somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাত্রী দেখা

২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাত্রী দেখা
১।
ঢাকায় এসেছি পাত্রী দেখতে। ভাবী হুলিয়া জারি করে দিয়েছে, ঢাকা থেকে যেন বউ ছাড়া না যাই। খালি হাতে গেলে সাদা চামড়ার যে কোন মেয়েকে গলায় গছিয়ে দেবে। ব্যাপারটা আমার জন্য ভয়ানক। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় আগাগোড়া সাদা কাওকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা আর কাফন পরা লাশ দেখা একই কথা। তাছাড়া যে মেয়ে রবীন্দ্রনাথ বোঝেনা, সুকান্ত, বোঝেনা, বনলতা বোঝেনা, ‘আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ’ বোঝেনা তার সাথে বাকি জীবন? ওহ নো! আল্লাহ মাফ করো।
বিগত একমাস নীলাঞ্জনা নামের একটা মেয়ের সাথে ঘুরলাম। পেশায় আর জে। রেডিও জকি। নীলাঞ্জনা তার আসল নাম না। রেডিও নাম। সুন্দর একটা নাম আছে। তবে কম অত্যাধুনিক হওয়ায় নামটা সে প্রকাশ করতে চায়না। আমিও চাইলাম না।
নীলার সাথে মিশছি প্রায় একমাস। অন এয়ারে থাকা কালীন প্রচুর কথা বলে। দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি, প্রানবন্ত। অফিস থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ পালটে যায় মেয়েটা। চুপচাপ। বুদ্ধিও রেখে আসে রেডিও ষ্টেশনে। সৌন্দর্য, সমাজ সচেতনতায় দশে দশ। সমস্যা হল মেয়েটা ঘুরে ফিরে অ্যামেরিকায় কেমন আছি, বাড়িটা কেনা না ভাড়া এসব নিয়েই বেশি প্রশ্ন করছে। একবারও মা-বাবা বা আমার গ্রাম সম্বন্ধে প্রশ্ন করেনাই।
ফার্ম গেইট সেজান পয়েন্টের সামনে রাতে ভাত বিক্রি করে মতিন চাচা। মাঝে মাঝেই সেখানে ডিনার করি। পঁয়ত্রিশ টাকায় ভাত মাছ। নীলাকে নিয়ে একদিন ডিনার করতে গেলাম। এখানে খাবো শুনে এমন একটা ভাব করলো যেন মস্ত বড় পাগলামি করে ফেলেছি। ভাবটা লুকাতেও বেশি সময় লাগেনাই তার। আমার সাথে সিঁড়িতে বসে খেয়েছে তবে বাকি সময় আর কথা বলেনাই। বাসায় ফিরে গলায় হাত ঢুকিয়ে বমিও করেছে বোধহয়।
আমার প্রতি যথেষ্ট ভালোবাসা তৈরি করে ফেলেছে নীলা। এটাই একটা প্রবলেম। এত সহজে গভির ভালোবাসা তৈরি হওয়া সম্ভব?
গুনাগুণ (পজেটিভ-)
*মেয়েটা বাসায় কথা কম বলে। ‘ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান’ লাগার সম্ভাবনা কম।
*বর্তমানে কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।
*পড়তে পছন্দ করে।
*মেয়েটা সুন্দরী।
গুনাগুণ (নেগেটিভ-)
*মেয়েটা লোভী।
*তার মনে গভির কোন দুঃখ আছে। চোখ মুখে কারো রেখে যাওয়া স্মৃতি হেটে বেড়ায়।
*পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনা।
*ভালো অভিনয় করে, অভিব্যাক্তি লুকানোর প্রবনতা লক্ষণীয়।
*প্রয়োজন মনে করেনা এমন তথ্য মনে রাখেনা, আমার চশমা খুঁজে দিতে পারবে না কোনদিনই।
*মিথ্যে বলে, আমার সামনে বাবাকে বলেছে ‘আমি অফিসে’, তখন আমরা সিনেপ্লেক্সে ছিলাম।
সিধান্ত-
যেহেতু মেয়েটা চার পাঁচদিনেই আমার প্রতি গভির মমতা প্রকাশ করেছে, এই মমতা কাটতেও চার পাঁচদিনের বেশি লাগবেনা। নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবনতা আছে এবং বাসায় মাঝে মাঝে চিল্লাচেঁচামেচি করে। সামাজিক কোন কাজের সাথে জড়িত নয় অথচ তার মত একজন সেলেব্রেটি আরজে ইচ্ছে করলেই দুইশ মানুষের শীতের কাপড় যোগাড় করে ফেলতে পারে।
মবিন নামে ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল, এবং সম্পর্কটা অনেক গভীর ছিল, পুরা ব্যাপারটা লুকিয়েছে।
গুড বাই আরজে নীলাঞ্জনা।
পুঃ-১, ভাবী মেয়ের নাম ঠিকানা সহ একটা ছবি মেইল পাঠিয়েছে। হলুদ সর্ষে ক্ষেতে কালো শাড়ি পরা একটা মেয়ে। নাম রেশমি।
পুঃ-২, এবার বিয়ে করেই যাবো এবং বাংলাদেশী কোন মেয়েকেই।
এখন তোর কি হবেরে রেশমি...???

