ঘড়ির কাটা সাড়ে এগারোটার ঘর
ছুঁই ছুঁই করছে।
দাঁড়িয়ে আছি কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের
সুপ্রসিদ্ধ এবং প্রাণবন্ত
সাত্তার খান টাওয়ারের সামনে।
সিঁড়ির বেশ কয়েক ধাপ
উপরে একপাশ ঘেঁষে।
হাতে সমকালের ঈদ সংখ্যা ২০১৪।মাত্র
কিনলাম।ঝকঝকে তকতকে ।গ্লাস
পেপারের
তৈরি একটি প্যাকেটে মোড়ানো।সাথে রান্না বিষয়ক ছোট্ট পুস্তিকা একদম ফ্রি।
দাম খুব চড়া।আমার ধারণার
চেয়ে ঢের বেশি।দুইশ টাকা।
সমকালের ঈদ সংখ্যা এই আমার
প্রথম কেনা।
আসলে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি এক
বন্ধুর জন্য।একই জায়গায়
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমার
মতো আরো কিছু মানুষ
অপেক্ষার প্রহর গুনছে।এদের
মধ্যে নারী পুরুষ উভয়শ্রেণীই
চোখে পড়ছে।শহরের জনসমুদ্রের
মধ্যে খুব
সহজে কাউকে খুঁজে পাওয়া এরচেয়ে উত্তম
পন্থা তেমন নেই বললেই চলে।
কারণ,এই সুবিশাল নান্দনিক
মার্কেটটি চেনে না কুমিল্লা জেলায়
এমন মানুষ হাজারে একজন
পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।'এই
বলল, সাত্তার খানের
সামনে চলে এসো; চলে এলাম'।
বিশেষ করে কান্দিরপাড় এলাকায়
এই স্থানকেই বেছে নেয় সবাই।
এটির সংলগ্নই খন্দকার টাওয়ার ।
আর বিপরীত
পাশে ময়নামতি গোল্ডেন টাওয়ার।
মোটামুটি কুমিল্লা শহরের
মধ্যে এই
তিনটিকে সেরা এবং অভিজাত
শ্রেণীর মার্কেট বলা যায়।
আরো একটির কথা না বললে ভুল
হবে হয়ত।সেটা হচ্ছে শাসনগাছার
ইস্টার্ন প্লাজা।
ঈদের কেনাকাটার ধুম পড়েছে।
মানুষের উপচে পড়া ভিড় এসব
মার্কেটে।গেটের
মাঝে দাঁড়ালে নির্ঘাত
জনস্রোতে ভাসিয়ে ভিতরে নিয়ে যাবে কিংবা বাইরে রাস্তার
উপর নিয়ে ফেলে দেবে।
অপেক্ষমান সবাই একটু পাশ
ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।তাছাড়
া মাঝে দাঁড়ালে কর্তৃপক্ষ
কটুবাক্য 'ঈদ বোনাস' দেবেন
নিঃসন্দেহে ।
গেটের সাথেই
আড়াআড়ি বয়ে গেছে রাস্তা।
রিক্শা,অটো রিক্শা,সিএনজির
যেন হাট মিলেছে এখানে।গরুর
হাটের
মতো;এমনভাবে আটকে আছে জ্যামে।
খানিকক্ষণ পর পর রিক্শার
পেছনে ধাম ধাম
করে ঘাঁ মারছে রোডগার্ড।মানুষের
এই ঢলের মধ্যে আমার চোখ
নিবদ্ধ হয়ে আছে ভিন্ন এক
শ্রেণীর মানুষের দিকে।
ওরা এখানে কেনাকাটা করতে আসেনি।
সংখ্যায়ও একেবারে নগণ্য।
হাতে গোনা কয়েকজন।ওরা সিঁড়ির
একদম নীচে সমতল জায়গাটায়
মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেও
ঘুরঘুর করছে।একবার এর
কাছে আবার ওর
কাছে এভাবে বিরামহীন হাত
পেতে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে আবার
নাছোড়বান্দার
মতো আলতোভাবে কারো হাত
