দিনলিপি:
2 এপ্রিল 1995
19 চৈত্র 1401
কুমিল্লা।
অলংকরণ:
জসীম অসীম।
=========
আমি অনেক অখ্যাত কবির কবিতাও পড়ি। যেমন কবি মোখলেছুর রহমানের কবিতা।
1991 সালের বাংলা একাডেমীর বইমেলা থেকে একেবারেই অল্প দামে কিনেছিলাম এমন সব কবিদের কাব্যগ্রন্থগুলো।
এমন অনেক বইপত্র আমি বাড়িতেও দিয়ে দিয়েছি ‘কবি নজরুল স্মৃতি পাঠাগার’ গড়ার কাজে। সেই পাঠাগারের জন্য অনেক বিখ্যাত লেখকের বইপত্রও দিয়েছি। তবে বইগুলো পুরনো হলেও অমূল্য রত্নরাজি।
মোখলেছুর রহমানের কবিতাগুলো পড়তে মন্দ লাগে না, তবে এগুলোতে আমার বিবেচনায় খুব বেশি কবিত্ব নেই।
যেমন:
‘সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার...ওরা একটা ইতিহাস।’ অথবা ‘অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে পুড়ে আবার তোমার পুনর্জন্ম হবে।’
তিনি এক কবিতায় লিখেছেন, ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করো। মুখের ভাষা থাক না।’ অথবা ‘ঘরে আজ নেই শান্তি, চারদিকে হূল ফোটানোর খেলা।’ ‘ঝড়ের নায়ে পাল তুলে দাও, এখনি আসবে জোয়ার।’ কিংবা ‘বিশ্বাসযোগ্য কোনো হৃদয় যদি সঁপে দিতে পারো, তবে নিতে পারো বারো চান্দের উৎসব।’
এসব চয়ন আমার কাছে বেশ আবেগী মনে হয়েছে। কবিতাগুলোর মধ্যে যেসব অংশ আমার মনে একটু আধটু ভালো লেগেছে, সেসবই উল্লেখ করেছি। তবে এ অংশগুলোও মনে অমলিন থাকে না।
যেমন: ‘নারী, আপন হৃদয় মাধুরী দিয়ে ভালোবাসার জোয়ারে সয়লাব করো, পুরুষের অস্তিত্বের সমগ্র চেতনাকে।’
আমি যখন দেখি, কবি মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘চারদিকে মিথ্যের বেসাতি’ তখন আমি তাঁকে একজন সম্ভাবনাময়ী কবিই ধরে নেই। তিনি যখন বলেন ‘চৈতন্যে ডাক শুনি’ এবং ‘আমি ফিরে যেতে চাই একাত্তরের ভয়াল দিনগুলিতে’ অথবা ‘জীবন মানে কি? জীবন বিমূর্ত বাস্তবতা...অতন্দ্র সৈনিক...জীবন মানে ক্ষয়িষ্ণু সিগারেট’ তখন আমি ভাবি, চলা বন্ধ না করলে এ কবি একটি গন্তব্যে নিশ্চয়ই যেতে পারবেন। তিনি স্বাধীনতার সংজ্ঞা এঁকে বেড়ান এভাবে: ‘স্বাধীনতা, বাঁচার মতো বেঁচে থাকা। তাই বলে অবাধ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিম্বা নীল দিগন্তে শঙ্খের এলোমেলো উড়ে চলা অথবা চড়ুইপাখির মতো কিচিরমিচির নয়।’ লিখেন: ‘আমার কলম জানে না কোনো সন্ধি, আমার কবিতা হবে না কোনোদিন বন্দী’। আবার লিখেন, ‘মা বলেছিলেন, আদর্শবান হও। কিন্তু দাওনি তুমি আদর্শের সংজ্ঞা’... ইত্যাদি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আজ একটি কথা বলি: আমার মা একটি পাখিকে ভীষণই ভয় করেন। সে পাখিকে আমাদের এলাকার লোকেরা বলে ‘যমকুলি’। এ পাখির ডাক মধ্যরাতে শুনলে আমিও কখনো কখনো ভয় পেয়ে যাই। আমাদের শৈশব এ পাখির ডাকের সঙ্গে নিবিষ্টভাবে জড়িত। বলা যায়, আমার মায়ের পুরোটা জীবনই এ পাখি নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই এ পাখি নিয়ে আমিও একটি কবিতা লিখেছি।
‘যমকুলি’
ঈশ্বরে বিশ্বাসে না করেও
কেন আমি ‘যমকুলি’ পাখির ডাকে
আতঙ্ক অনুভব করি,
আমার জানা নেই।
শৈশবের এক সন্ধ্যায় আমি
গুলতি হাতে এক ‘যমকুলি’কে
শিকার করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তামাটে পাখার সেই পাখিই বরং
আমাকে শিকার করতে
নিয়ে যাচ্ছিল ঝাড়ু মিয়ার ঘন জঙ্গলে।
তারপর কোনো রকমে
প্রাণপণে ফিরে আসি আমি।
বুঝতে পারি,
এ কোনো সহজ পাখি নয়।
কিন্তু শহরে এ পাখি
এলো কোথা থেকে!
