somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা

১৭ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা
কাশেম হুমায়ূন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে আজকের প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই অতি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। দিয়েছিলেনও। কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি অথবা তা ভ-ুল করা হয়েছে তাকে মর্মান্তিকভাবে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। আজকাল ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতাকে এক করে তালগোল পাকিয়ে ফেলার একটি অসুস্থ দুরভিসন্ধিমূলক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা এক কথা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশব্দ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতেও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই বোঝায়।

বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন একজন বাঙালি ও একজন মুসলমান হিসেবে। আবার বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি গর্ব করে বলতেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র নামে। বাঙালিত্ব আর মুসলমানত্ব মিলিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য তিনি সংবিধানে সংযোজন করেন তা জগদ্বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও গবেষণার বিষয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তা না করে ১৯৭২ সালে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করে আবার সংবিধানের ললাটে বিসমিল্লাহ বা রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে দিলে মানুষ নিশ্চয়ই তাকে স্ববিরোধীই বলত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকেই তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম নিয়ে সঠিক এবং পর্যাপ্ত গবেষণা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা যেন কেউ দিতে না পারে এ ব্যাপারে তার সতর্ক পদক্ষেপ ছিল লক্ষণীয়। দূরদৃষ্টি কতদূর গেলে একজন রাষ্ট্রনায়ক এমন উদ্যোগ বা চিন্তায় এগোতে পারেন তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ইসলাম ধর্মে ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারতা, সহিষ্ণুতার ব্যাখ্যা রয়েছে। বিশ্বহিত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন রাষ্ট্র গঠন করা যায় না এটা ইসলামের শিক্ষা। যে রাষ্ট্রনায়করা শুভবুদ্ধিকে লাঞ্ছিত করেছেন, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তারা মানুষের অকল্যাণ করেছেন। ধর্মকেও হেয় করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ধর্মকে রাজনীতির কৌশলরূপে ব্যবহার করেছিলেন হজরত মুয়াবিয়া। এর ফলাফল ও পরবর্তী ইতিহাস ভালো হয়নি।

ইতিহাসে দেখা যায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একসময় ছিলেন কঠোর অসাম্প্রদায়িক। ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক মনস্কও। কংগ্রেসে থাকাকালে তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বেশ আলোচিত ও প্রশংসিত ছিল। এজন্য কংগ্রেস নেত্রী কবি সরোজিনী নাইডু হিন্দু-মুসলমানের দূত বলে আখ্যায়িত করেছিলেন জিন্নাহকে। এরপর তিনি কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেন। সাম্প্রদায়িকতা যে ধর্ম নয়, এর প্রমাণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আবার নিষ্ঠাবান ধার্মিক হয়েও যে অসাম্প্রদায়িক থাকা যায়, তার প্রমাণ মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মুহম্মদ আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর বঙ্গবন্ধু তো অবশ্যই।

পরবর্তীতে জিন্নাহ যে চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছিলেন তার নেপথ্যে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করা। কিন্তু তার পরিণতি জিন্নাহ, পাকিস্তান-পাকিস্তানি, বাঙালি কারও জন্যই সুখকর হয়নি। সবাইকেই তার কুফল ও ধকল সইতে হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আর বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলীয়ান হয়ে একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছে। তার সুফল হচ্ছে পাকিস্তানি শাসকদের সাম্প্রদায়িক শোষণ, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীন-অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠন।

জাতি শব্দটাও অসাম্প্রদায়িক। এখানে ধর্ম-বর্ণ কোন পরিচয় নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভেঙেচুরে ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্ছেদ করা হয়। এতে প্রকারান্তরে দেশকে আবার সাম্প্রদায়িকভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার এক যজ্ঞ শুরু হয়। সংবিধানে দেশকে সাম্প্রদায়িক করা হলে রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরায় সাম্প্রদায়িকতার রক্ত বইবে এটাই স্বাভাবিক। সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ। সেই সংবিধানে সাম্প্রদায়িক উক্তি বা দ্রষ্টব্য থাকলে তা ধর্মাশ্রয়ী কপটদেরই সুবিধা নিশ্চিত করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সেই দুর্দশার আলোকেই চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে।

বঙ্গবন্ধুর সেই প্রজ্ঞা আজও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এ কারণে মুজিব বা বঙ্গবন্ধু নামকে জোর করে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয় না। তা জোর করে মুছে দেয়ার সাধ্যও কারও হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, আফ্রিকার পেট্টিস লুমুম্বা এবং নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন এবং যুগোসস্নাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানও ইতিহাসে আপন গতিতেই জায়গা করে নিয়েছেন। নামে তারা ভিন্ন হলেও কীর্তিতে প্রায় অভিন্ন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বের ইতিহাসে এমন এক সবল-সফল রাজনীতিক, যিনি তার অনন্য সাধারণ নেতৃত্বে জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও চেহারাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে সফল হয়েছিলেন। গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের ঊধর্ে্ব উঠে তিনি বাঙালিকে এক দেহ, এক আত্মায় সমর্পিত করে যুদ্ধে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার গুণে।

তিনি তার এ অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য ও ইচ্ছাকে রাজনীতির মাঠে কখনো গোপন রাখেননি। অস্বচ্ছ অন্ধকার পথে হাঁটেননি। তার আদর্শ ছিল মুক্ত, সুস্পষ্ট। উগ্র ইসলামবাদীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি।

অগণিত দলমতে বিশ্বাসী হয়েও রাজনৈতিক কর্মপন্থায় নানামুখী ধারা বহন করেও জাতীয় আত্মরক্ষার তাগিদেই বাঙালিকে ফিরে যেতে হবে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায়। এর কোন বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার অমিত সাহস ও অনুপ্রেরণায় যে অসাম্প্রদায়িক দেশ চেয়েছিলেন সেই চাওয়া থেকে কিছু বিচ্যুত হলে আমাদের চড়া মাশুল গুনতে হবে

Click This Link
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×