খুব সহজে কোন কিছু আপন করে নিতে না পারাটা আমার এক বিশেষ সমস্যা।আসলে মনে মনে আপন করেই নেই, কিন্তু ভণিতা করে সেটা প্রকাশ করতেই সমস্যা হয়। এটা আমার এক প্রকার কমিউনিকেশন প্রবলেম বললেও বলা যেতে পারে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িকে নিজের বাড়ি বলতে আমার প্রায় দশ বছর লেগে গিয়েছিলো। এ নিয়ে আমার শাশুড়ির মেলা অভিযোগ ছিলো।আমি যখনই বাবার বাড়িকে ' আমাদের বাড়ি' বলতাম তখন খুব রাগ করতেন তিনি।কারণ, তার মতে বাবার বাড়ি আর আমার বাড়ি নয়।কিন্তু এই শ্বশুর বাড়ি যখন হঠাৎ করে আমার বাড়ি হয়ে গেছে, তখন এ বাড়িকে 'আমাদের বাড়ি' বলা আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিল । এখন অবশ্য দিব্যি পারি।কিন্তু এই পঁচিশ বছরে ধীরে ধীরে আমি যখন এ বাড়িকে নিজের আপন করে নিয়েছি, তখন এ বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ ।যদিও এটা নতুন কিছু নয়। পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে আজ নিয়ে দশ বারেরও বেশী আমি বাড়ি থেকে চলে যেতে চেয়েও যেতে পারিনি। যখনই মেয়ের মুখের দিকে তাকাতাম, মনে হতো,আমার এই পদক্ষেপ ওর জীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেবে। আমার সন্তান আমার কারণে অনিশ্চিত দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বাঁচবে, তা আমি কখনোই চাই না।তাই দায়িত্ব শেষ না করে এরকম কিছু মনেই আনবো না বলে ঠিক করেছিলাম।
আজ পঁচিশ বছর পর এসেছে সেই দিন; আজ সব দায়িত্ব শেষ করে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না আজ । চয়ন যতই মায়া জাল বিছাক আমি কিছুতেই আর থাকছি না এ বাড়িতে।
বিয়ের পঁচিশ বছরে আমার তেইশ বছরের একটি কন্যা রয়েছে। সে ছয় মাস হচ্ছে উচ্চ শিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছে। বাড়িতে শুধু আমরা দুজন ।শাশুড়ি গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হবে। আর শ্বশুরকে আমি কোনদিনও দেখিনি। হয়তো এরকম একটি দিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি । কোন প্রকার পিছুটান থাকবে না। নির্দ্বিধায় সব মায়াজালের বন্ধন উপড়ে ফেলে চলে যেতে পারবো।
এ বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ পাথর জানে আমার সুখ দুঃখের কথা।জানে আমার গভীর নিঃসঙ্গ সময়গুলোর কথা। জীবনের এই চুয়াল্লিশ বছরের বেশিভাগ সময়ই আমি এ বাড়িতে কাটিয়েছি। এ বাড়ি যখন তিল তিল করে আমার নিজের হয়ে উঠেছে তখন আমি চলে যাচ্ছি চিরতরে । আমার একটুও খারাপ লাগছে না।যদিও মনটা কেমন যেন এক অজানা আশংকায় কিছুটা শঙ্কিত।কিন্তু সেই শঙ্কাও আজ বেশ দুর্বল আমার দৃঢ়তার কাছে।
