বইটা অন্তর্জাল থেকে ডাউনলোড করার পর থেকে অনুবাদ করার তালে ছিলাম | নানা তুচ্ছ সাংসারিক কাজেকম্মে সেটা করার সময় পাইনি | এইবার এটা অনুবাদ করব | আশা করি পাঠকদের পড়তে ও বুঝতে সুবিধা হবে | তবে ভাবানুবাদ নয় বন্ধুরা, আক্ষরিক অনুবাদ যাতে করে লেখকের আসল বক্তব্যটা পাঠকের কাছে পৌছায় | ভাবানুবাদের নামে লেখকের জায়গায় নিজের স্বার্থমত উল্টোপাল্টা চিন্তা ঢুকিয়ে দেব না,যা বামাতি অনুবাদকদের নিত্যকর্ম |
অনুবাদ শুরু হলো :
আলোকপ্রাপ্তি হলো মানুষের স্বরচিত অক্ষমতা থেকে মুক্তি | কিসের অক্ষমতা ? অন্যের সাহায্য ছাড়া কোনো কিছু বুঝার অক্ষমতা | এটা তখনি স্বরচিত হয় যখন মানুষ অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছু বুঝতে পারে না এই জন্য নয় যে তার যুক্তি বুদ্ধি নেই , বরং এই জন্য , যে সে নিজের যুক্তি বুদ্ধি ব্যবহার করতে ভয় পায় | “নিজের যুক্তি বুদ্ধি ব্যবহার করার সাহস সঞ্চয় কর” : এটা হওয়া উচিত আলোকপ্রাপ্তির লক্ষ্য |
প্রকৃতি মানুষকে তার বাইরের বন্ধন থেকে মুক্ত করেছে , কিন্তু মানুষ যে নিজের অন্তরের বন্ধনে সারা জীবন বদ্ধ থাকে, তার মূল কারণ হলো আলসেমি আর কাপুরুষতা | এটাই কারণ যে খুব সহজেই অন্যেরা মানুষের মুরুব্বি হয়ে বসতে পারে | বড় না হওয়াটা খুবই সোজা কাজ | যদি আমার একটা বই থাকে যা আমার হয়ে বুঝবে, একজন পুরোহিত থাকে যার কাছে আমার জন্য একটা বিবেক আছে , একজন ডাক্তার আছে যে আমার খাদ্যতালিকা তৈরী করে দেবে, আমার কষ্ট করার কোনো দরকার নেই তো | আমার চিন্তা করার কোনো দরকার নেই যখন আমি পয়সা দেব আর অন্যে আমার হয়ে চিন্তা করার কষ্টসাধ্য কাজটি করে দেবে |
বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করাটা খুবই বিপদজনক ব্যাপার | তাদের মুরুব্বিরা অন্তত তাদের তাই শিখিয়েছে | এইসব সামাজিক মুরুব্বিরা প্রথমে তাদের গৃহপালিত পশুদের বোবা করে | আর দেখে যে এইসব দুর্বল লোকগুলো নিজে থেকে এক পাও অগ্রসর হবার সাহস করবে না | সে সমাজ নামক রথে তারা শিকল দিয়ে বাঁধা , সেটা তাদের যেখানে নিয়ে যাবে তারা সেইখানেই যাবে | এইসব করার পর তাদের মুরুব্বিরা তাদের দেখায় একলা চলার বিপদটা কি | বিপদটা খুব একটা বড় কিছু না | বারকয়েক হোচট খাবার পরে শেষ পর্যন্ত তারা একলা চলতে পারবে | কিন্তু এইসব বিপদের নমুনাগুলোই তাদেরকে ভীষণ ভয় পাইয়ে রাখে |
যে লোকের এই ধরনের অক্ষমতায় থাকা দীর্ঘদিনের অভ্যাস , সে চট করে জীবন সম্বন্ধে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না | সে এইভাবে থেকে অভ্যস্ত এবং সে কখনো নিজের যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করার সুযোগ পায় নি | কেউ তাকে করতে উত্সাহ দেয় নি | আইন আর ফর্মুলা , যা কিনা বৌদ্ধিক তার নিজস্ব ক্ষমতার বৌদ্ধিক সুপ্রয়োগ বা কুপ্রয়োগের উপায় , তা আসলে এই ধরনের অক্ষমতার পক্ষে বিপদ | যারা এই উপায়্গুলোকে ফেলে দেয় , তারা আসলে সংকীর্ণতম এক খালের ওপর অনিশ্চিতভাবে লাফ দেয় কারণ তাদের চিন্তা এখনো ওই ধরনের মুক্ত বেগে চলতে শুরু করেনি | তাই নিজেদের যুক্তিবুদ্ধির চর্চা করে বৌদ্ধিক অক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ভীষণ কম |
এইভাবে আলোকপ্রাপ্তি খুবই সম্ভব | যদি চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া যায় তাহলেই আলোকপ্রাপ্তি স্বাভাবিকভাবেই হবে | চিরকালই কিছু মুক্তচিন্তক ছিল, এমনকি জনগনের নেতাদের মধ্যেও , যারা এই ধরনের বৌদ্ধিক অক্ষমতার জোয়াল ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে নিজের এবং অন্য মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার যুক্তিসম্মতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন | কিন্তু জনতা , সেইসব মুক্তমনা নেতাদেরকেও, যারা তাদের এই বৌদ্ধিক অক্ষমতায় জোর করে এনেছিল , জোরকরে বৌদ্ধিক অক্ষমতার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় | এটা হলো জনতার প্রতিশোধ | সুতরাং জনতা ধীরে ধীরে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারে | একনায়কতান্ত্রিক শোষণ হয়ত বিপ্লবের মাধ্যমে খতম হতে পারে কিন্তু চিন্তার বিপ্লব ঐভাবে হয় না | মাথামোটা, চিন্তাশূন্য জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে পুরনো বিপদের পাশাপাশি নতুন বিপদ হতে পারে |
এই ধরনের আলোক্প্রাপ্তির জন্য যা দরকার তা হলো চিন্তার স্বাধীনতা | চিন্তার স্বাধীনতা একটা অতি নির্বিরোধী জিনিস | এতে বিপদের ভয় বিন্দুমাত্র নেই | এটা হলো জনতার নিজস্ব যুক্তিবুদ্ধিকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা | কিন্তু আমি সর্বত্র শুনতে পাই, সরকারী কর্মচারী বলছে , “তর্ক কর না, কাজ কর |”, কর আদায়কারী বলছে, “তর্ক কোর না, কর দাও |”, পুরোহিত বলছে , “তর্ক কোর না , বিশ্বাস কোর |” শুধু এক রাজকুমার বলেছিলেন “ মেনে নিও না , তর্ক কর |” সব জায়গায় চিন্তার ক্ষেত্রে এই ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় |
মুক্তচিন্তায় বাধা কোথায় আলোকপ্রাপ্তির সহায়ক নয় আর কোথায় সেটা আলোকপ্রাপ্তির সহায়ক ? আমি (কান্ট) এই প্রশ্নের উত্তরে বলি : মানুষের দুই রকম ভাবে যুক্তির ব্যবহার করতে পারে | ১] সার্বজনীন ভাবে আর ২] ব্যক্তিগত ভাবে | সার্বজনীন যুক্তির ব্যবহার মানে লেখক তার পাঠকের উদ্দেশ্যে যে যুক্তি ব্যবহার করে | আর ব্যক্তিগত যুক্তির ব্যবহার হলো কোনো জীবিকার শর্তে তাকে যেভাবে যুক্তির ব্যবহার করতে হয় | উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একজন সামরিক অফিসার তার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না | কিন্তু সামরিক পরিষেবার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে লেখক হিসেবে তার মন্তব্য করার বা আমজনতার উদ্দেশ্যে তুলে ধরার অধিকার আছে | কোনো এক নাগরিক তার উপর নিয়োজিত কর দিতে অস্বীকার করতে পারে না কিন্তু সে লেখক হিসেবে ওই করের যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে জনসমক্ষে নিজের বক্তব্য রাখতে পারে | একইরকম ভাবে একজন যাজক ধর্ম নিয়ে বাণী দিতে পারে , সেই শর্তেই তাকে গ্রহণ করা হয়েছে | কিন্তু লেখক হিসেবে সে জনগনের কাছে ধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে নিজের চিন্তাধারা তুলে ধরতে পারে | এতে তার বিবেকের উপর কোনো বোঝা আসবে না | কারণ সে চার্চের প্রতিনিধি হিসেবে যা শেখায় তা সে নিজের আলোকে স্বাধীনভাবে শেখায় না | সে চার্চের জনসমাবেশে যা বলে তা আসলে অন্যের আদেশ | তার নিজের হাজার সন্দেহ থাকলেও সে তা প্রকাশ করতে পারে না সেখানে, তাহলে তাকে যাজকগিরি ছাড়তে হয় | কিন্তু লেখক হিসেবে বিশ্বের কাছে সে তার নিজস্ব মতামত দিতে পারে | সেখানে তার অবাধ স্বাধীনতা |
আচ্ছা এমন কি কোনো চুক্তি হয় না যা দিয়ে কোনো যাজককে তার কাজের বাইরে ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করা যায় ? আমার (কান্টের) জবাব: এই ধরনের চুক্তি আলোকপ্রাপ্তির সমস্তরকম পথ বন্ধ করে দেয় এবং তাই এটা কোনোভাবেই মানা যায় না | কোনো একটি যুগ কখনই ভবিষ্যতের যুগকে তার ভুলগুলো শুধরানো থেকে আটকাতে পারে না | এটা অমানবিক ব্যাপার | মানবাধিকারের হনন | এই ধরনের কোনো শর্তই মানা উচিত নয় |
জনগনের জন্য কোনো আইন প্রনয়ন করার মূল উপায় হলো এটা দেখা যে জনতা ওই আইনটাকে নিজেদের উপরে প্রয়োগ করছে কিনা | অর্থাৎ জনতা ওই আইনকে মানার যোগ্য বলে বিবেচনা করছে কিনা | এই ধরনের ধর্মীয় বিধান খুবই কম সময়ের জন্য প্রযোজ্য | প্রতিটি নাগরিককে , বিশেষ করে যাজকদেরকে , লেখকের ভূমিকায় রাখা উচিত যাতে করে বর্তমান ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি সে তার লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে জনতার কাছে রাখতে পারে | এই নতুন ব্যবস্থা ততদিনই থাকতে পারে যতদিন পর্যন্ত না এই ত্রুটিগুলির প্রকৃতির ব্যাপারে জনতা সচেতন হচ্ছে | তারপরে জনতা একত্রিত হয়ে এই ব্যবস্থায় তাদের উন্নত চিন্তাধারা দিয়ে পরিবর্তন আনবে | অবশ্য এই পরিবর্তন তাদের কোনো অসুবিধা করবে না যারা পুরনো ব্যবস্থায় থাকতে চায় | কিন্তু এমন কোনো ব্যবস্থা যাতে জনতা কোনদিনও সন্দেহ করবে না, বা যার কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই : এমন ব্যবস্থা সর্বতভাবে পরিত্যাজ্য | একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় আলোকপ্রাপ্তি নাও চাইতে পারে কিন্তু পুরুষানুক্রমে আলোকপ্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানবতার হানি করা | আর যা জনগণ নিজে আইন বলে মানে না , কোনো রাজা তা আইন বলে চালাতে পারে না কারণ রাজার সাফল্য নির্ভর করে প্রজাদের জনমতকে নিজের পক্ষে টানার মধ্য দিয়ে | রাজা যদি দেখে যে এইসব উন্নতি সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখছে , তাহলে সে জনতাকে তার নিজের পথে চলতে দেয় | যদি সে দেখে যে কোনো একজন অন্য একজনের আলোকপ্রাপ্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে , তখন তিনি প্রথমজনকে আটকাবার চেষ্টা করেন | এই ধরনের কাজকর্ম রাজার পক্ষে শোভা দেয় না যখন তার নিজের প্রজাদের লেখার থেকে তিনি তার নিজের প্রশাসনের ভালো মন্দ বিচার করতে পারেন | তিনি এটা তখনি করতে পারেন যখন তিনি ওই লেখা বুঝতে পারেন গভীরভাবে | রাজার মাহাত্ম্য আরো ক্ষুন্ন হয় যখন তিনি তার রাজ্যের কোনো একনায়ককে সমর্থন করেন |
যদি আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয় : “আমরা কি এখন আলোকপ্রাপ্তির যুগে বাস করি ?” উত্তর হবে : “না” | কিন্তু আমরা এখন সত্যিই আলোকপ্রাপ্তির যুগে বাস করছি | মানুষের ধর্মীয় বিষয়ে স্বাধীন মত প্রকাশের পথে বাধা খুব কম | অন্যদিকে, আমাদের পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে আলোকপ্রাপ্তির ক্ষেত্রটি সবেমাত্র উন্মোচিত হয়েছে আর আলোকপ্রাপ্তির পথের বাধাগুলি দূরীভূত হয়েছে | এই অর্থে এটা আলোকপ্রাপ্তির যুগ বা ফ্রেডরিক-এর যুগ |
একজন রাজকুমার যে মানুষকে ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে যুক্তিবুদ্ধির চর্চা করার অধিকার দিয়েছে সে নিজেই একজন আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং জগতের কাছ থেকে সম্মান পাবার যোগ্য ব্যক্তি এই অর্থে যে সে একমাত্র লোক যে মানুষকে তার স্বাধীন যুক্তিবুদ্ধির চর্চা করার অধিকার দিয়েছে ধর্মের বিষয়ে | ওনার আমলে ধর্মীয় ব্যাপারে মানুষরা নিজেদের স্বাধীন মতামত জনগনের কাছে রাখতে পারত, অবশ্যই নিজের জীবিকার (অফিসিয়াল ডিউটি) অবমাননা না করে | এইসব বিচারগুলি অনেক সময়ই প্রতিষ্ঠিত মতের বিরোধীতা করত | যাদের কোনো জীবিকা নাই তাদের এই বিষয়ে স্বাধীনতা আরো বেশি | এই স্বাধীনতার হাওয়া এই দেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশেও চলে গেছে যেখানে একে সরকারী প্রতিরোধের সম্মিখিন হতে হয়েছে |
আমি আলোকপ্রাপ্তির কথাটা মূলত ধর্মীয় ব্যাপারে এইজন্য বললাম কারণ আমাদের নেতারা বিজ্ঞান আর শিল্পকলার বিষয়ে তেমন কিছু খবরদারি করেনা | আর দ্বিতীয়ত ধর্মের ব্যাপারে বুদ্ধির দাসত্ব করাটা অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার | কিন্তু আমাদের রাজার ধর্মীয় আলোকপ্রাপ্তির ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার ব্যাপারটা আরো কিছুটা এগিয়েছে | তিনি তার নিজের আইনকানুনের ব্যাপারেও স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নিজের প্রজাদের দিয়ে রেখেছেন | এর আগে এরকম কোনো রাজা ছিল না |
যে সত্যিকার আলোক পেয়েছে সে ছায়াকে ভয় করে না | তার এক সুগঠিত সেনা আছে যা শান্তি বজায় রাখবে | আর বলবে যা তোমার ইচ্ছা সেই বিষয়ে তর্ক কর আর যা তুমি ইচ্ছা কর তা মান | কিন্তু এক প্রজাতন্ত্র এইরকম করার সাহস পায় না | এখানে মানুষের ব্যবহারের এক অদ্ভুত দিক দেখা যায় যা প্রহেলিকাময় | বেশি নাগরিক স্বাধীনতা চিন্তার স্বাধীনতা এনে দেয় এবং একই সাথে এর কিছু অবশ্যম্ভাবী সীমাবদ্ধতাও আছে | কম নাগরিক স্বাধীনতা অবশ্য প্রতিটি লোকের পূর্ণ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক | যত প্রকৃতি তার শক্ত খোলস থেকে সেই বীজটি বার করে যা সে অতি যত্নে রেখেছে – স্বাধীনতার মাত্রা- এটা মানুষের চরিত্রের উপর ক্রিয়া করতে থাকে এবং শেষে মানুষ স্বাধীনতাকে পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে | অন্তিমে এটা সরকারকে প্রভাবিত করে যে মানুষের জন্য আইন বানায় |
অনুবাদ শেষ |
অনুবাদকের সমালোচনা
সমস্ত বইটা পড়ার পর সমালোচনা করার লোভটা ছাড়তে পারলাম না | অনেক কথা বলবার আছে | আলোকপ্রাপ্তি হলো অন্তরের আলোকপ্রাপ্তি , চিন্তার স্বাধীনতা ইত্যাদি | এটা করতে হবে এমনভাবে যাতে করে নিজের পেশাগত কোনো হানি না হয় | অর্থাৎ ইনফরমাল ভাবে | আজকের যুগে এই ধরনের চিন্তার স্বাধীনতা খুব দরকার কারণ এইযুগে মানুষ পরস্পরকে ঠকাচ্ছে | যে করে হোক স্বাধীনভাবে চিন্তা করলে হয়ত এই প্রতারণার হাত থেকে আমরা কিছুটা বাঁচতে পারব | এইটাই কান্টের আলোকপ্রাপ্তির ব্যবহারিক মূল্য |
কান্ট যেরকম সমাজের কথা কল্পনা করেছেন তা হলো চলমান প্রগতিশীল সমাজ | যে সমাজ প্রতি মুহুর্তে নিজেকে পাল্টাতে , আরো উন্নত করতে প্রয়াসী |কান্টের আমলে রাজা অবধি নিজের আইনের ভালো মন্দ বিচার করে শোধরাতে চান | এই রকম সমাজেই মুক্ত চিন্তার প্রসার সম্ভব | কিন্তু বর্তমানে যে সমাজে আমরা বাস করি তা হলো ঠিক এর বিপরীত | এই সমাজ সর্বদা নিজেকে সঠিক বলে মানে, একটা পাথরের মত স্থিতিশীল, আর যদি কোনো কেউ তার এই স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করে স্বাধীন চিন্তা দিয়ে তাহলে তাকে মারতে কোনো কসুর করে না এই সমাজ | এর বহু উদাহরণ আছে : ভারতে নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশে মুক্তমনা হত্যা, বুদ্ধিজীবী দের ওপর অত্যাচার (মহম্মদের কার্টুন আঁকার জন্য শার্লি এব্দর ওপর হামলা, ডেনিশ কার্টুনিস্টের উপর হামলা, সলমন রুশদির উপর হত্যার ফতোয়া ইত্যাদি) , তাদের বিতারণ (মকবুল ফিদা হুসেনের ভারত থেকে বহিস্কার, গোলাম আলীর গজল পন্ড ইত্যাদি) | এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যায় | সুতরাং এখনকার সমাজে , বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সমাজে মুক্তচিন্তার প্রসার অসম্ভব | কান্ট এই বিষয়ে একমত | তিনি বলেছেন : এক প্রজাতন্ত্র এইরূপ করার সাহস দেখায় না |
এই ধরনের মুক্তচিন্তার প্রসার রাজতন্ত্রেই সম্ভব | যেমনটা হয়েছিল রাজা ফ্রেদ্রিকের আমলে জার্মানিতে | রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে ইংলান্ডে এইরকম মুক্তচিন্তার বাতাবরণ এসেছিল |
সে যাই হোক | সামাজিকভাবে এটা সম্ভব না হলেও ব্যক্তিগতভাবে এটা খুবই সম্ভব | কোনো এক ব্যক্তি সমাজকে তার চিন্তা না জানালেও , সে নিজের চিন্তা অনুযায়ী নিজে কাজ করতে পারে | সমাজ যাকে পুজো করে , যদি কোনো ব্যক্তি তাকে প্রতারক বলে জানে, সে সমাজকে তা না জানিয়ে অন্য কোনো ছুতো দেখিয়ে ওই ব্যক্তির পূজা না করতেই পারে | সমাজ তাতে কিছু বলবে না | এইভাবে বৃহত্স্তরে না হোক ক্ষুদ্রস্তরে এই ধরনের আলোকপ্রাপ্তি খুবই সম্ভব | এই ধরনের আলোকপ্রাপ্তির ফলে মানুষের চিন্তাধারার উন্নতি হবে | তাকে কেউ ঠকাতে পারবে না | সে সত্যকে খুঁজে পাবে |
কান্টের এই আলোকপ্রাপ্তি তার একার আবিষ্কার না | তিনিই দুনিয়ায় প্রথম এর কথা বলেননি | গৌতম বুদ্ধও এই ধরনের আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেছেন | তিনি বলেছেন : আপ্প দীপ ভব | অর্থাৎ নিজেই নিজের দীপ হও | নিজের আলোকে প্রজ্বলিত হও | চানক্যের নীতি শাস্ত্রে তিনি বলেছেন : যার বিচারবুদ্ধি নেই শাস্ত্র তার কি করবে /যার দুচোখ অন্ধ , দর্পণ তার কি করবে | অর্থাৎ নিজস্ব বিচারবুদ্ধি না থাকলে কিছুই হবে না | কনফুসিয়াস এটাকে একটু ঘুরিয়ে বলেছেন : সর্বদা প্রশ্ন কর | অতীতে গ্রীসে সক্রেটিস বলেছিলেন : যে জীবন পরীক্ষা করা গেল না, তা বাঁচার কোনো অর্থ হয় না |
তবে আমাদের যা শিক্ষাব্যবস্থা তাতে এমন আলোকপ্রাপ্তি সম্ভব নয় | এটাতে সর্বদা শেখানো হয় যে শিক্ষককে মান্য কর | নিজের মতামত জাহির কর না (এমনকি মাস্টার্স লেভেলের কথা বলছি )| বইতে যা লিখা আছে তা মুখস্ত কর আর বমি কর | এইসবের বেচাল হলেই শাসন নেমে আসে | সুতরাং আলোকপ্রাপ্তি কি করে আসবে ? দীর্ঘ ১৬-১৭ বছরের এইরকম শিক্ষা (?) সাধারণ মানুষের মাথাটা চিবিয়ে খাবার জন্য যথেষ্ট | পি এইচ ডি স্তরে গবেষনাতে খালি অন্যের বইয়ের থেকে লেখা দিতে হয় , কিন্তু নিজস্ব কোনো কিছু তাতে থাকে না | কোনো বেসিক রিসার্চ হয় না | আমি মাস্টার্স স্তরে যে থিসিস দিয়েছিলাম তাতে দেখেছি যে bibliograph-তে খালি অন্য বইয়ের সুত্র উল্লেখ | অর্থাৎ গবেষনাপত্রটি শুধু অন্যের কাছ থেকে ধার করা বিদ্যের মিউজিয়াম মাত্র | আমার নিজস্ব কোনো কিছু অবদান নেই | যা কিছু মৌলিক আবিস্কার ভারতীয়রা করেছে তার প্রায় সবটাই বিদেশের মাটিতে হয়েছে | স্বদেশের মাটিতে শুধুই বাল ছিড়েছে | বাংলাদেশের কথা বলতে পারব না |
আমাদের সমাজও স্বাধীন চিন্তাকে বাধা দেয় | ফেইসবুক , ব্লগ ইত্যাদি হলো মুক্তচিন্তার প্রসার স্তর | ইদানিং দেখছি ব্লগে লিখলে পুলিস কেস হচ্ছে | আমার ফেইসবুক একাউন্ট বহুবার হ্যাক করা হয়েছে কারণ হ্যাকাররা মুক্তচিন্তায় আমার সাথে পেরে ওঠেনি | নিজের ঢাক পেটাচ্ছি না , তবে কথাটা সত্যি | এইই হলো আমাদের দেশের অবস্থা | ভারতের অবস্থা | যেখানে মুক্তচিন্তার জন্য কালবুর্গী-দাভলকরদের মরতে হয় | ডক্টর সুভাষ মুখার্জির কথা বলি | তিনি এই বঙ্গের লোক | দুনিয়ায় প্রথম টেস্ট টিউব বেবির স্রষ্টা | আজ যদি এই আবিস্কার বিশ্বের দরবারে যেত তাহলে ভারত প্রথম নিজস্ব অবদান রাখত , সুভাষবাবু পেতেন নোবেল পুরস্কার আর ভারতের মুখ উজ্জ্বল হত | কিন্তু এই বঙ্গের স্বার্থপর-পরশ্রীকাতর বামপন্থী সরকার তার আবিস্কার কিছুতেই বিশ্বের দরবারে নিয়ে যেতে দিল না | তাঁকে একটা ভালো গবেষনাগার পর্যন্ত দেয়া হলো না | অপমানে অতিষ্ঠ হয়ে সুভাষবাবু আত্মহত্যা করলেন | মজার কথা এই যে তার তৈরী প্রথম টেস্ট টিউব বেবি দূর্গা আজ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে , তার নিজের সন্তান হয়েছে |
যাই হোক কান্টের বইটা যথার্থ পড়ে ভালো লাগলো | ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম বাঙালি পাঠকদের কথা মাথায় রেখে | ভালো লাগলে বুঝব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে |
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ৯:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






