somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক অদ্ভুত জীবন দর্শন

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাজারে আর মাজারে নাকি কিছু একবার হারালে আর পাওয়া যায় না।


শাহজালালের মাজারের মসজিদে ওঠার সিঁড়ি পাশেই আছে অযুখানা। আসরের নামাজের ওজু করতে গিয়ে বসা অবস্থায় দেখি আমার পকেটে মানিব্যাগ ( ওয়ালেট ) নেই।

হতবিহ্বল হয়ে ভাবছি কি করা যায়। যতনা টাকার জন্য , তারচেয়ে বেশি চিন্তা মানিব্যাগে ড্রাইভার লাইসেন্স আছে, নানা রকমের জরুরি কার্ড আছে ।

মিনিট যায়নি। দেখি আমার পেছনে লম্বা সাদা জোব্বা পরা একজন লোক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। উনার হাতেই আমার মানিব্যাগ। কোনো কথা না বলে উনি আমার দিকে মানিব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন।

আমার উৎকন্ঠায়, উদগ্রীব মন শান্ত হলো। মানিব্যাগের ভিতর দেখলাম সব ঠিকঠাক আছে।

বুঝতে পারছিনা- এই লোক কি আমার মতো এখানে আসা কোনো দর্শনার্থী, না কি কোনো ভবঘুরে, নাকি কোনো পাগল। মাজারে তো কত রকমের , কত চিন্তার, কত জাতের লোকই থাকে। ভাবছি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ উনাকে একশত টাকা দেয়া যায় কিনা। আবার যে লোক নিজ থেকেই এতো ভীড়ের মাঝে আমার মানিব্যাগ আমাকে ফিরিয়ে দিলেন- উনাকে একশত টাকা দিলে উনি আবার কিছু মনে করেন কিনা।

আমি একশত টাকার একটা নোট উনার দিকে এগিয়ে দিলাম।

উনি নিলেন না।

হাত পেটের উপর রেখে বুঝালেন উনাকে চাইলে কিছু খাওয়াতে পারি। উনার টাকার প্রয়োজন নেই।

অদ্ভুত!! এই দুনিয়ায় এমন মানুষও আছে- যার টাকার প্রয়োজন নেই।

আমারও ক্ষুধা লেগেছে। আসরের নামাজ মেলা আগেই শেষ হয়ে গেছে। উনাকে বললাম- আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন।

নামাজটা পড়ে আসি। তারপর দুজন মিলে একসাথে খাবো।

আমি নামাজ পড়ে নীচে নেমে এসে দেখি ভদ্রলোক নেই।

নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করলো। যে লোক আমার মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিলো। আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নিলোনা। যে লোক শুধু একটু খাবার খেতে চেয়েছিলো। আমি বলেওছিলাম ওনাকে খাওয়াবো। কিন্তু সেটা থেকে বঞ্চিত হলাম। ওয়াদা পূরণ হলোনা।

আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন- কোনো বুভুক্ষু মানুষকে খাওয়াতে চাইলেই যে খাওয়াতে পারবে। সেই সৌভাগ্যতো সবার হয়না।

ভাবছি কি করা যায়। নিজের মতো করে হাঁটছি আর মানুষের ভিড়ে এক নাম না জানা মানুষকে খুঁজছি।

মাজারের পুকুরের দিকে এগিয়ে যাই। বড় বড় গজার মাছে ভর্তি পুকুর। পুকুরের গজার মাছগুলোকে একবার মেরে ফেলা হয়েছিলো বিষ ঢেলে দিয়ে। বুঝতে পারিনা, মাছকে বিষ দিয়ে মেরে এরা কোন জান্নাতে যেতে চায়।

মাথার উপরে জালালি কবুতরগুলো উড়ছে। উড়ে গিয়ে আবার এখানে ওখানে বসছে। আবার উড়ে যাচ্ছে।

কয়েকবার চারপাশ ঘুরি। ঘুরতে ঘুরতে মাজারের অন্যপাশে একটা কূপ আছে। সেখানে আসি। ক্ষিধে লেগেছে খুব। কিন্তু খেতেও ইচ্ছে করছেনা। যদি লোকটার সাথে আবার দেখা হয়।

