somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভীনবাসী ডায়েরী ।। দুই ।।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভীনবাসী ডায়েরী ।। এক ।।
ভীনবাসী ডায়েরী ।। দুই ।।

দেশে থাকতে আমি বরাবরই ‘দ্রুত টাইপের’ খাদ্য, মানে ‘ফাস্টফুড’ থেকে যথাসম্ভব গা বাঁচিয়েই চলেছি, যদিও আমার ছোট ভাইটিকে দেখেছি ঐ পদগুলোর কোনো না কোনো একটাকে সবসময় পছন্দের তালিকায় রাখতে,কিন্তু, আমার পছন্দে ও বালাই কখনোই ঢোকেনি। আমি হলাম খাস টাইপের বাঙালঙ! সকালে এক থালা ভাত, দুপুরে আরেক থালা, এবং রাতে, ব্যাস দিনের খায়-খোরাকির সমস্ত ঝঞ্ঝাট মিটে গেল! বাকি থাকে ঘুম,ও মাটি পেলে শোকরিয়া, বিছানা হলে আলহামদুলিল্লাহ। অথচ, শালার প্লেনের পেটে ঢুকে দেখি আমার বাঙালপনা সব মাটিতে ফেলে এসেছি, এখন এই মধ্যগগনে কী উপায়? সেদ্ধ আলুর স্মরণে বরাদ্দ বার্গার শেষ করে সবার অলক্ষ্যে খান তিনেক ঢেকুর তুলে ইচ্ছে হলো আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাতে, কিন্তু, ‘নো স্মোকিং’ লেখাটা পড়তে পারার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। সিগারেট ফুকতে না পেরে চোখ বুজে গান শুনতে থাকলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, হঠাৎ মাথার উপরে এ্যালার্মসহ লালবাতির জ্বলে ওঠা ও প্লেন জুড়ে হট্টগোলের শব্দে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম! কী হচ্ছিল বা ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারিনি প্রথমে। তবে মিথ্যা বলব না, ভয় আমি পাইনি, তবে যাই ঘটুক না কেন, দুবাই না গিয়ে মাঝপথে এভাবে মরব, এমন ভাবনার উদ্রেক সহ্য হয়নি একদম, এবং ঠিক কতটা উপরে আছি,কিংবা ভিন্ন কোনো উপায় আছে কিনা বাঁচার, সেটা দেখার জন্য পাশের জনকে ঠেলে জানালার দিকে মাথা না গলিয়েও থাকতে পারিনি, আর শেষ পর্যন্ত কোনো অলটারনেটিভ না পেয়ে একটা আফসোসের দীর্ঘশ্বাস কাতর প্রার্থনার সাথে সাথে সময় নিয়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে এ্যালার্ম বন্ধ হয়ে গেল, এবং তড়িৎ হালকা বৃত্তান্তে জানা গেল, এক বেকুব টয়লেটে গিয়ে নাকি বিড়ি ফুকেছে, সিগারেটও হতে পারে, তবে আমি বিড়িই শুনলাম।

