নিও এর ব্যাতিক্রম না। না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম পুরো পথ। অথচ, আমার দলের সবাই খাবার খেয়ে-দেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ওদের দেখে আমার হিংসে হয়। সারারাত না ঘুমিয়ে যখন থাইল্যান্ডের Suvarnabhumi এয়ারপোর্টে পৌছালাম তখন সবে ভোর হয়েছে, সূর্যের আলো তখনো চোখ মেলেনি ব্যাংককের আকাশে।
থাইল্যান্ডে আমাদের ছয় ঘন্টা ট্রানজিট। পরের ফ্লাইট সকাল এগারোটার দিকে। এই বাকি সময়টুকুও আর ঘুমাতে পারব না। তাই এয়ারপোর্টের ভিতরেই ঘুরে-ফিরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে শরীরের জড়তা দূর করে ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হবার জন্য। এখানকার ওয়াশরুমের টয়লেটগুলোতে বিশাল সমস্যা। কোথাও পানি নেয়ার জন্য বদনা বা পুশ শাওয়ার টাইপের কিছুই নাই। সব জায়গাতেই টিস্যু পেপার ভরসা। এই জিনিস দিয়ে কি বাংগালিদের চলে? আমাদের সকালবেলা দরকার “বদনা ভর্তি টলটলে কিঞ্চিত উষ্ণ পানি।” এটা না হলে আমাদের সকালটা আর শুরু হতেই চায় না। কিন্তু বদনা ভর্তি টলটলে কিঞ্চিত উষ্ণ পানি এখানে পাবো কোথায়? কি আর করা। রোমে গেলে রোমের নিয়মেই চলতে হবে।
একটু ফ্রেশ হয়ে Tom Yam আর Nasi Goreng দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম। এর পরে গেলাম ট্রান্সফার ডেস্কে যাতে পরের ফ্লাইটের জন্য যাবতীয় চেকিং-এর কাজ আগেই সেরে ফেলা যায়। ওখানেই পরিচয় হল এক ভারতীয় মহিলার সাথে যিনিও আমার মত ট্রানজিটে আছেন। তিনি জাপান থেকে একটা কনফারেন্স শেষে ভারতে ফিরে যাচ্ছেন। উনি অনেক গল্প করলেন উনার দেশ ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে। আমার সাথে কিছুক্ষণ বাংলাতেও কথা বললেন উনার বাংলা জ্ঞান বোঝানোর জন্য। দেখলাম উনার বাংলা জ্ঞান বেশ ভালোই, যদিও আমাদের সব কথা ইংরেজিতেই হয়েছিল। উনি জানালেন যে উনি বাংলাদেশে আসতে চান দেশটাকে দেখার জন্য। আমি সাদর আমন্ত্রণ জানালাম। এরপর, উনার সাথে এয়ারপোর্টের ভিতরের দোকান-পাটগুলো ঘুরে দেখলাম। উনি কিছু গিফট কিনলেন উনার হাজব্যান্ড আর ছেলে-মেয়েদের জন্য।
থাইল্যান্ডে প্রচুর ট্রান্স-জেন্ডার মানুষ, মানে যারা ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও পরে অপারেশনের মাধ্যমে মেয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে। এদের অনেকেই নজরকাড়া সুন্দরী। আবার অনেকেই বেশ পুরুষালি। এয়ারপোর্টেও এদের বেশ আনাগোণা লক্ষ্য করা গেল।
এয়ারপোর্টে আরো আছে “ফিরিঙ্গি” ট্রাভেলার। এইগুলো হল ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রোলিয়া থেকে আসা সাদা চামড়ার বুড়ো-ভাম যেগুলো থাইল্যান্ডে আসে মেয়ে নিয়ে মজা করার জন্য। এক একটা ফিরিঙ্গির ইয়া মোটা ভুঁড়ি, মাথা ভরা টাক আর গাল ভরা পেকে যাওয়া দাঁড়ি। দেখলেই কেমন জানি নোংরা লাগে। কিন্তু এইগুলোর সবার বগলে একটা করে কম বয়েসী থাই মেয়ে না হয় ট্রান্স-জেন্ডার কেউ। ফিরিঙ্গিগুলো