২।
রেশমি মেয়েটাকে পড়তে আমার বেশীদিন লাগেনি। জানিনা এটা রেশমির ব্যার্থতা না আমার সফলতা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালইয়ে পড়ে। থার্ড ইয়ার। থাকে ঢাকা থেকে একশো তেষট্টি কিলো দূরে এক জেলা শহরে। লম্বা, চিকন, সরু নাকের সাথে যোগ হয়েছে টানা টানা দুটি চোখ। লম্বা মেয়েদের মুখ শালুক পাতার মত লম্বা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্রী লাগে। এই মেয়ের মুখ গোলাকার। প্রতিমার মত দেখতে। জন্মের সময় নাকি অন্ধকার ঘরে শুইয়ে রাখলেও ওকে আলাদা ভাবে চেনা যেত। দীপ্তিময় ফর্সা চেহারা ‘রেশমি’ নাম হওয়ার অন্যতম কারন।
কয়েকদিনে মেয়েটা প্রচুর কথা বলেছে। বেশির ভাগ তার রুপ নিয়ে। ক্লাসের কোন স্যার তাকে কি নামে ডাকে, কোন স্যার পরীক্ষার হলে পাশে এসে দাঁড়ালে বাকি তিন ঘনটা স্ট্যাচুর মত দাড়িয়েই থাকে, কোন ছেলেরা তাকে নিয়ে ঝগড়া মারামারি করে, হাইস্কুলে গণিত স্যার খাতা এগিয়ে দেওয়ার ছুতোয় হাত ধরেছিলো বলে তার চাকরীই চলে যায়, এই সব।
আরজে নীলা এক মাসে অন এয়ারে যত কথা না বলে রেশমি একদিনেই তারচে বেশি কথা বলে।
প্রেম করেনাই, এত এত ছেলে তার পিছে ঘোরে যে কোনটা বেটার বুঝতেই পারেনা। বাবা বলেছে কোন রিলেশনে না জড়ালে ভালো ঘরে বিয়ে দেবে। বাবার একান্ত অনুগত মেয়ে। বিভিন্ন সময়ে ভার্সিটির চারজন টিচার সরাসরি অফার করেছে। একজনকে সে বাবার সাথে কথা বলতে বলেছে। বাকি তিনজনকে অপছন্দ হওয়ায়, “স্যার! আপনি না বলেন শিক্ষকরা বাবার মত? বাপ মেয়েতে কি এসব হয় স্যার” টাইপ কথা বলে কুপোকাইত করে ছেড়েছে।
মেয়েটা আমাকেও কুপোকাত করে দিচ্ছিলো প্রায়। কথা বলার সময় চোখের নাচন, ভ্রূ দোলানো, প্রাণবন্ত জীবনযাপন ভালোই লাগতে শুরু করেছিলো।
বিয়ে করবো, মর্মে ভাবীকে একটা মেইল লিখতে বসেছিলাম। হটাত মনে হল একটু খোঁজ খবর নেওয়া দরকার।
প্রথমে গেলাম হাত ধরে চাকরী খোয়ানো স্যারের এলাকায়। মধ্যবয়স্ক স্যারের বড় মেয়েটা রেশমির এক বছর জুনিয়র। চাকরী গেলেও স্যারের জীবন যাপনে খুব একটা কষ্ট হচ্ছেনা। সন্ধ্যায় তার বাড়ী গিয়ে দেখি দশ পনেরোজন ছেলে মেয়ে প্রাইভেট পড়ছে। ছোট বাড়ির কাচারি ঘরটায় একসাথে বিশজন পড়ানোর ব্যাবস্থা আছে।
পরিমল, পান্না মাষ্টারদের যুগে সন্ধ্যা বেলায় যেই স্যারের কাছে উঠতি বয়সি মেয়েরা আসে প্রাইভেট পড়তে সেই স্যারের আর যেই সমসাই থাক আলুর দোশ থাকবেনা।