আল্লাহর কি মেহেরবান। লোকটা সেই কূপের পাশে উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি উনাকে বললাম- আপনি অপেক্ষা না করে চলে আসলেন। চলেন দুজনে একসাথে কিছু খাই।


মাজারে ঢুকার দুপাশে লাইন করে রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে এসে খেতে বসলাম।
মুখোমুখি বসে আছি।
বললাম- আপনার যা ইচ্ছে তাই খান। পেট ভরে খান।

খাবার এসেছে। উনি এমন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন মনে হলো এই লোকের মনে হয় সারাদিন কোনো কিছুই পেটে পড়েনি।

জিজ্ঞেস করলাম - আপনি কি এই মাজারেই থাকেন। আপনার বাড়ি কোথায় ?

বললেন- মাজারে মাঝে মাঝে আসেন। বাড়িঘর একসময় ছিলো। এখন আর কিছুই নেই।

আত্মীয় স্বজনও নেই?

জ্বি না, নেই।

সংসার -পরিবার, স্ত্রী, সন্তান কেউ নেই ?
না নেই।
এরপর আর কিছু বলছেন না।

কেউ কিছু না বললে- তার কাছে অতিরিক্ত কিছু জানতে চাওয়াও ঠিক না। কিন্তু আমার বারবার জানতে মন চাইছে- একটা মানুষ কেন কিভাবে কোন কারণে এমন ভবঘুরে হয়। কার মন চায় সংসারহীন হয়ে এভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে। কেনই বা মানুষ এরকম শেকড়হীন হয়ে যায়।

আমি যত বেশি পারি উনার সাথে মানবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। হয়তোবা এভাবে কেউ উনার সাথে অনেকদিন কথা বলেনি। হয়তো নিজ জীবনের দুঃখবোধ এভাবে প্রকাশ করার কোনো সুযোগও উনার জীবনে আসেনি।

উনি বললেন- বাবার স্মৃতি বলতে মনে আছে- আমাদের ছোট উঠোনের সামনে একটা লাশের কফিন। সেই কফিনের ভিতর সাদা কাপড়ে মোড়া আমার বাবার লাশ।

আমার জন্মের আগেই বাবা সংসারের সুখের আশায় প্রবাসী হয়েছিলেন। তারপর একটা ভয়ংকর দূর্ঘটনায় উঁচু ভবনের নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে বাবা নীচে পড়ে মারা যান। তাই বাবাকে আমি দেখিনি। শুধু বুঝলাম উঠোনে যে লাশটি কফিন বন্দি হয়ে শুয়ে আছে-তিনিই আমার বাবা।

পিতার কোলে হয় সন্তানের প্রথম আশ্রয়। কিন্তু আমার কি দুর্ভাগ্য- বাবার সাথে তার সন্তানের যখন প্রথম দেখা হলো তখন বাবা মৃত আর সন্তান জীবিত। মা অল্প বয়সেই বিধবা হলেন।

আমাদের আয়ের অন্য কোনো পথ ছিলোনা। ভিটে বলতে ছিলো ছোট একটা ঘর। ঘরের কোনে ছিলো একটা বড়ই গাছ। মা মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করা শুরু করলেন। কিন্তু মায়ের বয়স ছিলো অল্প। দেখতে ভালো। সন্তান থাকায় কেউ মাকে বিয়ে করতে চাইলো না। মাও চাইলেন না অন্য কোনো স্বামীর ঘরে গিয়ে সৎ পিতার কাছে আমার কষ্ট হয়।

অল্প বয়সে ঝি এর কাজ করতে গিয়ে যত দূর্নাম হতো সে সবের জন্য মাকেই সবসময় অপরাধী বানানো হতো । এই সমাজে যে কোনো অনিষ্টের জন্য নারীরাই বেশি দায়ী হয়। পুরুষরা হয়না। আর কোনো নারী যদি দেখতে একটু ভালো হয়, তার উপর বিধবা হয়, তাহলেতো আর কোনো কথাই নেই।

