somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজয় বনাম অভ্র, নাকি ভাষার মুক্তি আন্দোলন?

২১ শে এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাম্প্রতিককালে সফটওয়্যার ব্যবসায়ী জনাব মোস্তফা জব্বারের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের কারণে জনমনে, বিশেষত কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের মনে ব্যপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়া জনাব জব্বারের বিরোধিতার পাশাপারি আরো কিছু তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জনাব জব্বারের মালিকানাধীন বিজয় সফটওয়্যারের বিপরীতে এসেছে জনপ্রিয় অভ্র সফটওয়্যারের নাম।

সাম্প্রতিককালের অভ্র বনাম বিজয় নিয়ে এই আলোচনার ডিসকোর্সে দুটো উপাদান আছে – একটা হল রাজনৈতিক আরেকটা প্রযুক্তিগত।
রাজনৈতিক দিক থেকে একে অনেকে ভাষা আন্দোলন বলে অভিহিত করছেন। আমি সঠিক জানি না, তবে যদি ধরে নিই অভ্রের প্রণেতা Free software foundation এর দর্শনে বিশ্বাসী, তাহলে আন্দোলনটা মূলত কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রযুক্তির প্রসার এবং সহজলভ্যতাকে ব্যবসায়িক লাভের নিমিত্তে বাধাগ্রস্ত করা হবে কিনা সেই প্রশ্ন নিয়ে। জনমত মূলত ভাষা ব্যবহারের প্রযুক্তির মুক্ত ব্যবহারের পক্ষে, এবং সেকারণেই এটা ভাষা আন্দোলন।

যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে লেখ্য ভাষার জন্য বাংলা বর্ণমালার ডিজাইন ও এক অর্থে একটা প্রযুক্তি, যা মুখে বলা ভাষার লিখিত এনকোডিং এর একটা কোডসেট মাত্র। এটা পুজিবাদ-পূর্ব সময়ে তৈরি হয়েছে বলে এটা নিয়ে পেটেন্ট করার প্রসঙ্গ আসেনি। এখন, যদি ঐ কোড-সেট পুজিবাদী আমলে কেউ পেটেন্ট করে বসত আর আইনগত ভাবে ঐ বর্নমালায় লিখতে হলে রয়েল্টি দিতে হত, তাহলে ব্যপারটার বিরুদ্ধে জনমত কেমন হত? কিম্বা ধরুন ৫০ এর দশকে যখন জাতিগত শোভিনিজমের বশে উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হল, তখন প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছে? বর্তমান প্রেক্ষিতে হয়ত অনেকেই এতটা গভীরভাবে ভেবে আন্দোলন করছে না, কিন্তু মূল-ধারা চিন্তা করলে আন্দোলনটা ভাষা-মুক্তির আন্দোলনই বটে।

এখানে একটা সতর্কীকরণ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। পপুলিস্ট আন্দোলনের ফল আত্মসাৎ করে তাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার নজীর ইতিহাসে অনেক। সে হিসেবে অভ্রের প্রণেতা যদি চান, এই আন্দোলনের ফলকে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিজ্ঞাপণ হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন। ওপেন-সোর্সকে যারা বিজনেস মডেলে সাজান , তারা মূলত এমন কাজটিই করেন। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী সেই বিবেচনা হয়ত একসময় প্রয়োজন হবে। আপাতত সতর্ক থাকতে দোষ নেই।

বাকি যে কথা গুলি এসেছে, সেগুলো মূলত প্রযুক্তিগত।

বিজয় কিম্বা জনাব মোস্তফা জব্বারের লাভ-লোকসানের হিসেবটা কীবোর্ড লে-আউটে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখানে বিষয়টা আরো বিস্তৃত। প্রযুক্তিগত ভাবে বিষয়টা বাংলা কম্পিউটিং বা বাংলা ভাষায় কম্পিউটারের বিভিন্ন সফটওয়্যারের সাথে ইন্টারফেসিং বা কথোপকথনের প্রযুক্তি নিয়ে।

