দিনলিপি থেকে:
=========
ড. স্বপ্না রায়: তিনি ছিলেন একজন দেবী এবং একজন কবি। ...। আর এতে কোনো সন্দেহই নেই।
কুমিল্লার সেই দেবীতুল্য কবি ও সাহিত্যিক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ড. স্বপ্না রায়ের তুলনা করা যেতো শুধুমাত্র তাঁর নিজের সঙ্গেই। আর কারো সঙ্গেই তাঁর তুলনা বা উপমা দেয়া ছিলো সম্পূর্ণরূপেই অশোভন।
তার সঙ্গে আমার শেষবার সরাসরি দেখার দিনটি ছিল 22 ডিসেম্বর 2006 সাল। বিভিন্ন কারণে সেই দিনটিও খুব অন্যরকমভাবেই কেটেছিলো আমার।
একদিকে মনে দুঃখের লহরী...নানা কারণে...অন্যদিকে আনন্দেরও। বুকের ভেতরে ছিলো ধিকিধিকি আগুনও। অনেক কারণেই।
এই এক ছোট্ট জীবনের বিভিন্ন পর্বে আমি কতো না আদর্শের ধারকবাহকও ছিলাম। আর এখন? সবই বাদ। পালকিতে করে কোথায় যেন চলেছি! বুঝতেই পারছি না। গন্তব্য যেন সত্যি সত্যিই অজানা।
শৈশবে খুব ধর্মপিপাসাও জেগে উঠেছিলো আমার। প্রথমে বাবার কাছ থেকে নিয়ে বাংলা কোরআন শরীফ পড়ি। তখন মাত্র বাংলা বানান করে পড়তে শিখেছিলাম। তারপর ধর্মপুস্তক পড়তে পড়তে ইসলামী ছাত্রশিবির এবং ধর্মবিপ্লবেরও স্বপ্ন!
তারপর আবারো একেবারেই বিপরীত মেরুতে অবস্থান আমার: ছাত্র ইউনিয়ন...যুব ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি করার প্রক্রিয়ায়ও যুক্ত ছিলাম অনেক অনেকদিন। সর্বশেষ: একসময় নিরীশ্বরবাদীও হয়ে গেলাম।...। আর আমার জীবনের এসব কথাই সেদিন সকালে শোনাচ্ছিলাম স্বপ্নাদি’কে। প্রফেসর ড. স্বপ্না রায়কে। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।
22 ডিসেম্বর 2006 তারিখ সকালবেলা আমি প্রথমেই যাই কুমিল্লায় বসবাসরত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী মানসীদি’র বাসায়। মানসী সাধু। কুমিল্লায় বাস করা একজন গুণী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীই বটে।
মানসী দিদির সংগীতের প্রথম দ্বৈত অ্যালবামের নাম ছিলো ‘ভোর হবে’। একদিন তাঁর কাছ থেকেই তখন অ্যালবামটি শুনতে নিয়েছিলাম আমি।
তখন মানসী সাধু একটি বাসার চারতলায় থাকতেন...কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়ার কালীতলায়। আর স্বপ্না রায় সেসময়ে একটি বাসার চারতলায় থাকতেন...এই কুমিল্লা শহরেরই রামঘাট এলাকায়। আর আমি তখন একটি বাসার ষষ্ঠতলায় থাকতাম...কাছেই ঠাকুরপাড়ার জোরপুকুরপাড় এলাকায়।
সেদিনই স্বপ্না রায়ের সঙ্গে একনাগারে কয়েকঘন্টা ধরে কথা হয় আমার। ঠিক এতোটা সময় ধরে কখনোই তাঁর সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। স্বপ্না দিদির মোবাইল নম্বরও হারিয়ে ফেলেছিলাম একসময়। তখন আবারও চেয়ে নিয়েছিলাম সেই নম্বর । মানসী সাধুর মোবাইল নম্বরও আবার চেয়ে আনি। আমার গ্রামীণ সিমকার্ড-01711-027426 নষ্ট হওয়ার পর সিমে সেভ থাকা সব নম্বরই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
কাস্টমার কেয়ার থেকে নতুন সিমকার্ড তুলে এভাবে আবারও সবার নম্বর সংরক্ষণ করেছি। নতুন সিমকার্ড তোলার সময় পুরনো নম্বরগুলো আর পাওয়া যায় না।
অনেক অনেক বছর ধরেই দেখা হয়নি আমার স্বপ্নাদি’র সঙ্গে। তাই যেন সেদিন খুব বেশি ক্ষুধার্তই ছিলাম তাঁর অমৃততুল্য কথা শোনার জন্যই। মনে হলো যে কোনো বিষয়েই তাঁর সহ্যশক্তিও খুব বেশি।
আমি সেদিন একতরফাই বকবক করছিলাম। তিনি বললেন, আমার কথা শুনতে তাঁর ভালোই লাগছে। সুতরাং আমিও কথা বলতেই লাগলাম। গেলাম কথা শুনতে। অথচ কথা আমারই বলা হয়ে গেলো অনেক বেশি।
আজকাল যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে, সে বিষয়েও কথা হলো। কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথাও দিদিকে বললাম। হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষেরই। নদীরপাড় ভাঙ্গলে ভিটা হারানো মানুষের মনের রঙ যেমন হয়...আমার কথাগুলো শুনে স্বপ্নাদি’র মুখের রঙও সেদিন সেরকমই হয়ে গিয়েছিলো।
সব সাম্প্রদায়িকই মানুষই ধর্ষক। তারা পৃথিবীকে ধর্ষনই করতে চায়। আমার এমন সব উত্তেজিত কথা শুনে স্বপ্না রায় সেদিন বললেন, সব ধর্মের লোকদের মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায়। কিন্তু মানুষের গন্তব্য তো হওয়া উচিত সুন্দরের দিকেই।
দিদি আমাকে সেদিন আইসক্রীম খেতে দিয়েছিলেন। গোলাপী রঙের চমৎকার কিছু আইসক্রীম। যদিও ছিলো তখন শীতকাল। তবু দিদি বলছিলেন, আইসক্রীম খাও। ভালো লাগবে। কারণ এই আইসক্রীম হলো অসাম্প্রদায়িক। সবাই খেতে পারে। তুমিও খাও। আইসক্রীমে সাম্প্রদায়িকতার বিষ নেই।
এই স্বপ্না দিদির স্বামীই যে করুণ কুমার দেব রায়, সেটা আমি অনেক অনেক পরেই জেনেছিলাম। করুণ কুমার দেবের সঙ্গে দিদির একসময় ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো নাকি সম্পর্ক ছিলো: এ নিয়ে সর্বশেষ স্বপ্নাদি’র মৃত্যুর আগেও আমার ফোনে ফোনে অনেক অনেক কথা হয়েছিলো।
স্বপ্নাদি’ কতো ভালো মানুষ ছিলেন। শুনেছি করুণকুমার দেবরায়ও খুব ভালো মানুষই ছিলেন। স্বপ্নাদি’র জীবনের শেষদিকে তার সঙ্গে আর দেখাই হতো না আমার। শুধুমাত্র ফোনেই কথা হতো। জীবনের শেষ সময়টুকু ভ্রমণ করে এবং ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখি করেই কাটাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। মৃত্যু এসে তাকে ছিনিয়েই নিয়ে গেলো। আর তাই কোনোদিনও জাগিবেন না তিনি। শুধু তাঁর জীবনের নানা স্মৃতি ও তাঁরই রচিত অমূল্য সব সাহিত্যকর্মই আমাদের আগামী দিনগুলোর অমর সঙ্গী হয়ে পাশে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৪:১১