ছাব্বিশ বছর পর রণের সাথে আজ দেখা হবে । সেই অনেক আগের কথা। কৈশোরে পা দিয়েই একই পাড়ার ছেলে রণের সাথে আমার সম্পর্ক হয়। হয়তো বুঝে না বুঝেই। চার বছরের সম্পর্কের ফলাফল শূন্য।অর্থাৎ সম্পর্কের হিসেব শূন্য রেখে রণ চলে যায় অ্যামেরিকা। কিন্তু এক বছর পরই শূন্য স্থান পূরণ হয়ে যায় চয়নের সাথে আমার বিয়ের মাধ্যমে। রণ আর আমার সম্পর্কের কথা জেনেও চয়ন আমাকে বিয়ে করেছে। আমাকে অনেক ভালোবাসে চয়ন। বিয়ের এক বছরের মাথায়ই ওর ভালোবাসা সম্পূর্ণরূপে মুছে দিয়েছিলো রণের স্মৃতি। রণের দেয়া সব চিঠিগুলো একদিন ছাদে বসে জ্বালিয়ে দিলাম। তারপর ছোট একটি কাঁচের বোতলে ছাই গুলো ভরে রেখে দিলাম যত্ন করে। ভালোবাসা কাঁচের বোতলে ছাই হয়ে বন্ধী রইল। ভুলে গেলাম সব।
বিয়ের দু'বছর পরেই আমার মেয়ে অর্নি এলো আমার কোল জুড়ে। তখন, অর্নি আমার বর্তমান ভবিষ্যৎ এমনকি অতীতের ভাবনা জুড়ে আমাকে অসীম এক আনন্দ ঘূর্ণিপাকে সচল করে রাখে প্রতিনিয়ত। অর্নির ছোট ছোট হাত পা আর ফোঁকলা হাসি আমাকে প্রাণশক্তি দিতো। আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম অর্নিকে নিয়ে আর অর্নির বাবা ব্যস্ত হয়ে গেলো ওর ট্রাভেল এজেন্টের ব্যবসা নিয়ে।
ধীরে ধীরে মেয়ে বড় হতে থাকে, আর আমার ব্যস্ততা কমতে থাকে। ওদিকে চয়নের ব্যবসা বাড়তে থাকে, ব্যস্ততার পরিমাণ হয়ে যায় দ্বিগুণ।ওর ব্যবহারেও বাড়তে থাকে কেমন যেন এক আগুন আগুন ভাব। ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে চয়ন। অকারণেই ক্ষিপ্র হয়ে উন্মাদের মত তেড়ে আসে আমার দিকে। আমার গায়ে হাত তোলেনি কখনোই কিন্তু মারতে না পেরে সেলফ হার্ম করে দেয়ালে মাথা টাকিয়ে । কোন কথাই বলা যায় না ওর সাথে। এ কারনেই কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পালাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার শাশুড়ি আর মেয়ের জন্য পারিনি। তাছাড়া, আমি বাড়ি ছাড়ার কথা তুললেই চয়নের ভিন্ন রূপ দেখতে পেতাম। ও সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে আমাকে আটকে রাখার প্রাণ পণ চেষ্টা করতো। ওর ঐ মায়াজালে আমি বারবারই আটকে যেতাম।কিন্তু ও কেন জানি ওর উদ্ধত রাগ দমন করতে পারতো না কিছুতেই। হয়তো ব্যস্ততা আর স্ট্রেস থেকে এমনটা হতো। এই ভেবেই প্রতিবারই মেনে নিতাম সবকিছু।
একটা সময় ওর ব্যস্ত জীবন নিয়ে ওকে ওর মত থাকতে দিলাম , আর আমি আমার মত নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। কিন্তু কোন শূন্যতাই শূন্য থাকে না সারা জীবন । সেখানে কেউ না কেউ এসে জায়গা করেই নেয় । এখানে ব্যক্তির হয়তো কোন হাতই থাকে না। এভাবেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হঠাৎ রণ আবার এলো আমার জীবনে। দুই বছর আগে রণ আমাকে ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপর সে আমাকে মেসেঞ্জারে মেসেস পাঠালো। কিছু দিন ওর সে মেসেস দেখেও উত্তর দেইনি। কেমন যেন একটি রাগ আর ঘৃণা মিশ্রিত অভিমানে মনের ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠত। তখন বুঝলাম ওর প্রতি আমার ভালোবাসা পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের মত কাঁচের শিশিতে বন্দী হয়ে আছে।