স্কুলের দারোয়ানের সাথে কথা বলে জেনেছি মেয়েটা গনিতে কাঁচা ছিল। অসম্ভব কাঁচা। অন্য সাবজেক্টে ভালো করলেও গনিতে টেনেটুনে পাশ করতো। রেশমি চেয়েছিল স্যার আলাদা ভাবে তাদের বাসায় গিয়ে কয়েকমাস পড়াক। স্যার রাজি হন নাই। বাবামায়ের আদরের সুন্দরী মেয়ে হলে যা হয়। প্রচণ্ড জেদ থেকে সে এই কাজটা করেছে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে রেশমির বাবার যথেষ্ট প্রভাব আছে।

ফাস্ট ইয়ারে একটা ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। ছেলেটার সুদর্শন, মেধাবী। সম্পর্ক বেশীদিন টেকেনাই। রেশমির জেদ, রেশমির চেয়ে পড়াশুনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ও ছেলেটার দারিদ্রতা নিয়ে উপহাস করাই ছিল ব্রেকআপের কারন। এর পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে রেশমি। সিনিওর, ক্লাসমেট সহ স্থানীয় ছেলেদের সাথে দারুণ সময় কাটে । অ্যামেরিকান পাত্র দেখে খোলস বদলায়। সব প্রেমের শুরুতেই লক্ষ্মী মেয়ে সাজে সে। রেশমির ক্লাসের কয়েকজনের সাথে কথা বলে একই তথ্য বেড়ীয়ে এসেছে।

সো,
সরি রেশমি...
সরি ভাবী......।
হূজ নেক্সট?
৩।
"দেবরজি,
অনেক দেখিয়েছেন, এবার লস এঞ্জেলেস এ চলে আসেন দয়া করে। তোমার ভাইকে সাথে নিয়ে একটা পাত্রী দেখেছি। শুনে খুশি হবে মেয়েটি এশিয়ান, ভারতীয়। রাজস্থানের মেয়ে। লম্বা পাঁচ ফিট ছয়। তোমার সাথে জাম্পেশ মানাবে বলেই ধারনা করছি। মেয়েটা রাজস্থানি হলেও টুকটাক বাংলা জানে। সেদিন আমাদের একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনিয়েছে। উচ্চারণ আর সুরে সামান্য সমস্যা হলেও দারুণ তার গায়কী। দেবরজি অবশেষে একজন রবীন্দ্র প্রেমি জুটল তোমার কপালে। ইতিপূর্বে তুমি নীলাঞ্জনা আর রেশমি মেয়ে দুটোকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছো সেভাবে মিছির আলিও কোনোদিন কাওকে বিশ্লেষণ করেনা। ভালো খারাপ, দোষগুণ নিয়েই মানুষ। নীলাঞ্জনাকে আমার ভালো লেগেছিলো। তাকেও যখন রিফিউজ করেছো তখন এ কথা স্পষ্ট যে বাংলাদেশী কোন মেয়ের তোমার জন্য নয়। দ্রুত ল্যাগেজ গুছিয়ে চলে আসো। আর হ্যাঁ আমার ছোটবোন প্রীতি তোমার সাথে আসবে। আবার ভেবোনা প্রীতিকে তোমার সাথে জুরে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। প্রীতি অনেক কমপ্লিকেটিভ একটা মেয়ে। তোমার চেয়েও জটিল হিসেব করে পা ফেলে। ওর চাই কম টাকাওয়ালা শান্ত শিষ্ট অনুগত টাইপ একটা ছেলে। যে ওর সব কথায় ইয়েস ম্যাম ইয়েস ম্যাম করবে। কবে আসছো জানিও"।