মা স্বাধীন হতে চাইলেন। বাড়ির বরই গাছ থেকে বরই পেড়ে সেগুলো দিয়ে আচার বানাতেন। তারপর হাঁটে গিয়ে বিক্রি করতেন। হাঁস মুরগি পোষতেন। বাজার গিয়ে ডিম বিক্রি করতেন। পাড়ায় নানা ঘরেও বিক্রি করতেন।

গ্রামের এক বুড়ো মাতব্বর চাইলেন তাকে বিয়ে করে তার খেদমত করার জন্য। ঐ লোকের সন্তানদের বয়স ছিলো মায়ের বয়সের চেয়েও বেশি।

মা রাজি হলেন না।

পাড়ায় দূর্নাম ওঠলো- গ্রামের মেয়ে হাঁটে গিয়ে বেচাবিক্রি করবে কেন? এতে গ্রামের দূর্নাম হয়। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে।

একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ মারা যাওয়ার পর আমরা কিভাবে খেয়ে পরে বেঁচে আছি - সেকথা কেউ জানতে চাইলোনা। কিন্তু জীবিকার তাগিদে যখন একটা মেয়ে নিজ পায়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে চাইলো তখনই তাদের সম্মানের হানি হওয়া শুরু হলো।


শত অভিযোগ দূর্নামের মাঝেও মা তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। আমি ভোরে যেতাম মক্তবে আর সকালে স্কুলে। পাঠ্য বইয়ের পড়ালেখায় আমার তেমন মন বসতো না। মক্তবের হুজুরের কোনো সন্তানাদি ছিলোনা। মাঝে মাঝে উনি আমাকে দিয়ে ঘরের নানা কাজ করাতেন। আর উনার স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাদের ঘরে গেলেই এটা ওটা খেতে দিতেন। হুজুরের ঘরের একটা সেল্ফে বেশ কিছু বই ছিলো। হাদিস , কোরআন সহ নানা বিষয়ের। সেই বইগুলো পড়া আমার নেশা হয়ে ওঠলো। আর আমার চোখের মাঝে সব সময় আটকে থাকতো কফিনের ভিতর পড়ে থাকা সাদা কাফনের ভিতর বাবার লাশ।

মাঝে মাঝে আমি বাবার কবরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। আমার কোনো ডর ভয় লাগতো না। তখন আমার বয়স হবে এগারো -বারো।

লোকটি এবার আমাকে প্রশ্ন করলো-
আচ্ছা আপনার কি কোনো ডর ভয় লাগে?

আমি বললাম - কি রকম ডর ভয়? একজন মানুষের ডর ভয়তো অনেক রকমের হয়।
লোকটি বললো- মনে করেন- অনেক গভীর রাতে এই মাজারের কবরে গিয়ে কি আপনি একলা বসে থাকতে পারবেন ?
আমি বললাম- না পারবো না। আমার ভয় লাগবে। খুব বেশি ভয়।

লোকটি বললো। আমার লাগবে না। কারণ আমি জানি- দিন এবং রাত দুটোই আল্লাহর সৃষ্টি এবং এসব শুধু সময়ের রুপান্তর মাত্র। জীবন এবং মৃত্যু এগুলোও আল্লাহর সৃষ্টি। তাই ভয়ের কিছুই নেই।

উনি বললেন- এই যে আপনার মানিব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিলো আপনি কি শুধু উৎকন্ঠায় ছিলেন? ভয় পাননি।
অবশ্যই পেয়েছেন। এটা হলো হারানোর ভয়।

লোকটি বললো- যদি আমি আপনার কাছ থেকে একশত টাকার নোটটি নিতাম। তাহলেই আমারও হারানোর ভয় শুরু হয়ে যেতো।
শুধু তাই না। যার যত বেশি থাকে , তার হারানোর ভয়ও তত বেশি থাকে। তার বন্দিত্বও তত বেশি হয়ে থাকে। একটু চিন্তা করে দেখেন- কারাগারে বন্দি থাকলেই কেবল মানুষ বন্দি না। মানুষ তার সম্পদের নিকটেই সবচেয়ে বেশি বন্দি। কেউ তার ব্যাংক ব্যালেন্সের কাছে বন্দি, কেউ তার গাড়ি বাড়ির কাছে বন্দি, কেউ তার খ্যাতি ,যশ , ক্ষমতার কাছে বন্দি।

