somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেশে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করেছে এমন ব্যক্তিদের বিচার এখনও হচ্ছে। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির একটি কোর্ট সাবেক নাজি সদস্য হেইনরিখ বোয়েরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের তিন বেসামরিক নাগরিককে
হত্যার দায়ে আদালত এ দণ্ড প্রদান করেছেন

আন্তর্জাতিক এবং সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। অবশ্য কয়েক শতক আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রথাগত আইন, চুক্তি ইত্যাদি বিদ্যমান ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে এ ধরনের অপরাধের একটা সর্বজনীন মাপকাঠি নির্ধারণ ও এর আওতাকে আরও বিস্তৃত করে সর্বজনীন করার প্রচেষ্টা জোরদার হয়।
গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন আইন, চুক্তি ও সংবিধিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট প্রকাশিত লন্ডন সনদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে। বলা যায়, ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আইনের আধুনিক ধারণার সূচনা হয়। যেসব আইন, চুক্তি ও সংবিধিতে এসব সংজ্ঞায়িত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে_ গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য ১৯৪৮ সালের কনভেনশন, ১৯৪৬ সালের ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের সংবিধি, যুদ্ধের আইন ও প্রথা বিষয়ক ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অ্যাক্ট, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংবিধি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধি ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩।
ওপরের আইনগুলোতে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে কী বোঝায়, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যুরেমবার্গ চার্টারের ৬ অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে যুদ্ধ বা আগ্রাসনের জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। যুদ্ধকালীন সব ধরনের মানবতাবিরোধী কার্যক্রম থেকে যুদ্ধরত পক্ষকে বিরত রাখা এবং বেসামরিক ব্যক্তি, লোকালয় ও স্থাপনা রক্ষার্থে ১৯৪৯ সালে চারটি পৃথক কনভেনশনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল : ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল (ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল) শুরু হয় ১৯৪৫ সালের ১৮ অক্টোবর। এর মাধ্যমে ২৪ জন প্রধান প্রধান জার্মান নাজি নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৪৬ সালের ৩১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য গ্রহণ, শুনানি ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ২৪ জনের বিরুদ্ধে চার ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়। এগুলো হচ্ছে :শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ; দখলদারিত্ব কায়েমের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনার অপরাধ; যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবরে রায় প্রদান করা হয়। ২৪ জনের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ১৬ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং ১৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অন্যরা ছাড়া পেয়ে যায়। এদের বাইরে ন্যুরেমবার্গ চার্টার অনুযায়ী আরও ২০০ জনের বিচার করা হয়েছিল। বিভিন্ন সামরিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরও ১৬০০ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। এর পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নাজি দালালদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ফ্রান্সে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার দালালের বিচার হয়েছিল। ১৯৯৭ সালেও মরিস পাপন নামে এক নাজি দালালের বিচার করা হয়। এখনও নাজি দালালদের খোঁজা হচ্ছে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য। কারণ, যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনও তামাদি হয় না। যে কোনো সময়, এমনকি অপরাধীর মৃত্যুর পরও বিচার প্রক্রিয়া চলতে পারে।
টোকিও ট্রায়াল :১৯৪৫ সালের ১৯ জানুয়ারি 'ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট'-এর চার্টার অনুমোদিত হয়। একই বছরের ৩ মে জাপানের টোকিওতে ট্রায়ালের বিচারকাজ শুরু হয়। তিন ধরনের অপরাধকে বিচারের আওতায় আনা হয়। এগুলো হলো যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ। ১১ জন বিচারক নিয়ে গঠিত টোকিও ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্যার উইলিয়াম ওয়েব। টোকিও ট্রায়ালে ৪১৯ জন সাক্ষীর বক্তব্য শোনা হয়। ৪৩৩৬টি সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়। প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জনকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে দু'জন মামলা চলাকালে মারা যায় এবং একজনকে মানসিক ভারসাম্য হারানোর জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আইখম্যান মামলা :হিটলারের শাসনামলে আইখম্যানের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ইহুদিকে ধারাবাহিকভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধ শেষে তিনি জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। ১৯৬০ সালে ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী আইখম্যানকে অপহরণ করে আর্জেন্টিনা সরকারকে কিছু না জানিয়েই বাক্সবন্দি করে ইসরায়েলে নিয়ে আসে। ১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল জেরুজালেমে শুরু হয় বিচার কাজ। মোট ১৫ ধরনের ক্রিমিনাল চার্জ আনা হয়েছিল আইখম্যানের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলের ডিস্ট্রিক্ট অব কোর্ট অব জেরুজালেম শুনানির পর আইখম্যানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট আইখম্যানের যুক্তিতর্ক প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি যে অপরাধগুলো করেছেন, সেগুলো বিশ্ববিবেক কর্তৃক নিন্দিত এবং সব রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থায় অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো :যারা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধ করেছে (যেমন যুদ্ধাপরাধ), বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো আদালত তাদের অপরাধের বিচার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদালতের এখতিয়ার বিশ্বজনীন।
যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল :সাবেক যুগোস্লাভিয়া অঞ্চলে ১৯৯১ সাল থেকে সংঘটিত যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফর্মার যুগোস্লাভিয়া' নামে পরিচিত। ১৯৯৩ সালের ২৫ মে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৮২৭নং প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমে এ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সিদ্ধান্তে ট্রাইব্যুনালের ৩৪টি অনুচ্ছেদ সংবলিত সংবিধি অনুমোদিত হয়। সংবিধিতে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল নিরাপত্তা পরিষদের একটি সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই ট্রাইব্যুনাল তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে এবং নিরাপত্তা পরিষদ কোনোভাবেই ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ কর্তৃক 'ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল' গঠন এটাই প্রথম। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার ভূখণ্ডে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল তাদের বিচারের এখতিয়ার প্রদান করা হয় ট্রাইব্যুনালকে। গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল বসনিয়ার সার্ব নেতৃবৃন্দ ও সামরিক কমান্ডারদের অভিযুক্ত করে। ১১ সদস্যবিশিষ্ট সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে উদ্বোধন করা হয়। ট্রাইব্যুনালটি দুটি ট্রায়াল চেম্বার, একটি আপিল চেম্বার, প্রসিকিউটর ও রেজিস্ট্রি নিয়ে গঠিত হয়েছিল। যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় ১৯৯৪ সালের ৮ নভেম্বর থেকে। প্রাথমিকভাবে ১৬২ জন অভিযুক্তের বিচার শুরু হয়। সেখান থেকে ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছেন আদালত। এর মধ্যে ৪৮ জনকে সাজা প্রদান করা হয়েছে, ১১ জনের মামলা স্থানীয় আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে ও ৫ জনকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে। যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনালের আওতায় অন্যতম অভিযুক্ত সার্ব নেতা রাদোভান কারাজ্জিচকে গ্রেফতার করা হয় ২০০৮ সালের ২১ জুলাই। গ্রেফতারের পর ৩০ জুলাই তাকে ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে তার বিচার চলছে। ২০১৪ সালের মধ্যে এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ করতে বলেছে। যেসব বিচার এই সময়ের মধ্যে শেষ হবে না, তা 'ইন্টারন্যাশনাল রেসিডুয়াল মেকানিজম ফর ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল'-এ স্থানান্তর করতে হবে। এই মেকানিজম ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালটি রাদোভান কারাজ্জিচ, র‌্যাটকো মিলাভিচ এবং গোরান তেদিচের বিচারকাজ শেষ করবেন।
রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল : ১৯৯৪ সালের ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রুয়ান্ডা ও আশপাশের রাষ্ট্রে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ীদের বিচার করতে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি সংক্ষেপে রুয়ান্ডা ট্রায়াল নামে পরিচিত হলেও এর পুরো নাম 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা'। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রুয়ান্ডা ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় রুয়ান্ডার নাগরিকদের সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও অন্যান্য অপরাধের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি চেম্বার রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি চেম্বার ট্রায়াল শোনেন। বাকি একটি চেম্বার আপিল শোনেন। ট্রাইব্যুনালে মোট ১৬ জন স্থায়ী বিচারক রয়েছেন। এর বাইরে আরও ৯ জন অন্তর্বর্তীকালীন বিচারক আছেন। বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মালাগাসির নাগরিক মপারানি রাজনসন।
১৯৯৭ সালে টাবার সাবেক মেয়র জ্য পল আকায়েসুর মামলার মাধ্যমে রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। আকায়েসুর মামলার মাধ্যমেই প্রথম জেনোসাইডাল রেপের বিষয়টি আলোচিত হয়। ১৯৯৮ সালে ট্রাইব্যুনাল বিচার প্রক্রিয়া শেষে রায় প্রদান করেন। রুয়ান্ডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জ্যা কামবানন্দ ও টাবার সাবেক মেয়র জ্যা পল আকায়েসুকে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল ৯২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। তিনজন পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সাজা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ১৭ জন তাদের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেছে। ১০ জন এরই মধ্যে সাজা ভোগ করে ছাড়া পেয়েছে। চারজনের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে দু'জন মারা গেছে। ১০ জন অপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া জাতীয় আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে আরও ৩২ জনের বিচার প্রক্রিয়া চলছে।
এই ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া ২০০৮ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ করতে বলেছে। যেসব বিচার এই সময়ের মধ্যে শেষ হবে না, তা 'ইন্টারন্যাশনাল রেসিডুয়াল মেকানিজম ফর ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল'-এ স্থানান্তর করতে হবে।
এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বার, কম্বোডিয়া :২০০৩ সালে জাতিসংঘ ও কম্বোডিয়া সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমেই কম্বোডিয়ায় এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বার স্থাপিত হয়। এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার জ্যেষ্ঠ খেমাররুজ নেতা ও গুরুতর অপরাধের জন্য প্রধানত দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে বিচারকাজ শুরু হয়। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ৫ জন সম্ভাব্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রস্তুত করা হয়। এরা হলো খেমাররুজ আমলের এস-২১ নামে পরিচিত নির্যাতন ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাং কেক লিও ওরফে কমরেড ডুম, ব্রাদার টু নামে পরিচিত নিওন চিয়া, খেমাররুজ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েং স্যারি, তার স্ত্রী সেই সময়ের সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী ইয়েং থিরিথ এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খিউ সাম্পান। ক্যাং কেক লিওকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত হিসেবে ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই আটক করা হয়। ২০০৮ সালের ১২ আগস্ট যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্ত থাকার অপরাধে তাকে সাজা প্রদান করেন আদালত। পরবর্তী সময়ে ক্যাং কেক এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ২০১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আপিলের নিষ্পত্তি হয়। আপিলের রায়ে ক্যাং কেককে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্ত হিসেবে শাস্তি বহাল রাখা হয়। বর্তমানে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।
স্পেশাল কোর্ট ফর সিয়েরালিওন :জাতিসংঘ ও সিয়েরালিওনের যৌথ উদ্যোগে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেশাল কোর্ট ফর সিয়েরালিওন নামে বিশেষ আদালত। সিয়েরালিওনে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই আদালত। এ আদালতের বিচারক হিসেবে বর্তমানে ১২ জন বিচারক কাজ করছেন। দুটি ট্রায়াল চেম্বার রয়েছে। ১ নম্বর ট্রায়াল চেম্বারে বিচারক চারজন এবং ২ নম্বর ট্রায়াল চেম্বারে বিচারক তিনজন। আপিল চেম্বারে বিচারক ছয়জন। ২০০৪ সালের জুন মাসে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০০৩ সালের ১০ মার্চ ৭ জনের বিচার কাজ শুরু হয়। তারা হলেন অ্যালেক্স বিমা, মরিস কেলন, ব্রিমা কালানা, সামুয়েল নরম্যান, ফোদে সানকো, ইসা সেসা ও অগাস্টিন গিবাও। এর মধ্যে অ্যালেক্স বিমাকে ৫০ বছরের কারাদণ্ড, মরিস কেলনকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড, ব্রিমা কামানাকে ৪৫ বছরের কারাদণ্ড, ইসা সেসাকে ৫২ বছরের কারাদণ্ড, অগাস্টিন গিবাওকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। বাকি দু'জন মারা যাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। লাইবেরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেলরের বিচারকাজ শুরু হয় ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ। ২০১২ সালের ৩০ মে বিশেষ আদালত টেলরকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৫০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। চার্লস টেলর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। বর্তমানে আপিলের শুনানি চলছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত : যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গের বিচারে স্থায়ী কার্যকর আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে 'রোম বিধি' গৃহীত হয়। প্রয়োজনীয় ৬০ রাষ্ট্রের অনুমোদনের পর ২০০২ সালের ১ জুলাই রোমবিধি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে 'আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত' যাত্রা শুরু করে। রোমবিধি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গের বিচারের এখতিয়ার রাখে। রোমবিধি অনুযায়ী ২০০২ সালের ১ জুলাই বা এর পরে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচারে এই আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। এর আগে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার এ আদালতের নেই। এ কারণে একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের বিচারও এ আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এ আদালত উগান্ডা, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও সুদানের দারফুর ঘটনার বিচার হাতে নেন।
২০০৯ সালের ৪ মার্চ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর-আল-বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। বশির বাহিনীর হামলায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, লুণ্ঠনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়। বশির এবং তার সামরিক ও মিলিশিয়া বাহিনী রোম সংবিধির ৭(১) (ক), (খ), (ঘ), (ছ), (জ) এবং ৮(২) অনুচ্ছেদের অধীনে যথাক্রমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হিসেবে জড়িত ছিল বলে আন্তর্জাতিক আদালত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এ কারণে আদালত সংবিধির ২৫(৩) ধারা অনুযায়ী ওমর-আল-বশিরকে এসব অপরাধের ইন্ধনদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
এখনও চলছে বিচার :দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করেছে এমন ব্যক্তিদের বিচার এখনও হচ্ছে। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির একটি কোর্ট সাবেক নাজি সদস্য হেইনরিখ বোয়েরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের তিন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার দায়ে আদালত এ দণ্ড প্রদান করেছেন। ৮৮ বছর বয়সী এ ডাচ্ নাগরিকের পক্ষে বার্ধক্যজনতি কারণে দণ্ড মওকুফের বিষয়টি তোলা হয়। কিন্তু আদালত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৩২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×