ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই চলছে।কোন
লড়াইয়ের ময়দানে নয়;মুনশির
গোয়ালে।কুচকুচে কালো পাহাড়ের
মতো দুই ষাঁড় মুনশির।এ দুটোর
মধ্যে সারাক্ষণই লড়াই চলতে
থাকে।
কখনো হাড্ডাহাড্ডি ,কখনো কুস্তাকুস্তি।
গলার
ডানে বামে গভীরভাবে পোঁতা বাঁশের
খোঁটা।এর
সঙ্গে মোটা রশি দিয়ে দুই
দিক
থেকে বেঁধেও দমাতে বার্থ মুনশি।
সেদিনও রাতের
গভীরে রশি ছিড়ে নতুন
মশারিটা ঝুলিঝুলি করে ফেলে।
গোয়ালের মেঝেতে বিছানো ইট।
খোঁটা,ইট,গোয়াড়া দুইদিন পরপরই
ঠিকঠাক করতে হয় মুনশির।
ওদের এই লড়াই ক্ষোভের
নাকি আনন্দের ওরাই জানে!
আর গুঁতাগুঁতিতে উস্তাদেরও উস্তাদ।
মানুষের গন্ধ পেলেই সাপের
মতো ফোঁস করে উঠে।
এমনকি মালিক মুনশিকে পর্যন্ত
চুল পরিমাণ ছাড় দেয় না।আর
কোনমতে যদি একবার ছুট পায়
তাহলেতো রক্ষা নাই।সারা গ্রাম
চষে বেড়ায়।যেন আজরাইল
ছুটেছে।ভয়ে সকলে ঘরে দোর
দিয়ে বাঁচে।মসজিদের
মাইকে ঘোষণা করা হয়'মুনশির
আইড়্যা ছুটছে আপনারা সবাই
সাবধান'।এমন বজ্জাত ষাঁড় দুই
চার দশ গ্রামে আছে কিনা সন্দেহ।
এর জন্যে অনেকবার
জরিমানা পর্যন্ত
দিতে হয়েছে মুনশিকে।গ্রামের
মানুষও অসহ্য।গাল
ভরে ভরে নোংরা কথার বান
ডাকে নিত্যদিনই।অনেকে আবার
হিংসায় এসব বচন ছাড়ে।অন্যের
গোয়ালে এমন দুই সম্পদ দেখতে রাজি না তারা।
আজও পাশের বাড়ির ছমেদ
আলী মুনশিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল
'দুইড্যা পাডা বানাইছে যাইর
জুইন্নি রাইতেও ঠিকমতোন
ঘুমাইত পারিন্যা'।
দেখলে সত্যিই মনে হবে, মুনশির
প্রতি এসব কটুবাক্য
নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও অবিচার।কিন্তু
মুনশি অপরাধীর মতোই সব সহ্য
করে নেন।
এসব কিছুর পরও মুনশি ষাঁড়
দুটোকে বড়ই ভালোবাসেন।
তদারকির ব্যাপারে খুবই সচেতন।
রুটিন মাফিক খাওয়া।দিনে দুই
বেলা কুড়া,ভুসি,ভাত মিলিয়ে ঘণ
থনথনা পানি।
বাকি সময়গুলোতে চার
ঘন্টা পরপর খড় এবং কাঁচা ঘাস। নিজে যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন
নিজ হাতেই এসব কাজ সম্পাদন
করেন।
মাঠে ঘাটে চলে গেলে তার
স্ত্রী সব দেখাশোনা করেন।ষাঁড়
দুটোর পরিচর্যায় পান থেকে চুন
খসলে স্ত্রীর উপর খুব চটে যান
মুনশি।পাশাপাশি পশু চিকিৎসকের পরামর্শও নেন নিয়মিত।নিজের পরিবারের প্রতিও
এতটুকু সচেতন এবং যত্নবান
নন যতটুকু ষাঁড় দুটোর প্রতি।
টেনেটুনে চলে তার বিশাল সংসারটা।এই বিশাল সংসারের
ঘানি টানতে টানতে তিনি এক
প্রকার নুইয়ে পড়েছেন।আজকাল
শরীরটা প্রায়ই খারাপ করে।
শ্যামবর্ণ
শরীরটা রোদে পুড়ে কয়লা সদৃশ
হয়ে গেছে।এই মাঝ বয়সেই
বার্ধক্যের ছাপ
ফুটে উঠেছে স্পষ্ট।তবুও
তিনি খেটেই চলছেন অবিরাম।তার
রক্তে মাংসে মিশে গেছে এই
পেশা।কৃষি।গৃহস্থালী।এর থেকেই
ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা,খাবার-
দাবার,পোশাক-আশাক,চিকিৎসা-
পাতি সমস্ত খরচ।এবার ষাঁড়
দুটোকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন।
কুরবানির আর মাত্র তিনদিন বাকি।
আজ স্থানীয় হাটবার।ষাঁড়
দুটোকে হাটে নিয়ে যাওয়া হবে।
মুনশি তার চার পাঁচজন
আত্মীয়কে আগে থেকেই
আসতে বলেছিলেন।
তারা যথাসময়ে চলে এসেছেন।ষাঁড়
দুটোকে জামাই
সাজে সাজানো হয়েছে।গলায়
কাপড়ের ফুলের মালা এবং ঘাগরা।
শিংয়ে লাল খয়রি কাপড়ের কভার।
কপালের চিতার উপর জরি বিশিষ্ট
সাদা কাপড়ের আরেক
পানপাতা ফুল।
মোটা লাল রঙের
দুইটি রশি ধরে দুই পাশে দুইজন
এবং পিছনে একজন ।
এভাবে দুইটি গরুকে ছয়জনে মিলে হাটে নিয়ে যাচ্ছেন।
মুনশির হৃদয়টা কেবলই হুঁ হুঁ
করে উঠছে।কীভাবে তিনি ক্রেতার
হাতে তুলে দেবেন এই রক্ত মাংস
মিশে যাওয়া পোষাপ্রাণী দুটোকে।
তার মনে হচ্ছে তিনি তার
দুটো সন্তান উৎসর্গ
করতে যাচ্ছেন।যেমনটা করেছিলেন
নবী ইবরাহিম (আঃ)।এসব
ভাবতে ভাবতে মুনশির চোখ
গলে গড়িয়ে পড়ল এক
ফোটা উষ্ণজল।নিষ্ঠুর
বাস্তবতা হাজার কষ্ট সত্যও
কেবল মানুষকেই মেনে নেওয়ার
শক্তি দেওয়া হয়েছে ।এ
কথাটা কোথায় যেন শুনেছিলেন
তিনি।সেই ছোট বেলায়।
চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন
না মুনশি।