কি মানুষের কি স্পষ্ট চিন্তা। আমি অবাক হয়ে উনার কথা শুনতে লাগলাম।

মা বাবা দুজনকে হারানোর পর আমার লাভ হয়েছে দুটোঃ

আমার সমস্ত ভয় কিভাবে যেন দূর হয়ে গেছে। মৃত্যুকে আর কোনো ভয় হয়না। পৃথিবীতে আমার আপন দুটো মানুষ যেখানে নেই। সেই পৃথিবীতে আমার কোনো ভয়ও নেই। আর আমি পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গেছি। এমনকি একটা পাখিও তার খাঁচায় বন্দি। সারাদিন পর তাকে তার খাঁচায় ফিরতে হয়। আমার সেই খাঁচাও নেই। সেই বন্দিত্বও নেই।

লোকটা আমাকে কি অদ্ভুতভাবে অবাক করে দিচ্ছে।
তার কথা শুনে মনে হচ্ছে- আমি যেন সেই এইয়স্তেন গার্ডারের লেখা 'সোফি'স ভারডিক্ট" বইয়ের সেই সোফির জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।

আমি বললাম- আপনি মাকে হারালেন কিভাবে?
একটা ঘোরের ভিতর দিয়ে যেন আমার জীবন যাচ্ছে। কোনো রকমে হাইস্কুলে ওঠলাম। কিন্তু স্কুলের কোনো পরীক্ষায় আর পাশ করতে পারিনা। কারণ- আমি যা পড়ি, তার কোনো কিছুই পরীক্ষায় আসেনা। স্যাররা বললেন- আমার মানসিক রোগ হয়েছে। আগে চিকিৎসা, তারপর পড়ালেখা।

আমার মায়ের পরনের সাদা কাপড় আর বাবার কাফনে মোড়া সাদা কাপড় দেখেই মনে হয় আমার সাদা কাপড় পরার অভ্যাস হয়ে গেলো। আমি সবসময় সাদা কাপড় পরেই চলা ফেরা করতাম।

গ্রামের যে বুড়ো মাতব্বর মাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো ওর লোকেরা বলা শুরু করলো- আমার মাঝে কোনো জ্বিনের আসর হয়েছে। তা না হলে আমি সবসময় শাদা কাপড় পরে থাকি কেন?

আমিতো ভাই কাউকে কোনোদিন বলিনি - আপনি লাল কাপড়, আপনি নীল কাপড় কিংবা আপনি শার্ট, আপনি পান্জাবি, আপনি প্যান্ট, আপনি লুংগি পরেন কেন?

মানুষ বলতে শুরু করলো- আমার মাথার চুল অতো লম্বা কেন?
আমিতো কাউকে কোনোদিন বলিনি- ও ভাই তোমার চুল অতো খাটো , অতো লম্বা , অতো ডিজাইন করা কেন?

মানুষ বলতে লাগলো - আমি এতো ঘন ঘন কবরে যাই কেন , সেখানে বসে থাকি কেন?
আমিতো কাউকে কোনোদিন বলিনি- আপনারা এখানে, ওখানে যান কেন?

গ্রামের মানুষ ছড়িয়ে দিলো আমার মাথায় দোষ আছে। দোষ ছাড়াতে আমাকে ঝাড় ফুঁক করা হলো। ঝাড় ফুকের নামে একটা কিশোর ছেলেকে বলতে গেলে রীতিমতো ঝাড়ু দিয়ে নির্মম ভাবে প্রহার করা হলো।

আমার করুণ আকুতি আর মায়ের কান্না কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে আমাকে পরিত্রান দিলো না।


কিন্তু আমিতো জানি। আমার মাঝে কোনো দোষ নেই। বরং দোষ থাকলে সেটা ওদের দোষ। আমি বুঝতে পারলাম- এসব কিছু আসলে আমাদেরকে যন্ত্রণা দেয়া। আমাদের ছোট ভিটার উপর কিছু মানুষের চোখ পড়েছে। যেভাবে যে উসীলায় আমাদের তাড়াতে পারলেই হয়।

এর মাঝে বাজারে এক মানুষের সাথে মায়ের পরিচয় হয়েছে। আমাদের ঘরেও দু একবার এসেছে। লোকটাকে দেখে আমারও ভালো মানুষ মনে হলো। কিন্তু একবার দুবার দেখায় কি আর মানুষ চেনা যায়। এই দুনিয়ায় কত মানুষ যে কত রকমের মুখোশ পরে আছে।

মা আর লোকটার কথায় যা বুঝলাম- ভিটে বিক্রি করে দিয়ে শহরে যেতে। লোকটা সব কিছুর ব্যবস্থা করেছে। ধীরে ধীরে সব একসময় ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু বাবার কবর ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হলোনা। ঐ করবরই যেন আমার শান্তি।

মা বুঝালেন- আমরা মাঝে মাঝে এখানে এই গাঁয়ে আসবো।
আমি বললাম- ভিটে না থাকলে , ঘর না থাকলে কোথায় আসবো। কার কাছে আশ্রয় পাবো।

সিদ্ধান্ত হলো - বাড়ি বিক্রি করা হবে না। যাতে আমাদের শেকড়টা থাকে।

কয়েকদিন পর জীবনের প্রথম নিজ গ্রামকে পেছনে রেখে এক রেলস্টেশানে এসে হাজির হলাম সেই লোকের সাথে। রেল ছুটলো ঢাকা অভিমুখে। আর আমরা ছুটলাম জীবনের এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।


ঐ গন্তব্যই ছিলো আসলে আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন, সবচেয়ে বড় বেদনার দিন, চির দিনের জন্য নিঃসঙগ হয়ে যাওয়ার দিন এবং হয়তোবা ঐ দিনই ছিলো আমার চির মুক্তির দিন।

ভৈরব জংশনে আসলাম। হঠাৎ দেখি হাজারো মানুষের মাঝে আমি একা। মা নেই, লোকটাও নেই।

আমি নিশ্চিত জানি। আমার মা আমাকে ছেড়ে যান নি।

যে মা সন্তানের কষ্ট হবে বলে বিয়ে করলেন না। সে মা আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারেন না।

আমি বুঝলাম- ভালো মানুষের রুপ নিয়ে আসা লোকটাই যে কোনো ভাবে আমার মাকে নিয়ে কোনো স্টেশানে নেমে গিয়েছে আমার ঘুমের মাঝে। হয়তো কোনো স্টেশানে নেমেছে কিছু কিনতে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ওরা আর ট্রেনে ওঠেনি। আমি একা ট্রেনের মাঝে। ট্রেন ছুটে চলেছে। কিন্তু আমি জানিনা আমি কোথায় যাচ্ছি।

আপনি আপনার গ্রামে ফিরে যান নি।

গিয়েছি। মা সেখানে ফিরেন নি। কেউ কেউ বলে নারী পাচারকারীর পাল্লায় পড়ে মা ভারত পাচার হয়ে গেছেন।

আপনার দাদা, চাচা, মামা এরা কেউ নেই।

বাবা ছিলেন একমাত্র সন্তান। নানার বাড়ি - করিমগঞ্জ না কোথায় যেন। সেখানেই বাবা রঙ মিস্ত্রীর কাজ করতেন । মা বাবাকে বিয়ে করেন তারপর ভৈরবের সাদেকপুর চলে আসেন। ( মনে হয় সাদেকপুরই বলেছিলেন- সঠিক মনে নেই )

আমি আবার ভৈরব আসলাম। স্টেশানে পড়ে রইলাম। যদি আমার খোঁজে মা ফিরে আসেন। প্রতিটি ট্রেনের জানালা দিয়ে মাকে খুঁজতাম। প্রতিটি মহিলাকে দেখলেই মনে হতো এই বুঝি মা এসেছেন।