মেইলের সাথে একটা ছবিও দিয়েছেন ভাবী। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে খুব উত্তেজনায় আছেন। কারণ মেয়ের নাম লিখতেই ভুলে গেছেন। মেয়েটা দেখতে সুন্দরী। চেহারায় হাসি হাসি ভাব আছে। দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মত। ছবিটা ক্লোজ করে দিলাম। বেশিক্ষন দেখা ঠিক না। দুর্বলতায় আটকা পড়া যাবেনা।

নীলাঞ্জনা আর রেশ্মিকে নিয়ে লেখার পর ইনবক্স এ বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। একজন লিখেছেন, আসলে আপনারই যোগ্যতা নেই এদেশি মেয়েকে বিয়ে করার। সবার দোষ এভাবে প্রকাশ করে দিচ্ছি কেন সেটা নিয়েও কথা বলেছেন কেও। একজন বিশাল এক চিঠি লিখেছেন যার সারমর্ম অনেকটা এরকম
"হতে পারে আপনি অনেক রিচ, অনেক অয়াইজ পারসন বাট আপনার ম্যান্টালি ওতটা রিচ না। আপনি নিজেকে সব পরিস্থিতির সাথে মানাতে পারেন না। সবার সাথে মিশতেও পারেন না। নীলাঞ্জনা মেয়েটার অভ্যাস নেই রাস্তার খাবার খাওয়া। অ্যামেরিকায় তো ঠিকই পিজ্জা আর বার্গার খান, দেশে সে আলগা দেশপ্রেম দেখাতে রাস্তার পাশের ভাত খান। নীলাঞ্জনা, রেশমিরা সারাজীবন দেশকে ভালোবাসে, আপনার মত ছয়মাসের জন্য না। মনের মত মনের মানুষ না খুঁজে যাকে তাকে মনের মত করে গড়ে তোলাই জ্ঞানী মানুষদের কাজ। আশা করি আপনি জ্ঞানীর পরিচয় দেবেন"।
মেয়েটার কথায় যুক্তি আছে। আমিও দাঁতে দাঁত চেপে বসলাম, বিয়ে বাংলাদেশী মেয়েকেই করবো।
বন্ধুর পছন্দের পাত্রী দেখতে গেলাম। মেয়েটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ে। দেখে পছন্দ হয়ে গেলো। বন্ধুর দূর সম্পর্কের কাজিন। মেয়েটা স্পষ্ট ভাষী, বুদ্ধিদীপ্ত। ভার্সিটি ডিবেট ক্লাবের সেক্রেটারি। যুক্তি দিয়ে স্ট্রেট কথা বলে। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে গেলো। পাস্পোর্ট চাইলাম। বিয়ে করে দেশে বেশিদিন থাকার ইচ্ছা নাই। মেয়েটা সোজা জানিয়ে দিলো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না করে সে দেশ ছাড়বেনা। বিয়ে করে রেখে যেতে হবে। আমিও তো বউ না নিয়ে যাবো না।
দুজনের অনড় অবস্থানের কারনে বিয়ের আগেই সংসার ভেঙ্গে গেলো।
আমি হতাশ!!
নাহ, দেশি মেয়ে বুঝি বিয়ে করা হলনা।
ভাবীর বোন মানে বেয়ান প্রীতি ফোন করেছে। দেখি মিস কমপ্লিকেটেড কি বলেন?