ধরে বসছে।কেউ দিচ্ছে দু
একটি টাকা কেউবা উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে।
এদের মধ্যে আমার দৃষ্টি কেবল
এক বৃদ্ধার দিকে।
রং জ্বলে যাওয়া জোড়াতালি বিশিষ্ট
একটি বোরকা পরিহিত।মুখ আবৃত
রাখার অংশটুকু মশারির কাপড়ের
তালিযুক্ত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
হাত পা খোলা।চামড়ায় কয়েক
ভাজ পড়ে গেছে ।আমার
দাদি নানির বয়সের হবে।
পায়ে পঞ্চাশ ষাট টাকা দামের
একজোড়া 'বার্মিছ' স্যান্ডেল।
সাদা চটিতে নীল ফিতাবিশিষ্ট।দেখ
ে খুব মায়া লাগছে।বৃদ্ধ
মহিলা প্রতিবন্ধী বা বিছানায়
পড়া নয়।
এখনো চটপটে হাঁটাচলা করতে পারে।
তাইতো হেঁটে হেঁটে এর ওর
কাছে হাত পাতছে।এখানে লোক
সমাগম বেশি হওয়ায় কামাই হয়ত
একটু চড়া।তাই এখান দিয়েই ঘুরঘুর
করে।খানিকটা পর
আমাকে সম্পূর্ণ অবাক
করে আরেক ভিক্ষুক এসে হাজির
হল।দুটি পায়ের একটিও নেই।উরুর
মাঝামাঝি থেকে নেই। এই প্রচণ্ড
জ্যামের ভিতর হঠাৎ এখানে এল
কী করে? আমি চিন্তায়
পড়ে গেলাম।রিক্শায় এল
কিনা ভাবলাম একটুক্ষণ। কিন্তু
জ্যামের
মধ্যেতো উড়ে চলবে না রিক্শা।
তাহলে ?আমার
দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে রাস্তার একদম
কিনার
দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এসেছে।
কাদা মাটিতে মাখামাখি।বাচ্চা
রা দেখলে নিশ্চয়ই ভয় পাবে।
হাতে একটা লাল রঙের
প্লাস্টিকের গামলা।
গামলাটা কীভাবে যে উপরমুখি করে রাখে কে জানে!
কয়েক মিনিট
বাদে চলে গেলো করুণ ভিক্ষুকটি।
গিজ গিজে মানুষের কারণে তার
সমস্যা।কে কোন সময়
পাড়া টাড়া দিয়ে বসে সেই
ভয়ে হয়ত। এবার লাঠিতে ভর
করে সামান্য
কুঁজো দাড়ি পাকা এক বৃদ্ধ এল।
দেখতে বেশ সবলই মনে হয়।
সে এখানে স্থির হল বেশ
কিছুক্ষণ।তখনই দেখলাম এক
মজার খেলা।বৃদ্ধের
প্রতি অগ্নিমূর্তি হয়ে হাত
নেড়ে নেড়ে শক্তভাবে ধমকাচ্ছে বৃদ্ধা।
যেন এই এরিয়া সে দলিল
করে নিয়েছে।আর কেউ
এখানে স্থায়ী হতে পারবে না।তার
ব্যবসার ঘাটতি হচ্ছে।
বকুনি খেয়ে বৃদ্ধ
লোকটা ভেজা বিড়ালের
মতো কোন প্রতিবাদ ছাড়াই
অন্যদিকে পা বাড়াল।কাণ্ড
দেখে মৃদু হাসলাম।আমার কেন
যেন মনে হল এই দুইজনই
পেশাদার ভিক্ষুক।প্রকৃত ভিক্ষুক
ছিল পা বিহীন চলে যাওয়া সেই
নিরীহ মানুষটি।আরো একজন
মহিলা প্রতিবন্ধী চোখে পড়ল
এইমাত্র।গেটের পাশেই ছিল কিন্তু
লক্ষ করতে পারিনি।
আমি সারাক্ষণ ঐ বৃদ্ধ মহিলার
কাণ্ড দেখছি।প্রতিবন্ধী মহিলার
পা দুটো বাঁকানো এবং তুলনায়
অনেক ছোট ছোট।তার
সামনে রাখা গামলাটিতে এক
কপি লেমিনেটিং করা ফটো।
ফটোতে তিনটি একই রকমের
প্রতিবন্ধী মানুষ।তার
মধ্যে একজন সে নিজেই।
বাকিরা তার সন্তান