আমি যেদিকে যাই
নিশ্চিত সে পাখিও যায়।
এ কি আমার মায়ের কাছ থেকে
প্রাপ্ত বিশ্বাস?
নাকি কুসংস্কার কোনো!
আমার তো মনে হয়
বাংলাদেশে ডাকলে এ পাখি
আটলান্টিকের ওপার থেকেও
শোনা যায় সে ডাক।
পর্তুগীজ নাবিক
ভাস্কো দা গামা কি কখনো
এই পাখির ডাক শুনেছিলেন?
মনে হয় না।
গাছের মগডালে বসে
পাতার আচ্ছাদনে লুকিয়ে থেকে
কী ভয়ঙ্কর ডাক দেয় এই পাখি
সেই ভয়
চন্দ্রবোড়ার বিষের চেয়ে
মোটেও কম নয়।
সমানই বিপজ্জনক।
আলবাট্রস পাখির গল্প একদা
মন দিয়ে পড়েছিলাম।
মনে হয় আলবাট্রস পাখিও
এই ‘যমকুলি’র ডাক শুনলে
ভয় পেয়ে যাবে।
কেননা বাংলাদেশে মধ্যরাতে ডাকলে এ পাখি
মাদাগাস্কার দ্বীপ থেকেও
শোনা যায় সে ডাক।
অতি সাধারণ কবিতা আমার। যদি আমি হতে পারতাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিধর কোনো কবির চিরসবুজ উত্তরসূরী, তাহলে হয়তো এ পাখিকে নিয়ে দারুণ এক কবিতা লিখতে পারতাম।
যে আলোচনা করছিলাম: অখ্যাত কবিদের কবিতা নিয়ে...।
তবে কবি মোখলেছুর রহমানের কবিতার চেয়ে আমার মন অধিক কেড়েছে কবি ফজল মোবারকের কবিতা। তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদও চমৎকার।
‘গাছ সরে না বিশ্বাসের পথ থেকে, মানুষ সরে যায়।’ এ কথা আর কে বলতে পারেন কবি ফজল মোবারককে ছাড়া?
অসাধারণ কবি। এমনভাবে কবিতায় দর্শন যিনি প্রচার করতে পারেন, তিনি আমাদের কবি ফজল মোবারকই। তিনি যখন বলেন, ‘বরং অনিকেত স্বাধীন শৃগাল এবং পর্যটক কাক, মানুষের চেয়ে সুখে আছে’ আমি এই কাব্যোক্তি পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই।
তিনি আরও বলেন, ‘আজন্ম ক্ষুধা খেয়ে খেয়ে খাবার পিপাসা গেছি ভুলে।’ অথবা ‘প্রেমহীন স্বামী এবং স্বামীহারা প্রেম জন্ম দেয় একালের যীশু, আকস্মিক বিদ্যুৎ বিভ্রাটে।’ আমি তখন বুঝি এই কবির সম্ভাবনা গভীরতর, প্রবলতর।
‘অন্ধকারের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে প্রদীপ কেবল নিজেকে নিঃশেষ করে নিজেই।’ অথবা ‘গ্রাম গিলে বেঁচে থাকে শহর।’ আমি তাঁর এমন সব কবিতার রস আস্বাদন করতে পারি অকাতরেই।
ফজল মোবারক কবি হিসেবে আমার মতো একনিষ্ঠ কাব্যচষা কবিতার পাঠককে কোনোভাবেই বঞ্চিত করেন না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এমন অখ্যাত কবিদের আমার পক্ষ থেকে শক্তপোক্ত ও ইষ্টিকুটুম অভিনন্দন। একজন নিশিজাগা মানুষ আমি, তবে দিনের আলোর মতো তাঁর এবং তাদের মতো সকল অখ্যাত কবিদের সাফল্য কামনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৬