৪।
প্রীতির সাথে যাওয়া হলনা, ফ্লাইট ক্যান্সেল করতে হয়েছে একেবারে শেষ সময়ে! খোজ নিয়ে দেখেছি প্রীতি ভালো একটা মেয়ে। সংসারী, রাগহীন, নির্লোভ। ভাবী কেন ওর আর আমার একই ফ্লাইটের ব্যাবস্থা করেছিলে সেটা বেশ বুঝতে পেরেছি । বুঝেই একটু খোজ খবর নিলাম। একবার মনে হল এতটা ভালো মেয়ের যোগ্য আমি না। আমার চেয়ে বেটার কিছু ওর প্রাপ্য। প্রীতির চলে যাওয়ার দিন অসম্ভব মন খারাপ হয়েছিলো। মন বড়ই অদ্ভুত। এরই মধ্যে প্রীতির জন্য জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। মন ভালো করতে পুরনো থেরাপির আশ্রয় নিলাম। বারিধারা থেকে হাঁটা শুরু করলাম। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা। চলতে ফিরতে এমন সব ঘটনার সম্মুখীন হব যা মন ভালো করে দেবে। রাস্তায় বের হয়ে বুঝলাম কাজটা ভালো হয়নাই। জঘন্য হয়েছে। সেদিন ছিল পাঁচ তারিখ। ৫ই জানুয়ারি। একদল চাইছে দেশ দখল করতে আরেক দল দখলদারিত্র ধরে রাখতে। দুই দলের মাঝে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবু বের যখন হয়েছি একটু হেটেই দেখি।
রাস্তা ঘাটে মানুষ তেমন পেলামনা। দু চারটা যা ছিল সব রাজনীতিবিদ ও তাদের চ্যালা প্যালা। মাত্র দুইটা সাউন্ড বক্স বাজিয়ে যে এত মানুষ জড় করা যায় এটা লস এঞ্জেলস বাসী কল্পনাও করতে পারবে না। হাঁটতে হাঁটতে লিঙ্ক রোড পেড়িয়ে হাতির ঝিল দিয়ে কারওয়ান বাজার চলে এলাম। বসুন্ধরা সিটির সামনে দিয়ে পান্থ পথ। সিগনাল থেকে কোন দিকে যাবো ভাবছি। হটাত চোখ আঁটকে গেলো একটা মেয়ের উপর। দেখতে একেবারেই সাধারণ। তবে সাধারনের মাঝে কোথায় যেন অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে যেটা আবিষ্কার করতে কলম্বাসেরও কয়েক যুগ লেগে যেতে পারে। ওহ! কলম্বাসের কথা থেকেই মনে পড়লো, এই মেয়ের নিজের কোন সমস্যা না থাকলে বিয়ে করে নিয়ে যাবো। তার পড় ওয়াশিংটনে কলম্বাসের প্রতিকৃতির সামনে নিয়ে বলবো, 'হে অ্যামেরিকার আবিষ্কারক! তুমি কি বলতে পারবে এই মেয়ে সাধারণ অবয়বে কি অসাধারণত্ব লুকিয়ে রেখেছে? ছয়মাস ধরে চেষ্টা করে আমি ফেইল'।

মেয়েটা একজন ফকিরের সাথে কথা বলছিল। ভাবলাম দশ টাকার নোট দিয়ে পাঁচ টাকা ভাংতি পাচ্ছে না। একটু পড় দেখি ফকির তার চটের আসন ভাঁজ করে রেখে মেয়ের পিছে হাঁটা ধরলো। আগ্রহ বেড়ে গেলো? ফরিকটা এই মেয়ের রিলেটিভ?
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ফলো করলাম। পান্থপথ মোড় থেকে নিউ মার্কেটের দিকে হাঁটছে। আমিও হাটছি। তারা এসে খাজা হোটেলে প্রবেশ করলো। সারাদিনে এখন বুঝলাম প্রচণ্ড খিদা পেয়েছে। একেবারে কোনার টেবিলে আরও পাঁচজন অপেক্ষা করছিলো। বলার অপেক্ষা রাখেনা এই পাঁচজনও ফকির। এক টেবিলে ছয়জন বসার ব্যাবস্থা আছে। অতিরিক্ত চেয়ার আনা হল। ওয়েটারদের আচরনে বোঝা গেলো এই ঘটনার সাথে তারা পুর্ব পরিচিত। চিংরি মাছ, গরুর মাংস, শুটকি ভর্তার সাথে গরম গরম বেগুন ভাজি। ফকিরদের চোখে মুখে রাজ্যের প্রশান্তি। প্রশান্তি মেয়েটার অবয়বেও। আমিও একই মেনু দিয়ে খেলাম পাশের টেবিলে।
ওর নাম অরুণিমা। ৫ই জানুয়ারি মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী, বাবার মৃত্যু ও ওর জন্মদিনে এই আয়োজন কর আসছে সাত বছর ধরে। জন্মের এক বছর ছয়দিন পড় মা মারা যায়। ছয়মাস পড় বিদায় নেন বাবাও। মামাদের বাড়িতে বড় হয়েছে। ইডেনে পড়ে। মামাদের সাথে কথা বললাম। ওর মামা মামীরা উচ্ছ্বসিত। অবশেষে দুখী মেয়েটির জীবনে দীপ্তিময় আলোক ছটার হাতছানি। জ্যোতিষ নাকি বলেছি অরুণিমার সংসার হবে। সোনার সংসার, স্বামীর ভালোবাসায় ভরপুর এক সংসার। কয়েকজন বন্ধু আর অরুণিমার আত্মীয়দের উপস্থিতিতে আংটি পরান হল। আমি জ্যোতিষী শাস্ত্র বিশ্বাস করিনা, এই প্রথম চাইছি জ্যোতিষীর কথা সত্যি হোক। অরুণিমাকে ভালো বাসতে চাই। অনেক অনেক ভালো। ও চাইলে অ্যামেরিকা ছেড়ে জ্যামের শহর, ভায়োলেন্সের শহর, গিজগিজে মানুষের শহর ঢাকাতেই আবাস গড়বো...।
পুনশ্চ- আজ ১১ই জানুয়ারি। অরুণিমার জন্মদিন। অরুণিমা পান্থপথ এলাকার ফকিরদের একত্রিত করেছে খাজা হোটেলে। আমিও সাথে আছি। খাওয়ার মাঝে সেলফি তুলে ভাবীকে পাঠাবো। ভাবী দেখুক, মানুষকে খাইয়ে কতটা তৃপ্তি পাওয়া যায়।
নিচে লিখবো, 'প্রস্তুত তো, বধু বরণের জন্য...?


৫।
হানিমুনের জন্য ভাইয়ার পক্ষ থেকে দুইটা এয়ার টিকেট পেয়েছি। সুইজারল্যান্ডে দশ দিন থাকা খাওয়ার খরচও। ভাবীর পক্ষ থেকে পাঁচদিন বোনাস। সব মিলিয়ে হানিমুনের সময়টা দারুণ কাটছে। আমি এখন জেনেভার পত্যান্ত এক গ্রামে। এলাকার সবচে সুন্দর রেস্ট হাউজটার ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে। হাতে ধূমায়িত কফি। যে দিকে চোখ যায় বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ আর ছোট ছোট পাহাড়ি টিলা। সবুজের মাঝে যেন খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ হেটে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে প্রথম দেখায় দুধেল গাই গুলোকে মেঘ মনে করাই স্বাভাবিক।
এই সময়ে আমার পাশে অরুণিমার থাকার কথা। অরুণিমা সাথে নেই। ভাবছেন হানিমুনের খরচ বাঁচাতে বউকে রেখেই চলে এসেছি? আরে নাহ, এতটা কৃপণ কোনদিনই ছিলাম না। আসলে অরুণিমার সাথে বিয়েটা হয়নাই।
ছোট বেলায় মাকে হারানো অরুণিমার বাবা বিয়ে করে আরেক যায়গায়। সেই থেকে মামাদের কাছে বড় হয়েছে মেয়েটা। নিঃসন্তান মামা-মামি ওকে বাপ-মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছে। মামি অসাধারণ একজন ভালো মানুষ। যেই গুণগুলো আমায় বাধ্য করেছিলো অরুণিমাকে ভালবাসতে, তার অধিকাংশই পেয়েছে মামির থেকে।