যদিও বিড়ি আর সিগারেটের পার্থক্য নিয়ে একটা ঘটনা আমার এখনও মনে আছে। ঘটনাটা আমার মামাতো ভাইয়ের এক বন্ধুর। ক্লাস টেনের টেস্ট, মামাতো ভাইয়ের সেই বন্ধু পরীক্ষা দেবার মাঝেই সিগারেটের নেশা উঠলে পেচ্ছাব করতে যাবার নাম করে টয়লেটে গিয়ে বিন্দাস সিগারেট ফুকতে থাকলে কোনো এক হাবাগোবা ও অতিশয় সৎ টাইপের সহাপাঠী তা দেখে ফেলে, এবং ফিরে এসে হলভর্তি ছাত্র-ছাত্রীর সামনেই স্যারকে নালিশ জানায়, ‘স্যার অমুকে টয়লেটে গিয়ে বিড়ি ফুকছে’! শুনে লেখা ফেলে সবাই হা করে বসে আছে, কী ঘটে! যথারীতি মামাতো ভাইয়ের সেই বন্ধুটি টয়লেট থেকে ফিরে হলে ঢুকতেই স্যারের তলব, ‘এদিকে আয়, কী করছিলি টয়লেটে’? প্রশ্ন হয়ত শ্রোতার কানে আসতে দেরি করলেও করতে পারে, কিন্তু, উত্তরদাতা কিছুমাত্র দেরি না করে, ‘কী করব স্যার, মুতছিলাম’! সমার্থক শব্দের প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি, তা এমন সব পরিস্থিতিতে বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়। স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রাগত স্বরে ছাত্রের কান ধরে, ‘মুতছিলি হারামজাদা, না টয়লেটে গিয়ে বিড়ি ফুকছিলি’? হ্যাঁ, প্রতিটি স্কুল-কলেজে এমন একজন অবশ্যই থাকে, যে কাউকেই ভয় পায় না, বরং বাকিরাই তাকে পায়। কানটানা অবস্থাতেই স্যারের কথা শোনামাত্র, কোনোরূপ জড়তা ছাড়াই বেশ জোরে খিস্তি করে বলে উঠল, ‘কোন খানকীর পোলায় বলছে আমি বিড়ি ফুকছিলাম? গোল্ডলিফ খাচ্ছিলাম স্যার, দু’টাকা দামের গোল্ডলিফ’!

তাই বিড়ি না সিগারেট সেই সিদ্ধান্তে না গিয়ে চুপ মেরে থাকলাম,কিন্তু, মেজাজটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল, এবং রাগে গা রিরি করতে থাকলে মনে হল, উঠে গিয়ে শালাকে জুতা পেটা করে আসি, চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে আসি, ‘বোকাচোদা, সবুজ পাসপোর্ট বয়ে বেড়াচ্ছ বলেই কি তোমাকে যেখানে-যেখানে তা জানান দিতে হবে? বানচোত, তোমার বাপ-দাদারা না হয় হাজারবার দুবাই গেছে,তাই বলে আমি তো আর যাইনি! যদি প্লেনের কিছু একটা হয়ে যেত? মশকরা মারার আর জায়গা পাওনা হারামজাদা কোথাকার,ক’ঘন্টাও তর সয় না’! এতসব মনে মনে বলে বলে যেই শান্ত হয়েছি, দেখি আমার সিগারেটের নেশা উবে গেছে, এবং নিজের বুক পকেটের সবুজ পাসপোর্টটার দিকে চোখ পড়তেই সেটা লুকিয়ে ভেতরের পকেটে রাখলাম, এবং তাকালাম মাওলা ভাইয়ের মুখের দিকে।

যা যা দেয়া হয়েছিল তার সবগুলোই খেয়েছে, খেয়ে নিশ্চিত মনে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতসব ঘটনা তার ঘুমের বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটায়নি। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্য কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় পাসপোর্টটা ভেতরের পকেট থেকে বের করে পুনরায় সামনের পকেটে রাখলাম, এবং কিছুক্ষণ ধুম মেরে বসে থাকার পর যে লোকটাকে অত গালাগালি করলাম তাকেই মনে মনে বললাম, ‘যা বাপধন আরও কয়েকটা ফুকে আয়, প্লেন ওদের হয়েছে তো কী হয়েছে, শালার আমরা কি আর মাঙনা চড়েছি? পাই টু পাই শোধ করে চড়েছি, মাঙনা তো আর নিয়ে যাচ্ছে না। বানচোতেরা আমাদের জন্য স্মোকিং জোন রাখেনি তো আমরা কী করব? আমাদের যেখানে খুশি ফুকব, যখন খুশি ফুকব, তাতে যদি সবুজ পাসপোর্ট আরও সবুজ হয়ে যায় যাক, মাথা তো আর বেঁচে দিইনি হারামিদের কাছে! যা বাবা, আরও দু’চারখান ফুকে আয়, এই দেখ আমিও আমার সবুজ পাসপোর্টটা বের করে সামনের পকেটে রেখেছি’!

সাড়ে চারঘন্টা গালফ এয়ার আমাদের পেটের ভেতরে নিয়ে উড়াউড়ি করে যখন বাহরাইন এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিল তখন স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৫মিনিট। প্লেন থেকে নেমে মাওলা ভাই একটা হাম ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, হয়ত কোনো প্রশ্ন করতে চায়, অথচ উনাকে সেটা করতে না দিয়ে আমি কানেক্টিং ফ্লাইটের খোঁজ নিতে বাহরাইন এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি জোনের সামনে এসে দাঁড়াতেই দুটো ব্যাপার ঘটল। এক. মাওলা ভাই পেছন পেছন এসে আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘ভাই হেরা তো ব্যাগ-বুগ ঘুরা-টুরা দিলো না, হারা-টারা গেলে’; দুই. মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটা দেশের মাটিতে পা রাখার পর প্রথম বোধোদয় হলো, এরা ‘ইলেকট্রনিক্স লাভার’। দু’টো ব্যাপারের প্রথমটা কখনও আমার সাথে ঘটে না থাকলেও, দ্বিতীয়টার প্রমাণ পরবর্তীতে আমি হরহামেশাই পেয়েছি, এবং নিশ্চিত হয়েছি যে, কোনো কারণে মধ্যেপ্রাচ্যের সবগুলো ইলেকট্রনিক্স পণ্য যদি একসাথে নিদানপক্ষে তিনদিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, তবে নির্ঘাৎ এই আরব জাতীরা পাগল হয়ে যাবে, এবং পুরো সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়বে।

মনে মনে বললাম,‘তারচেয়ে আমার বাংলাদ্যাশ-ই ভাল, কাঠের লাঙল আর গরু, কলম ও দিস্তা দিস্তা খাতা, তিনদিন ক্যান, তিনমাস ফ্যালা রাখলেও কিচ্ছু হবে না, তাই না মাওলা ভাই?’ না, মাওলা ভাইকে আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করিনি, বরং মনে মনে মাওলা ভাইকে অতসব বলতে গিয়ে, আচমকা নিজের অজান্তেই মাওলা ভাইয়ের কিছুক্ষণ আগে জিজ্ঞেস করা কথাগুলো মনে পড়ে গেল, এবং সত্যি সত্যিই উনার মতো আমারও মনে হল, ‘যদি হারা-টারা যায়, ঘুরা-টুরাতো সত্যিই দিল না!’ বেশি কিছু নেই যদিও, কিন্তু, মায়ের দেয়া মুড়ি ক’টা, মাওলা ভাইয়ের ছাতু আর চিড়ার-ই বা কী হবে? কোন জাহান্নামে যাচ্ছি তার কী ঠিক-ঠিকানা আছে! আর কবেই বা ফিরব দেশে, নাকি অদৌ ফিরব না! আহা, কষ্টে বুকটা ফাটব কী ফাটব না করতেই মনে হল, কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হবে। যদিও মাওলা ভাইয়ের ত্রিশ ডলার কিংবা খাবারের বিল আমিই দেব বলে আশ্বস্ত করেছিলাম,কিন্তু, এই বিদেশ বিভূইয়ে যদি সত্যিই শালার প্লেন রেখে চলে যায়, তখন ভিক্ষা করে টিকিট কেটে দেশে ফেরা ছাড়া উপায় নাই। রাগ হল নিজের উপর কোনো কারণ ছাড়াই, এবং মাওলা ভাইকে জোরে পা চালাতে বলে নিজে একটু স্পীড বাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে পেছন ফিরে দেখি মাওলা ভাই নাই!

ক্রমশঃ.....

অরণ্য
দুবাই, মধ্যপ্রাচ্য

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×