সেটা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি। ভস্ম হয়েও আছে কোথাও না কোথাও। হয়তো বেরিয়ে পরতে চাইছে, হয়তো আবার কোন একটি স্বতন্ত্র রূপ নিতে চাইছে।হয়তো তার ধূসর কালো বর্ণে আমাকে কলঙ্কিত করতে চাইছে। আসলে প্রেম হলো এক আশ্চর্য ব্ল্যাক হোল যেখানে কালোর গোলক ধাঁধায় জর্জরিত হয় মন।তার মহাকাল ঘূর্ণিপাকে সমস্ত সময় থমকে যায় । কোন বিচার বুদ্ধি হয়তো সেখানে কাজ করে না। আমারও তাই হলো, স্থান, কাল, পাত্র, বিচার, বুদ্ধি এমনকি সময় সেই ব্ল্যাক হোলে আটকে রইলো।
সপ্তাহে দু চারদিন ওর সাথে মেসেঞ্জারে কথা হয়। মাঝে মাঝে ফোন কলেও কথা হয় ও ফ্রি থাকলে । ওর সাথে কথা বলার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে থাকি,কারণ আমার হাতে অফুরন্ত সময়, যদিও ওর হাতে বেশী সময় থাকতো না। অনেক বেশী ব্যস্ত সে। তারপরও যতটুকু সময় ও আমাকে দেয় , সেটাতেই আমার মন কানায় কানায় ভড়ে যায়। জানি না ওর ও আমার মত হয় কিনা। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।এভাবে সকল শূন্যতা পূরণ হয়ে সেখানে ওর প্রতি ভালোবাসার বীজ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। চয়ন এসবের কিছুই জানে না। মনের ভেতর রণের উপস্থিতি আমার নিঃসঙ্গ নীরব জীবনে নানা রঙের ফুলে ফলে বর্ণিল হয়ে ওঠে । আমরা কেউই এই দু বছরে একে অপরের কাছে জানতেও চাইনি যে আমরা এখনও একে অপরকে সেই আগের মতই ভালোবাসি কিনা। আর এটা জানতে চাওয়ারই বা কি আছে। শুরু যেহেতু ভালোবাসা দিয়ে, সে তো আছেই। সেটা নতুন করে জানতে চাওয়ারই বা কী আছে। তাছাড়া , আমার প্রতি ওর এতোটা কেয়ারিং ভাব রয়েছে যে সেখানে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিবা থাকতে পারে।
আর ওদিকে চয়নের সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে ওর ছায়াও আমার মনের মাঝে বিচরণ করে না । কিন্তু এই দূরত্বও চয়নকে দারুন ভাবে পীড়া দিতে থাকে, ও আরও বেশী ফুঁসে ওঠে, উদ্ধত হয়ে প্রায়ই চেঁচামেচি চিৎকার করে। এতো দিনে আমি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ওর এ জাতীয় দর্পিত আর প্রলয়ংকারি চিৎকারে। কিন্তু কদিন থেকে মনটা কেন জানি ছুটে গেছে, মন কিছুতেই আর বস মানতে চাইছে না। হয়তো রণ এতো দিন পরে দেশে আসছে বলে।
আজ সকালে চয়ন কাজে চলে যাওয়ার পরই ওকে একটি চিঠি লিখলাম কাগজে, তারপর সেটা বেডসাইট টেবিলে রেখে বেরিয়ে পরলাম। প্রথমে বাবার বাড়িতে ব্যাগ রেখে দুপুরে বাইরে রণের সাথে দেখা করার কথা।রণর বাবা মা রণ চলে যাবার পর পরই উত্তরা চলে গিয়েছে । আর আমরা মণিপুরি পাড়াতেই থেকে গিয়েছি।
সেই বহু আগে, আমি আর রণ লুকিয়ে ছুপিয়ে দেখা করতাম মহম্মদপুর আড়ং এর ক্যাফেতে। আমার ইচ্ছাতেই আজ আমরা ওখানেই দেখা করবো বলে ঠিক করলাম।
ব্যাগ নিয়ে আমার আগমনে মায়ের মনে নানা রকম প্রশ্ন। যদিও ব্যাগ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই আসা হয় এ বাড়িতে ।মাকে বললাম আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে, পরে তোমাকে সব খুলে বলছি।মায়েরও সেরকম এনার্জি আর নেই অত সব উল্টো পাল্টা চিন্তা করার।তাই অল্পতেই ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
