somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কান্ডারি অথর্ব
আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূণ্যতা থেকে শূণ্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।

আলোর কোলাহলে নিখোঁজ জোছনা

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





পার্কে আজ বাউল গানের জলসা বসেছে। বাউল ফকিরের কণ্ঠে বিমূর্ত আর্তনাদ। সময় গেলে সাধন হবে না.... চুপ করে জলসার এক কোনে বসে গাঁজা ধরালাম। মুহূর্তের ভেতর চারদিকটা সুন্দর মনে হতে লাগল। আসলে কষ্ট আর ভালোলাগাগুলো আপেক্ষিক। এই যেমন এই মুহূর্তে আমার ভেতর কোন কষ্ট নেই। গানের জলসা শেষ হতে হতে প্রায় ভোর হয়ে এলো। জলসা ভেঙ্গে যে যার মতো করে চলে গেছে সবাই। কেবল আমারই বাড়ি ফেরার কোন তাড়া নেই। সকাল বেলাটাতে পার্কে বসে থাকার মাঝে এক ধরনের শান্তি কাজ করে। কেউ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাটছে, কেউবা দৌড়াচ্ছে। সবার মাঝে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার একটা জোড়াল তাগিদ কাজ করে।

কয়েকদিন ধরে নিয়মিত পার্কে আসতে আসতে অনেকের চেহারাই এখন পরিচিত। গফুর মিয়া ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করে। প্রতি ডাবের মূল্য চল্লিশ টাকা। মাঝে মাঝে ডাব কাটলে পানি পাওয়া না গেলে মানুষের সাথে তার বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয়। কাটার পর পানি না পেলে তখন কেউ ডাবের দাম দিতে চায় না কিন্তু গফুর মিয়াও নাছোড় বান্দা। ডাবের ভেতর পানি না থাকলে তো আর তার কোন দোষ নেই। সেতো আর ডাবের পানি বানায় না। প্রতিটা ডাব তাকে টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয় তাই কোনটার দাম না পেলে তার যে ক্ষতি হবে সেটা সহজেই সে মেনে নিতে পারেনা। ডাব যখন কাটিয়েছে দাম তাকে দিতেই হবে। গফুর মিয়ার স্বপ্ন তার ছেলে একদিন শিক্ষিত হয়ে ভাল চাকরী করবে তাই সে তার ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে। কিন্তু আজকে স্কুলের বেতন দেয়ার শেষ তারিখ। অথচ তার কাছে টাকা নেই। মাথায় হাত দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে দোষারোপ করে চলেছে।

আজকে প্রচন্ড গরম পরেছে। সকাল বেলাই রোদের প্রখরতা প্রচন্ড রুপ ধারন করেছে। প্রচন্ড তৃষ্ণাও পেয়েছে। কিন্তু ডাব কিনে খাওয়ার মতো টাকা নেই পকেটে। দুই টাকা আছে। এই দুই টাকা দিয়ে বিকেল পর্যন্ত চলতে হবে। যে শহরে এক গ্লাস পানির দাম এখন এক টাকা সেখানে দুই টাকা দিয়ে বড় জোড় দুই গ্লাস পানি কিনে খাওয়া যাবে। এর বেশি বিলাসিতা সম্ভব নয়। বাবুকে কিছু টাকা ধার দেয়ার জন্য বলেছি। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। চাওয়ার সাথে সাথে টাকা ধার দেয়ার জন্য রাজী হয়ে যাওয়া। তাও আবার নিজে এসে টাকা দিয়ে যাবে। এটা হয়ত তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা রুপ। বাবুর ছোট বোনের একবার কি এক ভয়ানক অসুখ হল। সেরে ওঠার কোন নামই নেই। কিন্তু তখন ওর আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় আমি সাহায্য করেছিলাম। আর এখন উল্টো সেই কৃতজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আমি বাবুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে চলছি। জীবন বড়ই বিচিত্র, কখনও উত্থান - কখনও পতন। বাবু বলেছে বিকেলে এসে কিছু টাকা ধার দিয়ে যাবে। তাই বিকেলের অপেক্ষা না করে অন্য কোন উপায় দেখছিনা। রুমকির বাসায় গেলে মন্দ হতো না। এই সময়টাতে রুমকির বাবা-মা বাড়িতে থাকেনা। অন্তত গোসল করে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। কিন্তু এই দুপুর রোদে হেটে হেটে এতটা পথ যেতেও ইচ্ছে করছেনা। দোকান থেকে রুমকির মোবাইলে ফোন দিলাম। দোকান বলতে পার্কে একটা টুল নিয়ে বসা। প্রতি মিনিট কল মাত্র দুই টাকা।

-রুমকি বাসায় আছিস ?
-নাহ ! নেই।
-আমি কি আসতে পারি?
-নাহ ! পারিস না। বলেই রুমকি লাইনটা কেটে দিল।

এখন আর উপায় নেই। দুইটা টাকাই সম্বল ছিল। তাও ফোন করে শেষ হয়ে গেল। অগ্যতা রুমকির বাসায় হেটে হেটেই রওনা হোলাম।

প্রত্যেক লোকের জীবনেই হয়ত এমন একজন নারী আসে, যাকে দেখেই মনে হয়, হ্যাঁ, এই হলো আমার যোগ্য সঙ্গিনী, এর সাথেই আমার জীবন কাটাতে হবে। আমার জীবনে সেই নারী হলো রুমকি। কিন্তু এই জীবনে সব চাওয়া পূর্ণতা পায়না। সব বিলাসিতা স্বপ্নের ডানা মেলে আকাশে ঘুড়ি হয়ে ছুটে বেড়ায় না। রুমকি স্কুলের শিক্ষকতা করে কিন্তু তার সবচেয়ে বড় গুন হলো খুব ভালো ছবি আঁকে মেয়েটি। কিন্তু সেসব ছবি শুধুই নিজের মনের তাগিদে আঁকা কখনও তার মাঝে ছবি আঁকা নিয়ে পেশাদারিত্ব মনোভাব দেখা যায়নি। রুমকি কেবল সুন্দরীই না, খুবই জ্ঞানপিপাসু। অথচ এমন একটি মেয়ের জীবনে বিধাতা স্বয়ং দুঃখ এঁকে দিয়েছেন।

আমি যে মেসটিতে থাকি তার পুরোটার সমান রুমকির বাথরুম। বাথরুমে বিশাল এক বাথটাব। সেখানে ঠাণ্ডা আর গরম পানির সুব্যবস্থা রাখা আছে। মেসের মালিক গত সপ্তাহে বিগত কয়েক মাসের বকেয়া ভাড়া চাইতে এসেছিল। তখন তাকে বলেছিলাম, “চাচা যেই না আপনার মেস তার আবার ভাড়া চান। আরে ! চাচা আপনার পুরো মেসের চেয়ে বড় বাথরুমে ফ্রিতে গোসল করি। আর আপনি আমার কাছ থেকে ভাড়া চেয়ে অযথাই আমাকে লজ্জা দেন”। ব্যাস রেগে গিয়ে চাচা বলল, “তা বাবা যাও, গিয়ে বাথরুমে সংসার ধর্ম কর্ম পালন কর গিয়ে। আমাকে আর জ্বালাতন করোনা”। সেই যে ওইদিন মেস ছেড়েছি, এখন পর্যন্ত ভবঘুরে দিন কাটাচ্ছি।

পুরো বাথটাবটা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভরে ফেললাম। তারপর পরনের শার্ট আর প্যান্ট খুলে পুরো নগ্ন হয়ে বাথটাবে শরীরটাকে শুইয়ে দিলাম। যখন আমার ঘরেতে আঁধার নেই এক ফোঁটা কেরোসিন তখন রুমকির বাথরুমে এয়ারকন্ডিশন দেখে অবাক হোলাম না। বরং নিজের প্রতি করুণাই হলো আমার। যাই হোক এসি ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম চলে এলো। গোসল সেরে বেরুতেই রুমকি আমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খাবে বলে বেরুতে চাইল। আমিও খুশি মনে রুমকির পেছন পেছন বেড়িয়ে পরলাম।

রুমকি আজ সাদা রঙের শাড়ি পরেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রুমকিকে। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে কোন এক ডানা কাটা পরী নেমে এসেছে এই নষ্ট শহরে। রুমকিকে দেখে হঠাৎ আমার মায়ের কথা খুব মনে পরে গেল। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মাকে দেখতাম এমন সাদা রঙের শাড়ি পরে থাকতে। তারপর একদিন মাটাও চলে গেল। খুব বড় লোকের মেয়ে হলেও রুমকির ভেতর কোন অহমিকা নেই। সে ইচ্ছে করেই একটি স্কুলের শিক্ষকতা বেছে নিয়েছে। আজ রুমকির পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় বেশি বেমানান লাগছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন ছোট হলেও আমার নিজের একটি দোকান ছিল। এটাকে আসলে দোকান বলা যাবেনা। নীলক্ষেতের ফুটপাতের উপর দুই ফিট বাই আড়াই ফিট একটি স্টল ছিল। ছোট বেলা থেকেই বইয়ের প্রতি অসম্ভব নেশা ছিলো আমার। আর তাই নিজের সব শ্রম ঢেলে দিয়েছিলাম বইয়ের দোকানের জন্য। কিন্তু বিধাতার সেই সুখ যেন সহ্য হলনা। একরাতে পুরো নীলক্ষেতে আগুন লেগে সব শেষ হয়ে গেল। আর্থিক ভাবে পঙ্গু হয়ে গেলাম। অনেকেই আবার নতুন করে শুরু করেছে কিন্তু আমার জন্য সেটা অনেক কঠিন। এখন সেই কঠিনকে সহজ করার পরীক্ষা দিচ্ছি প্রতি মুহূর্তে।

রুমকির মোবাইলে রিং বাজছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ফোন কল রিসিভ করতে তার মোটেও ইচ্ছে করছেনা। ফোন রিসিভ করলেই হয়ত তার স্কুলের কোন ছাত্র বলবে আচ্ছা ম্যাডাম সোনার তরী কবিতায় কবি যেন কী বোঝাতে চেয়েছেন বলেছিলেন ?

অথচ ক্লাসে কতবার রুমকি পড়িয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সোনার তরী কবিতায় নিঃসঙ্গ কৃষকের ট্র্যাজেডি বর্ণনার অন্তরালে নিজের সৃষ্টিশীল সত্তার ট্র্যাজেডিকেই ব্যক্ত করেছেন। কৃষক হচ্ছে কবি নিজে অথবা সমগ্র মানব, সোনার ধান হচ্ছে কর্ম ফসল আর সোনার তরী হচ্ছে মহাকাল। কৃষক যেমন তার সব সোনার ধান নিয়ে সোনার তরীতে উঠে বসতে চায় তেমনি সব মানুষই চায় তার সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে সঙ্গে যেন সেও সবার মনে বেঁচে থাকে। কিন্তু নিষ্ঠুর মহাকাল মানুষের সৃষ্টিকর্মকে এক যুগ থেকে আরেক যুগে বহন করে নিয়ে গেলেও ব্যক্তিসত্তাকে ফেলে যায়। একলা মানুষ শূন্য নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে মহাকালের গর্ভে বিলীন হওয়ার জন্য। অথচ এই সহজ কথাগুলো ছাত্ররা বুঝতে পারেনা হাজার বার বোঝালেও। তারপর ফোন করে বিরক্ত করে রুমকিকে আরেকবার বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। সেও ধৈর্য নিয়ে ফোনে বুঝিয়ে দেয় কখনও শিপ্লুকে, কখনও হারুনকে, কখনও বুঝিয়ে দিতে হয় মহসিনকে। কে জানে এখন আবার কাকে বুঝিয়ে দিতে হবে ! ফোন রিসিভ করতেই ভারী কণ্ঠের আওয়াজ।

-রুমকি বলছেন?
-জী বলছি।
-স্লামুয়ালাইকুম ম্যাডাম, আমি থানা থেকে ওসি সোবহান বলছি। আপনাকে কষ্ট করে একটু থানায় একবার আসতে হবে।
-কেন বলুনতো হঠাৎ করে আমাকে থানায় প্রয়োজন হলো ?
-জী ম্যাডাম, আমরা আসলে একটি মানিব্যাগ আর সানগ্লাস পেয়েছি। আপনি আসুন এলেই জানতে পারবেন।
-মানিব্যাগ আর সানগ্লাস পাওয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক আমিত কিছুই বুঝতে পারছিনা।
-আপনারা বছর খানেক আগে শফিক নামের এক ব্যাক্তির নিখোঁজ হওয়ার জন্য থানায় একটি রিপোর্ট লিখিয়েছিলেন, মনে পরেছে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ রুমকির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা; আমি আসছি এখনই, আপনারা আমার শফিককে খুঁজে পেয়েছেন ?

ফোন কেটে দিয়ে রুমকি থানার পথে রওনা হতে চাইল। একটি রিক্সা ঠিক করে তাতে উঠে বসি রুমকির পাশে। রুমকির চোখে এই প্রথম পানি গড়িয়ে পরতে দেখলাম। অঝরে কাঁদছে মেয়েটা। মাঝে মাঝে কান্নাগুলোকে চাঁপা দিতে নেই। তাতে করে কষ্টগুলো শান্তির স্পর্শ ফিরে পায়। তাই ওর কান্নার মাঝে কোন বাঁধা দিলাম না। ওর সাথে যেন পুরো প্রকৃতি আজ নীরবে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে রুমকি আমার হাতের উপর ওর হাত রেখে বলে, একটা সময় কত স্বপ্ন যে সে দেখেছে। রিক্সায় শফিক পাশে বসে থাকবে তার হাত ধরে। তারপর দুজনে মিলে রোদের মধ্যে ঘুরবে। বিকেল হলে কোথাও বসে দুজনে মিলে ফুচকা আর রং চা খাবে। শফিকের রং চা খুব পছন্দ আর সাথে যদি আদা, লংকা আর লেবু পাতা থাকে তাহলেত কথাই নেই। রুমকির স্কুলের সামনে একটি দোকানে এমন রং চা পাওয়া যায়। কতবার ভেবেছে শফিক এলে এখানে ওকে নিয়ে এসে দুজনে মিলে প্রতিদিন চা খাবে !

শফিকের সাথে রুমকির পরিচয় হয় ওর এক চাচাত বোনের বিয়েতে। সেই থেকে প্রেমের সূচনা। শফিকের একটি ছোট খাটো বায়িং হাউস আছে। যত স্বপ্ন, ভালোবাসার যত কথা তার সবটাই হতো ফোনে ফোনে। খুব বেশি সময় নিয়ে তারা দেখা করতে পারতনা। পাছে কেউ দেখে ফেললে রুমকির জন্য ব্যাপারটা খারাপ কিছু হতে পারে ভেবেই লুকিয়ে লুকিয়ে দুজনকে ঘুরতে হতো। কিন্তু চেনাজানা এই শহরে এভাবে লুকিয়ে ঘুরাটা খুব একটা সম্ভব হতোনা। অবশেষে তাদের বিয়ে ঠিক হয় পারিবারিক ভাবেই।

বিয়ের আগের রাতেও শফিক রুমকিকে ফোন দেয়।
-রুমকি তুমি কিন্তু মোটেও হাতে মেহেদী আঁকবেনা। আমি ওগুলো একদম পছন্দ করিনা।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। কিন্তু বিয়েতে এটাই নিয়ম মেয়েরা হাতে মেহেদী আঁকে। মেয়েদের জীবনে এই একটি সময়ইত আসে। তুমি কি চাওনা তোমার রুমকি তোমার ঘরে সুন্দর করে বউ সেজে আসুক ?
-তা কেন চাইব না।
-তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মত এখন শান্ত হও। আর শোন এখন অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পর।
-আরেকটু কথা বলি ?
-না, মোটেই না। এখন আমি ঘুমাবো। কাল অনেক ধকল পোহাতে হবে। এই একটি দিনের জন্য কত অপেক্ষা করে থেকেছি। কাল থেকে দেখব কত কথা তুমি আমাকে বলতে পার। ঘরে এলে দেখবে আমাকে ভুলেই গেছো। তখন আর আমাকে ভালো লাগবেনা তোমার। আমার সাথে হয়ত কথা বলার ব্যাকুলতাও তোমার এমন থাকবেনা।
-মোটেও না। আমার ভালোবাসা দিন দিন শুধু বাড়বে। তুমি দেখো, আমি তোমাকে অনেক আদর করব।
-আচ্ছা ! দেখা যাবে ? এখন আমাকে ঘুমাতে দাও প্লীজ লক্ষী!
-হুম ঘুমাও তাহলে !

সকাল থেকেই বাড়িতে আনন্দের ধুম পরে যায়। উঠোনে প্যান্ডেল টাঙ্গানো হয়। বাবুর্চিরা রান্না করতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। পার্লার থেকে রুমকিকে বউ সাজিয়ে আনা হয়। সেদিন গোলাপি বেনারশি শাড়িতে রুমকিকে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য ফোঁটা একটি তাজা গোলাপ ফুল। ধীরে ধীরে মেহমানরা আসতে শুরু করে দেয়। একদল এসে খেয়েও ফেলে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। কিন্তু বর যাত্রীদের আসার কোন লক্ষন দেখা যায়না। কয়েকবার ফোন করাও হয়। প্রতিবারই শফিকদের বাসা থেকে বলা হয় এইত চলে আসবে তারা। হ্যাঁ শফিকদের বাড়ি থেকে কয়েকজন গিয়েছিলেন। তাও গভীর রাতে। যখন রুমকিদের পুরো বাড়িতে চলে শোকের মাতম যেন কিছুক্ষণ আগেই মারাত্মক কোন ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব কিছু।

শফিককে হঠাৎ করেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোথাও খোঁজ করে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছিলনা । একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। দুই পরিবার থেকেই থানায় ডায়েরী করা হয়েছে। পত্রিকায় ছবি সহ হারানো বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ নেই শফিকের। একটি জলজ্যান্ত মানুষের এভাবে বিয়ের দিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে পরাটা কেউ স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার উপর প্রেমের বিয়ে। এমন নয় যে ছেলের অমতে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল। বরং শফিকের চাপেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই দিন থেকে আজ প্রায় বছর কেটে গেলো কিন্তু শফিকের আজও কোন সন্ধান নেই। সে আর ফিরে আসেনি। একটা সময় সবাই ধরেই নিলো হয়ত সে আর বেঁচে নেই অথবা বেঁচে থাকলেও আর কোন দিন হয়ত ফিরে আসবেনা। আর ফিরে এলেও এমন একটি ছেলের সাথে রুমকির কোন সম্পর্ক আর হতে পারেনা।

কিন্তু জীবন থেমে থাকতে পারেনা। অন্তত সমাজে চলতে হলে বুকের ভেতর অনেক কিছু চাঁপা দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার নামইত জীবন। জীবনের যাপিত ব্যাঞ্জনা। তারপর রুমকি নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তবু বুকের ভেতর কোথায় যেন শফিকের প্রতি একটু খানি ভালোবাসা রয়েই যায়। ভালোবাসার মৃত্যু নেই। হয়ত লুকিয়ে রাখা যায় কাউকে খুশি করতে; কান্না চেপে রাখার মাঝেই সত্যিকারের কল্যান নিহিত থাকে বলেই।

থানায় বসে ওসি সোবহান খুব আয়েশ করে সিগারেট টানছে। লোকটার ভেতর সামান্য সৌজন্যতা বোধটুকু নেই। আমাদেরকে সে একবারের জন্যও বসতে বলার প্রয়োজন মনে করলনা। নিজের মনে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। যেন রুমকিকে সে ডেকেই এনেছে তার সিগারেট টানার এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখাবে বলেই।

-স্লমুয়ালাইকুম ভাই। আপনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন।
-ও হ্যাঁ ! আপনি মিস রুমকি ?
-জী।
-এই দেখুনত মানিব্যাগ আর সানগ্লাসটি চেনেন কিনা ?

রুমকি মানিব্যাগটি হাতে নিয়ে খুলে দেখে শফিকের কিছু ভিজিটিং কার্ড রয়েছে তাতে। ভিজিটিং কার্ডে শফিকের ছবি রয়েছে। মানিব্যাগে রাখা নিজের ছবি দেখতে পেয়ে দুচোখের কোনে অশ্রু নেমে আসে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে রুমকি জানতে চায় শফিক কোথায়?

