somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্শমেলো টেস্ট

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭২ সাল। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার মিশেল এক অদ্ভুত কিন্তু অত্যন্ত গভীর এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করেন শিশুদের উপরে। যা পরে ‘মার্শমেলো টেস্ট’ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।

অধ্যাপক মিশেলের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছিল এই গবেষণার পেছনে। তাঁর দুই মেয়ে টিনা ও সাবরিনার বয়স ছিলো চার এবং ছয় বছর । তারা একটি স্কুলে যেতো যেখানে আরও বিশজন শিশু ছিল। মিঃ মিশেল সেই স্কুলের শিশুদেরকেই তাঁর পরীক্ষার অংশ করেন।

প্রতিটি শিশুকে একে একে একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সামনে রাখা হয় একটি মার্শমেলো এক ধরণের নরম ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যা শিশুরা খুবই পছন্দ করে।

তারপর অধ্যাপক প্রতিটি শিশুকে আলাদা করে বলেন: তুমি চাইলে এখনই এটা খেয়ে নিতে পারো। তাহলে এই একটিই পাবে।
কিন্তু যদি ১০ মিনিট অপেক্ষা করো তাহলে তুমি আরও একটি পাবে। মোট দুটি।

এরপর তিনি কক্ষ ত্যাগ করেন এবং প্রতিটি শিশুর প্রতিক্রিয়া নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে থাকেন।

তিনি দেখেন- কেউ সঙ্গে সঙ্গেই মার্শমেলো খেয়ে ফেলে। কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। কেউ চোখ বন্ধ করে অথবা মুখ ঘুরিয়ে নেয় যেন দেখতেই না পায় লোভনীয় খাবারটিকে। কেউ হাত দুটো পেছনে রাখে। আবার কেউ অদ্ভুত উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে যাতে সময় পেরিয়ে যায়।

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়।

সময় গড়িয়ে যায়। দুই দশকেরও বেশি পেরিয়ে গেছে। অধ্যাপক মিশেল তখন বয়সের ভারে নত। আর টিনা, সাবরিনাও প্রাপ্তবয়স্ক।
থ্যাংকস গিভিং ডে হলো আমেরিকার একটি বিশেষ হলিডে। সেদিন মোটামুটি সবাই আপনজনের টানে বাড়ি ফিরে আসে। টিনা,সাবরিনাও এসেছে। মধ্যাহ্নভোজের পর তারা মিলে শৈশবের বন্ধুদের গল্প করছিল। পাশে বসে থাকা তাদের পিতা শুনছিলেন সেই স্মৃতিচারণা।

হঠাৎ তাঁর সেই পুরনো গবেষণার ডায়েরিটির কথা মনে পড়ে । তিনি ডায়েরিটি বের করে প্রত্যেক শিশুর নাম ধরে জানতে চান, কে এখন কী করছে।

ফলাফল ছিলো অবিশ্বাস্য সুন্দর।

যারা শিশু বয়সেই নিজেকে সংবরণ করতে পেরেছিলো। তারাই ভবিষ্যতে শুধু শিক্ষা আর ক্যারিয়ারে সফল হয়নি। তাদের পারিবারিক জীবনও হয়েছে সুন্দর, শান্ত, সুখি,সমৃদ্ধ। তাদের জীবনে মানসিক স্থিতি এসেছে, জীবনদর্শনেও এসেছে পরিপক্কতা।


নরওয়ের খ্যাতিমান সাইকোলোজিস্ট ফিন স্কারদেরোড বলেছিলেন- একজন মানুষের চেতনা বা কনসাসনেস যা শৈশবে গড়ে ওঠে তাই সারাজীবন তাকে চালিত করে।

এরপর ঘটে আরেক ঘটনা। যা খুবই চিন্তার এবং বেদনার।

অনেক বছর পর স্ট্যানফোর্ডে আবার সেই একই পরীক্ষার আধুনিক সংস্করণ করে। এবার শুধু মার্শমেলো নয় । সাথে যোগ হয়েছে স্মার্ট ডিভাইস।

ফলাফল?

২০ জন শিশুর মধ্যে ১৮ জনই মার্শমেলো ছেড়ে আগে হাত বাড়িয়েছে ডিভাইসের দিকে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আজকাল মানুষের মন প্রতি চার সেকেন্ডে একবার বিভ্রান্ত হয়। আর একবার মন বিভ্রান্ত হলে সেই মনকে আবার আগের কাজের কেন্দ্রে ফেরাতে গড়ে লাগে প্রায় ৩২ মিনিট। আমাদের মন এখন একটি পিং পং বলের মতো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে অনবরত। কোনো গভীরতায় সে আর স্থির থাকতে পারছে না।

এই ডিভাইস-নির্ভরতা শিশুদের কনসাসনেসে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করছে। শুধু শিশুরা নয়। প্রাপ্তবয়স্করাও এই নেশার ফাঁদে বন্দী।

আজকাল কেউ আর দীর্ঘ লেখা পড়তে চায় না। প্রতি চার সেকেন্ডেই আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি পড়বো কি পড়বো না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যেই তৈরি হয়েছে নতুন আসক্তি। আমরা জানি না ঠিক কবে থেকে আমাদের আঙুল নিজের ইচ্ছেতেই স্ক্রিনে ওপরে নিচে নেমে যাচ্ছে, এক রিল থেকে আরেক শর্টসে। এক মিম থেকে আরেক গিফে।

ঠিক যেমন ক্যাসিনো মালিকেরা জানেন ক্যাসিনোতে সবাই জিতে না, বেশিরভাগই হারে। তারপর যায় এক নেশায়। আজকের প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা জানি রিলস বা শর্টস দেখে বড় কিছু শিখছি না। তবু আমাদের মন যেন বাধ্য হচ্ছে দেখতে। আমাদের আঙুল, চোখ আর মন সব যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

আমরা বসে থাকতে পারি না। মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না, গভীর চিন্তা করতে পারি না। ফিলানত্রোপিস্ট ওয়ারনে বাফেট প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচশত পাতা পড়েন। আগামী পৃথিবীতে হয়তো মহাযুদ্ধ হবে। কিন্তু মহাকাব্য আর রচিত হবে না। কারণ আমাদের এখন পাঁচ শ রিল দেখার সময় আছে কিন্ত পণ্চাশ পাতা পড়ার সময় নাই। আমাদের এই ব্যাধির শুরু হয়তো আমাদের অজান্তেই হয়েছে কারো মার্শমেলো দিয়ে আর কারো একটা স্মার্ট ডিভাইস দিয়ে।

এই অবস্থা সত্যই আশংকাজনক আর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। শিশুদের মধ্যে ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে। বয়স্কদের মন ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে।

আর আপনি যদি এই লেখাটি ধৈর্য ধরে এতোক্ষণ পর্যন্ত পড়ে থাকেন তবে আপনি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন আপনার ভেতরে এখনো অপেক্ষার, মনোযোগের, চিন্তার শক্তি বেঁচে আছে। যে শক্তিটা এই অস্থির সময়ে সবচেয়ে মূল্যবান। আর এজন্য আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৬

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

জুলাই আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতা ছিলেন না , তাকে কেউ চিনতো না কয়েক মাস আগে ও ।

জুলাই জংগীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ৩০ দেশের দুষ্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদুত বদলায়ে দিচ্ছে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২৩



আইয়ুব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার পর, বাংগালীদের লাথি খেয়ে সরেছে; জিয়া, কর্নেল তাহের ও জাসদের গণ বাহিনী আমাদের দেশকে নরক (১৯৭৫ সাল ) বানিয়ে নিজেরা নরকে গেছে। আমাদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×