সেই যে আমি পথে নামলাম। রাস্তায় রাস্তায়, স্টেশানে, স্টেশানে, মাজারে মাজারে ঘুরতে লাগলাম।

আমার মা যদি সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার নিয়তে কোনো মাজারে আসেন- তবে হয়তো তাকে আবার খুঁজে পাবো। মাজারেতো কত মানুষই কত নিয়ত পূর্ণ করতে আসে। কিন্তু আমি আসি এই আশায় যদি একবার মায়ের দেখা পাই।


খাবারের বিল পরিশোধ করে দুজনে বের হয়ে আসি।

সূর্যের শেষ আলো পড়ছে। জালালি কবুতরগুলোও আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। আমিও ঘরে ফিরে যাবো।

দেখি দুজন বৃদ্ধ মানুষ দুদিকে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর কোনো কোলাহলই তাদের স্পর্শ করছেনা। কোটি টাকার বিছানায় শুয়েও হয়তো কত মানুষের এরকম প্রশান্তিময় ঘুম আসেনা।

লোকটাকে বললাম- আপনি এখন কোথায় যাবেন।

যেদিন ঘর ছেড়ে দিয়েছি- সেদিন থেকে মনে হয় আমার আর কোনো আশ্রয় নেই। আবার মনে হয় এই পৃথিবীর যেখানেই যাই- সেখানেই আমার ঘর। আবার মনে হয় এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই। আবার মনে হয় এই কবুতর, এই পুকুর, এই গজার মাছ এরাই আমার আপন। এরা কেউ তো কোনোদিন আমাকে দোষী বলবে না। জ্বিনের আশ্রয় পড়েছে বলে কেউ আমাকে প্রহার করবে না।

আপনার খাবার আহার। পেটে ক্ষুধা লাগেনা।
লোকটি হাসে। একেবারে শিশুর মতো নির্মল, নিষ্পাপ সেই হাসি।

বলে- মানুষের সব কষ্ট সহ্য হয়ে যায়। খাবারের কষ্টও সহ্য হয়ে গেছে। তাছাড়া একজন মানুষ কতটুকুই বা খায়। একভাবে না একভাবে খাবার জুটে যায়।

আমি এক গহীন ঘোরের ভিতর মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকি।

কয়েকদিন আগে একজন বিখ্যাত মানবতাবাদী বিচারক ফ্রাঙক ক্যাপ্রিও মারা গেলেন। যার মৃত্যু বিলিয়ন মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করছে। উনি একটা কথা বলতেন- বিচারের কাঠগড়ায় আমি কোনো অপরাধীকে অপরাধী হিসাবে দেখিনা।তার অপরাধের বিচার করার আগে আমি একবার দেখতে চাই কেন সে অপরাধী হলো। কে তাকে অপরাধী বানালো।

কত মানুষ যে তার বুকের ভিতর কত রকমের দুঃখ বুনে রাখে - তার কতটুকুই বা জানি। সাগরের গভীরতা মাপা যায়, দূর আকাশের তারার দূরত্বও পরিমাপ করা যায়। কিন্তু মানুষের গভীর দুঃখবোধতো পরিমাপ করা যায়না। সেটা হয়তো কিছুটা অনুভব করা যায়। কিন্তু সেই দুঃখবোধ অনুভব করার আগেই আমরা মানুষকে কত ভাবে জাজ করি। নিজের পাপের হিসাব না করে কে দোযখে যাবে আর কে বেহেস্তে যাবে সেটা এই দুনিয়াতেই আমরা ফায়সালা করি।

ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৬

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

জুলাই আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতা ছিলেন না , তাকে কেউ চিনতো না কয়েক মাস আগে ও ।

জুলাই জংগীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ৩০ দেশের দুষ্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদুত বদলায়ে দিচ্ছে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২৩



আইয়ুব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার পর, বাংগালীদের লাথি খেয়ে সরেছে; জিয়া, কর্নেল তাহের ও জাসদের গণ বাহিনী আমাদের দেশকে নরক (১৯৭৫ সাল ) বানিয়ে নিজেরা নরকে গেছে। আমাদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×