যখন বিয়ের প্রস্তাব দিলাম, ওর মামা-মামি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো। এতিম মেয়েটার ভাগ্যে এত ভালো সমন্ধ লেখা আছে! আমাকে অপছন্দ করার তেমন কোন কারন ছিল না। অরুণিমাও অপছন্দ করতে পারেনাই। খটকা বেঁধেছিল অন্য যায়গায়।
কলেজে অরুণিমাদের সাথে একটা ছেলে পড়তো। নাম ইমরান। নিম্ন মধ্যবৃত্ব পড়িবারের বড় ছেলে। সংগ্রাম করে নিজে পড়ছে, টিউশানির টাকায় ছোট ভাইবোনদেরও পড়ালেখা চালাচ্ছে। অরুণিমাকে ভালো লাগে ছেলেটার। দারিদ্রতার যাঁতাকলে পৃষ্ট ইমরান হীনমন্যতায় ভোগে। অরুণিমার সামনে আসতে লজ্জা পায়। এককান দোকান করে এ কথা চলে যায় অরুণিমার কানে। বাবা মায়ের ভালোবাসাহীনতায় বড় হওয়া মেয়েটাও যেন প্রকৃত ভালোবাসার অভাবে ভুগছিলো। ধরা দেয় ইমরানের বাহুতে। মামা-মামির মনে কষ্ট দিতে পারবেনা অরুণিমা, তাই শর্ত দেয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মামা-মামিকে প্রস্তাব দিয়েই বিয়ে করে ঘরে আনতে হবে। এর আগ পজ্জন্ত ডন্ট ট্রাই টু মাখামাখি তবে সবসময় পাশে পাবে অরুণিমাকে। ইমরানও সুবোধ ছেলে। ভালোবাসাকে বিশ্বাসের বুকে সঁপে দিয়ে একাগ্রচিত্তে নিজেকে গড়ছে। টিশানিটা কোচিং এ রূপান্তরের চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। অরুণিমার বান্ধবীরাও নিজেদের ছোট ভাই বোনকে ইমরানেই কাছেই পড়তে পাঠায়। চারদিক থেকে সাহায্য পাচ্ছে।
বিয়ের কথা উঠতেই মামা-মিকে ইমরানের কথা বলে নিরুপায় অরুণিমা। ইমরানও দেখা করে আমার সাথে। গত শুক্রবারে লাঞ্চের পর হোটেলে আসে। সব শুনে মনে হয়েছে অরুণিমা ইমরানকে চায়। বিত্ত বৈভব যে সুখ দিতে পারেনা তা আমার চেয়ে ভালো কেও জানেনা।
চমৎকার পজিশনে ফ্লাট ভাড়া করে ইমরানের কোচিং সেন্টারটা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। নিজে উপস্থিত থেকে ওদের বিয়ে দিয়েছি। ইমরানের পক্ষের সব ব্যায় আমিই বহন করেছি। ভাইয়া ভাবী জানেনা। এখান থেকে নিউজিল্যান্ডে যাবো। বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পজ্জন্ত এ স্টেডিয়াম সে স্টেডিয়াম ঘুরে বেড়াবো। টাইগারদের জয় পরাজয় অনেকটাই ভুলিয়ে রাখবে অরুণিমার কথা। এর মধ্যে ভাবীর বোন প্রীতির বিয়ে টিয়ে হয়ে যাবে। না হলে আরেক বিপদ।
সাধের বিয়েটা বাংলাদেশী কোন মেয়ের সাথে হল না। আমার ভ্যাগেই লেখা নাই সম্ভবত। আচ্ছা বাংলাদেশে এখন রাত কয়টা বাজে? এই শীতের রাতে অরুণিমা কি কফি বানিয়ে অপেক্ষা করছে ইমরানের জন্য? ইমরানের জন্য হিংসা হয়। মেধাবী ছেলেটা এয়ার্পোর্টে বিদায় বেলায় বলেছিল, ‘ভাইয়া- অনেকেই ইউএস ডলার দিয়ে আমাদের স্বপ্ন কিনে নিয়ে যায়। আপনারও সুযোগ ছিল। আপনি আসলেই অন্যরকম, একটু বেশীই ভালো। ভালো থাকবেন ভাইয়া’। ইমরানকে বলা হয়নাই, ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা পাইয়ে দেওয়ার মাঝেও আনন্দ আছে। কিছু কিছু দীর্ঘশ্বাসে সুখ লুকীয়ে থাকে। আমার যায়গায় কবি গুরু হলে বলতেন ‘সুখের মত ব্যাথা’।
১১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×