থাইল্যান্ডে এসে একটা কম বয়েসী মেয়ে বাগিয়ে নিয়ে এখন প্রমোদ-ভ্রমণে যাচ্ছে অন্য কোথাও। আর এই ফিরিঙ্গিদের সাথে ঘোরা থাই-মেয়েগুলাও এইসব সাদা চামড়ার বুড়া-ভাম ধরার জন্য একেবারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনমতে একটা বুড়োকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করতে পারলে তো একেবারে কেল্লাফতে। সেই মেয়ে বুড়োর দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যায় বিয়ের পর। তারপরে সে মেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কবে সেই বুড়ো-ভাম মরে যাবে। কারণ, বুড়ো মরলে সব সম্পত্তি সেই মেয়ের হয়ে যাবে। তাই যেই মেয়ে যত বেশি বুড়ো ধরতে পারে তার জন্য তত সুবিধা। কারণ, বেশি বুড়ো হলে আশা করা যায় যে সে তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। আমার মত সুঠামদেহী যুবক (!) ছেলের দিকে এসব মেয়ে ফিরেও তাকাবে না। কারণ, আমার মরার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হয়ত সেই মেয়েই একদিন মরে যাবে। যদিও হায়াত-মউত সবই উপরওয়ালার হাতে। আর তাই সে কারণে যদি আমি আগেই মারা যাই তখন সেই মেয়ে হয়ত দেখবে আমার ব্যাংক একাউন্টে আছে মাত্র একশত তিরাশি রিঙ্গিট পঁচাশি সেন্ট। তখন সেই মেয়ের মনের অবস্থা কি হবে সেটা ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে। আমার মত সুঠামদেহী যুবক (!) ছেলেদের বগলে থাকা ওদের জন্য এক বিশাল লস ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রিস্ক ফিরিঙ্গিদের সাথে ঘোরা কোন মেয়ে কখনোই নিবে না। ওদের দরকার প্রায় মৃত্যু-পথযাত্রী, মদখোর, বিয়ে-পাগল বুড়ো দাদু। দুনিয়া বড় কঠিন জায়গারে ভাই। এখানে অনেক হিসাব-নিকাশ করেই প্রেম-ভালোবাসা আর বিয়ে করতে হয়।
তবে এইসব থাই মেয়েদেরও খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। হয়ত, সেই মেয়ের পরিবারে আছে নেশাগ্রস্থ বাবা, অসুস্থ মা, ছোট ভাই-বোন যাদের লেখাপড়ার খরচ তাকে চালাতে হয় বা রয়েছে নিজের বাপ-ছেড়ে যাওয়া ছোট বাচ্চা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই হয়ত মেয়েটা এই পথে পা বাড়িয়েছে। ওদিকে ফিরিঙ্গি বুড়ো-ভামেরও হয়ত দুই-কূলে কেউ নেই। সেও সারাজীবন অর্থ আর ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটে শেষ বয়সে নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। শেষ বয়সে ফিরিঙ্গি বুড়োর দরকার একটা সঙ্গী, অন্যদিকে থাই মেয়েটার দরকার অর্থ ও নিশ্চিত জীবন। তাই এমন বিবাহ দুইজনকেই একটা উইন-উইন সিচুয়েশন তৈরি করে দেয়। দুনিয়াটা আসলেই বড় কঠিন জায়গা।
Suvarnabhumi এয়ারপোর্টে বিশাল, এলাহি কারবার। এসব বিচিত্র জিনিস দেখতে দেখতে এয়ারপোর্টে সময়টা কেটে গেল।
____________________________________
সমাপ্ত এবং চলবে যদি সবার ভালো লাগে। চললে প্রতি ৩-৪ পরপর পোস্ট দিব এই সিরিজের উপর।
পরের পর্বঃ চায়না সিরিজ ২ - চায়নার Zhuozhou শহরের পথে