সার্বিক ভাবে বাংলা কম্পিউটিং কে তিনটা অংশে বা মডিউল এ ভাগ করা যেতে পারে – ১) কী-বোর্ড কিম্বা অন্য কোন ইনপুট ডিভাইস (যথা মাউস, টাচপ্যাড, ট্যাবলেট ইত্যাদি) এর মাধ্যমে সহজে গ্রহণযোগ্য উপায়ে প্রাকৃতিক ভাষাকে কম্পিঊটারে প্রবেশ করানো, ২) কম্পিউটারে প্রক্রিয়াকরণযোগ্য এবং বৈশ্বিবভাবে স্বীকৃত কোন একটা এনকোডিং স্কীম (যথা ইনিকোড) এর আওতার প্রবেশকৃত তথ্য কে সংরক্ষণ ৩) সংরক্ষিত বা প্রক্রিয়াকৃত তথ্যকে সাধারণ ভাবে বাংলাভাষীদের বোধগম্য একটি লেখ্য রূপের (ফন্ট) মাধ্যমে আউটপুট ডিভাইস (মনিটর/প্রিন্টার) এ উপস্থাপন।

বিজয়সহ প্রথম দিককার বাংলা সফটয়্যারগুলোতে এই তিনটি বিষয়ের সবগুলো ছিল না। বিশেষত ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে বিশ্বস্বীকৃত ইউনিকোড এনকোডিং এ যেতে অনেক রাজনৈতিক বাধা পেরুতে হয়েছে (প্রযুক্তিগত নয়)। তদুপরি এই তিন অংশকে পৃথক পৃথক নির্মাতার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে নির্মাণের উপযোগী হতেও সময় লেগেছে।

বাংলা কম্পিউটিং এর পরবর্তী উন্নততর বিষয়গুলো, যেমন অভিধান, অনুবাদক, কিম্বা বানান-শুদ্ধকারক সফটয়্যারকেও এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে, তবে আমার মতে ইন্টারফেসের বিষয়টি অন্তত রাজনৈতিক লক্ষের দিক থেকে পৃথক। অভিধান কিম্বা অন্য-কোন বাড়তি ফিচার নিয়ে ব্যবসাতে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু কীবোর্ড লে আউট, ইউনিকোড নিয়ে ব্যবসাতে আপত্তি আছে। ফন্টের ব্যাপারটিতে যেহেতু ডিজাইনের অনেক বৈচিত্র থকতে পারে, তাই সেটা নিয়ে ডিজাইনার রা ব্যবসা করতে পারে। অবশ্যই সবগুলো ফিচারকে একীভুত করে তৈরী করা কোন সফটওয়্যার বাজারে বিকোতে পারে। কিন্তু কোডিং স্কীমগুলো, সে যত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলই হোক, উন্মুক্ত থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।

প্রযুক্তিগত আরেকটা দিক হল ওপেন সোর্স (ফ্রি সফটয়্যার নয়)। এটাও মূলত প্রযুক্তিলব্ধ পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবসার ফাদে আটকানো যাবেনা এই দর্শণের অনুসারী একটা সিদ্ধান্ত। আর এতে সফটওয়্যারের উন্নয়ন, ত্রুটি দূরীকরণ ইত্যাদি সহজ হয়, সেটাত জানাই আছে। এক্ষেত্রে অভ্র ওপেন-সোর্স কিনা, সেটা আমার জানা নেই।

সামগ্রিকভাবে, অভ্র বিজয়ের তুলনার প্রযুক্তিগত ভাবে শ্রেয় কিনা, অভ্রের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজ কিনা, কিম্বা অভ্রই বাংলা কম্পিউটিং এর শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি কিনা, সেটা এখানে মূখ্য প্রশ্ন নয়। এমনকি কম্পিঊটারে বাংলা ব্যবহারের প্রযুক্তির বিকাশে অভ্রের অবদার কতটা, সেটাও বিবেচ্য নয়।

মূখ্য প্রশ্ন হল ব্যক্তি কিম্বা গোষ্ঠীর বানিজ্যিক স্বার্থে গণব্যবহার্য কোন প্রযুক্তিকে কুক্ষিগত করে রাখার সুযোগ দেয়া নীতিসম্মত কিনা, সেটা। উচ্চ-ফলনশীল ধানের জীনকে পেটেন্ট করে ব্যবসায়িক স্বার্থে কৃষকের ধান-উৎপাদনে রয়েল্টি আরোপ করা যেমন নীতিসম্মত নয়, তেমনি নীতিসম্মত নয় কোন লেখার রীতিকে (কীবোর্ড লে-আউট) পেটেন্ট করে জনসাধারণের ভাব-প্রকাশের মাধ্যম নিয়ে ব্যবসা করা।

তাই শ্লোগান হোক ভাষা-মুক্তির, সেটা বর্ণ, অভ্র, বিজয় কিম্বা শাব্দিক যে নামের সফটওয়্যার দিয়েই আসুক।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১০ ভোর ৬:৩৯
১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×