তারপর রেডি হতে শুরু করলাম। আয়নাতে চোখ পড়তেই ভাবছি , রণ আমাকে আঠারো বৎসর বয়সে দেখে গিয়েছিলো। আজ এই চুয়াল্লিশ বৎসরের তনিমাকে ও কী চিনতে পারবে? অবশ্য ফেসবুকে তো দেখেছেই, সমস্যা তো হবার কথা নয়। ফেসবুকে রণের সাদা চামড়ার বউয়ের ছবি একটাই আছে। ও খুব একটা ছবি দেয় না। হয়তো বউয়ের সাথে সেরকম ভালো সম্পর্ক নেই। ওদের কোন সন্তানও নেই। রণও আমার মত একা।আমরা দুজন দু প্রান্তের একাকী মানুষ দুটি বেশ অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু হয়ে উঠেছি কয়েক দিনেই । ও কখনোই ওর বউয়ের কথা তোলে না, আমিও চয়নের ব্যপারে কিছুই বলিনি কখনো।
আমি সময়ের বেশ আগেই এসে ক্যাফেতে বসে আছি। বহু বছর পরে এলাম এখানে। রণ চলে যাবার পড় হয়তো এক দুবার এসেছি এখানে। এখন আর সেই আগের মত পরিবেশ নেই। তারপরও এই জায়গাটিই আমার খুব পছন্দের। জানালার পাশে বসে নীচের রাস্তা দেখছিলাম, এমন সময় নিজের নামটি শুনে ঘুরে তাকাতেই রণর হাসি মাখা মুখটি দেখতে পেলাম। বয়স বাড়লেও এখনো দারুন ভাবে আকর্ষণীয় ওর চোখের চাহনি, হাঁটার ভঙ্গি এবং কথা বলার ধরন। রণ পাশের চেয়ারটি টান দিয়ে বসলো। আমার হাত পা কাঁপছে। ভালোবাসা, অভিমান, আর ফিরে পাওয়ার একটি মিশ্র অনুভূতিতে আমার হৃদপিণ্ড ভারি হয়ে আছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কোন জায়গা থেকে শুরু করবো। রণ কথা বলেই যাচ্ছে আর আমি শুধু হ্যাঁ না উত্তর করছি।ভেবেছিলাম ওর চোখে চোখ রেখে ওর হৃদয়ে আমার জন্য কতটুকু জায়গা রয়েছে সেটা মেপে দেখার চেষ্টা করবো। কিন্তু কেন জানি চোখের দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। হঠাৎ একজন সাদা চামড়ার মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আধো বাংলাতে বলছে, " তুমিই তনিমা! অনেক শুনেছি তোমার কথা।" আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম রণর দিকে। এখন ঠিক ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি, একটুও কষ্ট হচ্ছে না। সেখানে দেখলাম আমি ওর হৃদয়ের গভীরে কোথাও নেই। আমি ওর কাছে দূরবর্তী কোন বন্ধু হিসেবেই আছি, যার স্থান হৃদয়ের কাছা কাছি কোথাও না।
রণের অ্যামেরিকান বউ সব জানে আমাদের ব্যপারে। এমনকি আজ আমরা দেখা করতে আসবো সেটাও জানে। ওরা একসাথেই এসেছে আড়ং এ শপিং করতে। রণ নাকি আমাকে সারপ্রাইস দিতে চেয়েছে একটু নাটকীয় ভাবে। ওর সব কিছুতেই নাটক, যেটা আমার একদমই পছন্দ নয়।তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, আমি যে মনে মনে ভালোবাসার ঘর তৈরি করেছি রণকে ঘিরে সেখানে সে বাস করে না। ওখানে শুধু আমি একাই বসবাস করি।চোখ ফেটে কান্না আসছে, অতি কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করেছি। রণকে কিছুতেই বুঝতে দেইনি আমার মনের অবস্থা। বেশ অনেকক্ষণ গল্প করে মস্ত বড় একটি শূন্যতা নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়।এসেই মার বাড়িতে আমার যে আলমারি রয়েছে সেটা থেকে কাঁচের বোতলটি বের করে, সব গুলো পুড়ে যাওয়া ভালোবাসা উড়িয়ে দিলাম ছাদে গিয়ে।