ওসি সোবহান তাকে জানায় যে তারা কিছুদিন ধরে হায়দার নামের এক সন্ত্রাসীর খোঁজ করে আসছিলো। অসংখ্য খুনের মামলা রয়েছে তার নামে। হায়দারের কাজই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা। আর কারও কাছ থেকে চাঁদা না পেলেই খুন করা। হয়ত শফিককেও সে একারনেই খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছিল। শেষটায় চাঁদাবাজি করতে যেয়ে খুন করে বসে আশরাফ নামের এক বিশিষ্ট শিল্পপতীকে। সেই খুনের তদন্ত করতে যেয়ে হায়দারের বাসা থেকে এই মানিব্যাগ আর সানগ্লাসটি তারা উদ্ধার করে। কিন্তু হায়দারকে ধরা সম্ভব হয়নি। সে তাদের আসার খবর পেয়ে আগেই পালিয়ে যায়।

আমি রুমকির কাঁধে হাত রাখতেই; রুমকি শফিকের মানিব্যাগটি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। থানার ভেতর চার দেয়ালে সেই কান্নার শব্দ প্রতিদ্ধনি হয়ে ফিরে আসছে। সেই শব্দ এতটাই হৃদয় গ্রাহী যে ওসি সোবহানও তার ভেতর কান্না অনুভব করল। সেই কান্না সৌজন্যতা মূলক নয়। দুই আঙ্গুলের ভাঁজে রাখা সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিন্তু ধোঁয়াগুলো যেন শূন্যতায় কান্নার রং ছুঁয়ে ভালোবাসা পূর্ণ জোছনার ছবি আঁকছে।

উৎসর্গ শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ব্লগার মামুন রশিদ ভাইকে যিনি একনিষ্ঠ ভাবে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তার গল্প সংকলন করার পেছনে। আমি বিশ্বাস করতে চাই এই গল্প সংকলনের মাধ্যমে তিনি গল্পাকারদের সবসময় অনুপ্রেরনা দিয়ে যাবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪০
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছেন: সে সেনা তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন। (সাময়িক)

লিখেছেন মিথমেকার, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৩৩



খুলনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উন্মত্ত জনতার হা’মলায় আহত উৎসব মন্ডল সামরিক হাঁসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
উৎসব মন্ডল এর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বেশ ভালো। চিকিৎসকরা খুব আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিচ্ছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গল্পের শেষ নাই.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪

যে গল্পের শেষ নাই.....

পাসের সীটের যাত্রী সাথে আলাপচারিতায়- নাম জানার পর, জিজ্ঞেস করলাম- "বাড়ি কোথায়?"
ছেলেটি বলল- 'ঝালকাঠী, কীর্ত্তিপাশা গ্রাম।' কীর্ত্তিপাশা শুনেই বুকের ভিতরে উথাল পাথাল ঢেউ- এক কিশোরীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাই গণহত্যায় শেখ হাসিনার বিচার সরাসরি সম্প্রচার করা হবে!

লিখেছেন মিথমেকার, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯





"জুলাই গণহত্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার সরাসরি সম্প্রচার করবে সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শিগগিরই এই বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) উচ্চ পর্যায়ের এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কয়েন প্লান্ট বা পয়সা পাতা (বৃক্ষ পরিচিতি)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

০১। কয়েন প্লান্ট ( Hydrocotyle vulgaris)



কয়েন প্লান্ট বা পয়সা পাতা গাছ। দেখতে আগের দশ পয়সার মত এর পাতা। গাছগুলো খুব ঝুপালো হয়। পাতা গাঢ় সবুজ রংয়ের। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট হচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৫



আজ রাতে, ট্রাম্প ও কমলার মাঝে ডিবেইট!

দেশের সর্বোচ্চ পদের চাকুরীটার জন্য ৩য় বিশ্বে ডিবেইট হয় না; ফলে, বাংলাদেশের মানুষ কঠিন রাজনৈতিক ডিবেইট দেখার সুযোগ কখনো পাননি। আজকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×