এখন আর মনের ভেতর কেন জানি কোন প্রকার ঘৃণাও নেই রণর প্রতি, বেশ হালকা লাগছে । আসলে ওর তো কোন দোষ নেই। ও তো আমাকে এ দু বছরে কখনোই বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে। আমাদের সেই বাল্য প্রেম তো সেই কবেই মিটে গিয়েছে। আমিই অকারণে এতো কিছু ভেবে রেখেছি। দোষটা আমারই ছিলো।অতি মাত্রায় কল্পনা প্রবণতা আমার আরও একটি বড় সমস্যা।
রাত দশটায় হঠাৎ চয়নের ছোট বোন এলিনার ফোন বেজে উঠলো । আমি না ধরাতে মার কাছে ফোন দিয়েছে। মা বিস্মিত চোখে মুখে আমাকে ফোন দিয়ে বলছে,
- জামাই নাকি হসপিটালে!
মনে মনে ভাবছি, নির্ঘাত আরেকটি মায়াজাল বিছানোর ফন্ধি।
ফোনের ওপাশ থেকে এলিনা বলছে,
- ভাবী তুমি জলদি হসপিটালে আসো, ভাইয়া হসপিটালে।
হসপিটালে গিয়ে জানলাম, চয়ন এক মাস হয় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে। চয়ন বর্ডার লাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে। এজন্যই ওর মেজাজ খিট খিট হয়ে থাকে আর রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। পাশা পাশি প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় অর্থাৎ এংজাইটি ডিসঅর্ডারও রয়েছে। সব মিলিয়ে ও মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। একারনেই মানসিক যন্ত্রণা কমাতে সে নিজের ক্ষতি করে অর্থাৎ সেলফ হার্ম করে।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যখন আমার চিঠি পায় তখন ও অনেক জোরে দেয়ালের সাথে মাথা হিট করে। যার ফলে প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয় এবং ও বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে। এলিনা বাসায় এসে ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়। এলিনা ওর মানসিক রোগ সম্পর্কে জানতো। আমাকে জানায়নি, কারণ ওরা ভেবেছিলো আমি হয়তো মানতে পারবো না। ডাক্তার বলেছে এরকম রোগীরা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, থেরাপি নিলে এবং প্রিয়জনের সহযোগিতা পেলে।
আমি সারা রাত ওর পাশে বসে বসে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টেরই পাইনি। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে আমার মুখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চয়ন তখনো ঘুমাচ্ছে হসপিটালের বেডে।ওকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ওর মুখের দিকে অনেক দিন ঠিক মত তাকিয়ে দেখিনি। আজ কেন যে এতো মায়া লাগছে ওর মুখটি দেখে। মনে মনে ভাবছি, কেন যে আমি এতো ভুল করি! চয়নকে কোন দিন বলিনি, ভালোবাসি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,
- ভালোভাসি ভালোবাসি!
ছবিঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩৫