somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ গল্প কিন্তু গল্প নয়

১৫ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
নভেম্বর মাসের রোদটা পিঠে লাগতেই কেমন যেন ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ অনুভূতি। শরীরে ঘামটা থাকলে ভালোই লাগে, তা একটা দেয়ালের মতোই রোদ ঠেকায়। কিন্তু, ধানের ভারি বোঝাটা মাথায় চাপতেই কেমন যেন দম্ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার। তবু উপায় নেই, কাজটা করতেই হবে যে কোন উপায়েই হোক অন্তঃত তিন দিন; তাতে তিন চল্লিশে একশত বিশ টাকা উপার্জন হবে তার। বন্ধুদের কাছে শুনেছে শহরে দু’তিন রাত কাটাতে হলে কমপক্ষে একশত টাকা লাগবেই। এই প্রথম একা শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে, যে কোন উপায়েই হোক টাকাটা আয় করতেই হবে তাকে।

ওর বয়সী আরও যে দু’জন কাজ করছে তারা ওর চাইতে অনেক বেশি সক্ষম, ওরা প্রায়ই এ কাজ করে থাকে। ধান কাটা, বীজতলা তৈরি, হালচাষ করা, ধানের চারা রোপন সবগুলো সেও পারে; কিন্তু দিনমজুরী তার জীবনে এই প্রথম। তার দিনমজুর বাবার কষ্টটা এখন একটু একটু বুঝতে পারে সে। বাবাকে বাড়িতে বসে থাকতে তারা দেখে না বললেই চলে। প্রায় সময়ই ওরা ছয় ভাই-বোন ঘুম থেকে উঠার আগেই বাবা কাজে চলে যায়, আরও ভোরে উঠলে দেখে বাবা বাড়ি ফিরে আসছে; এক হাতে মাছ ধরার জাল, অন্য হাতে ডুলা (মাছ রাখার ঝুড়ি) ভর্তি মাছ। অল্প ক’টা মুড়ি বা কখনো খই মুখে দিয়ে পানি খেয়ে দা কিংবা কাস্তে যখন যা লাগে হাতে নিয়ে গামছাটা কাঁধে ফেলে কাজের জন্য দৌড় লাগায় বাবা। মা ওদের সব ভাই-বোনকে গোল করে বসিয়ে দিয়ে একটা করে লবনমাখানো পান্তা ভাতের বাটি ধরিয়ে দেয়, খুব ভাগ্য ভালো হলে কখনো সাথে জোটে পোড়া শুকনো মরিচ; তাও খেতে হয় ভাগ করে। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে এসে বাবা আবার লেগে যায় কাজে; কখনো জাল বোনা, কখনো বাঁশের খাঁচা, ঝুড়ি, কুলা বা চালনি তৈরি, আবার কখনো পাটি বানানোর জন্য মাকে বেত তুলে দেয়া - আরো কত কিছু। একটা না একটা কিছু করছেই, কত রাত পযর্ন্ত তা টের পাওয়ার আগেই শুতে চলে যায় তারা।

'অই, হা গরি কী চদ্দে, এঁইক্কা আয়, এইবা লই যা’ তাকে আনমনা দেখে ধমক দিয়ে ধানের বোঝা নেয়ার জন্য ডাক দেয় কানু কাকা, শুনে মন খারাপ হয়ে যায় তার। বড় করেই ধানের আঁটিটা বাঁধেন উনি, নিতে অনেক কষ্ট হয় তার। দূর থেকে আশু কাকা বিষয়টা খেয়াল করে, কিন্তু বড় ভাইকে কিছু বলার সাহস পায় না। ১১/১২ বছর বয়সের ছোট ছোট ছেলে, এত বড় বোঝা নিতে কষ্টই হয় তাদের, তাই নিজে একটু ছোট করেই বাঁধে বোঝাগুলো, যদিও এজন্য ভাইয়ের বকা শুনতে হয় তাকে, 'দিনে ৪০ ট্যাঁয়া মজুরি লইবু, এত অস্তা ন!'

প্রথম দিনটা ধান কাটতেই গেছে তাদের, তাই খুব বেশি গায়ে লাগেনি; কিন্তু আজ টের পাচ্ছে কষ্টটা। বিকেলের দিকে কেমন যেন শরীরটা ব্যথা ব্যথা হয়ে আসে তার; যে কোনভাবেই হোক আগামীকালও কাজ করতেই হবে তাকে। তিনটি দিন কাজ করতে পারলেই ১২০ টাকা পাবে সে। তা নিয়ে আসছে শুক্রবার বিকেলে চলে যাবে চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়টা খুঁজে নেবে; তার আশেপাশে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারলেই হয়ে যায়, কোন রকমে তিনটি রাত কাটালেই খেয়ে হোক না খেয়ে হোক বৃত্তি পরীক্ষাটা দিয়ে আসতে পারবে, প্রথম দু’দিন সকাল-বিকাল দু’টা করে পরীক্ষা, শেষ দিন একটা। বাবার কাছ থেকে টাকা পয়সা পাবার কোন সম্ভাবনা দেখে না সে। বাবাকে পরীক্ষা আর টাকা-পয়সার কথা বলতেই খুব ক্ষেপে গিয়েছিল ‘পরীক্ষা দন্ ন পরিব, আঁত্তে এহন ট্যাঁয়া-পইসা নাই। আঁই এক ট্যাঁয়াও দিত ন পাইয্যুম’ একটা টাকাও দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়| ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। বড় ভাইটা শহরে থাকে, কোন্ এক আলকাতরা কোম্পানিতে কাজ করে; সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে। তার খুব মন খরাপ হয় এ সপ্তাহে তার বড় ভাই বাড়ি আসেনি তাই, কোন খবরও নাই। তাই যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করে একা হলেও পরীক্ষা দিতে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তার ভাইয়ের উৎসাহেই সে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সাহস করেছিল, স্কুলের স্যাররাও খুব করে বলছিল ‘তুই মেধাবী পোয়া, পরীক্ষা দিলেই বিত্তি পাবি’। এখন বুঝতে পারে কী ভুলই না ছিল সিদ্ধান্তটা; দু’বেলা দু’মুটো খাবার জুটে না ঠিকমতো, শহরে গিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার শখ!

পরদিন সকালটায় মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার; বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে টের পায় হাত-পা ব্যথা হয়ে আছে প্রচন্ড, সারা শরীরে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। রাতেই জ্বর এসেছে তার। পাটির বিছানা ছেড়ে মাটিতে কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে সে; গড়াগড়ি করে নিজেকে একটু ঠান্ডা করার চেষ্টা করে উঠে পড়ে ‘আজিয়া কামত ন যাইচ্, পড়ি ল’, কাজে না গিয়ে পড়ে নিতে বলে তাকে তার মা। মায়ের কথা কানে তুলে না সে। বেড়ার পাশে দড়িতে ঝুলে থাকা তার খুব পছন্দের গেঞ্জিটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে। গেঞ্জিটা খুব টাইট হয় আজকাল, তবু পরতে ভাল লাগে; তার এক চাচাতো ভাই প্রায় বছর দুয়েক পরার পর তার গায়ে আঁটোসাঁটো হওয়ায় পরতে দিয়েছিল তাকে। ‘অই যা, তোত্তে কাম গরন পইত্তু না, আটটা বাজের, রাজার পোয়া অফিস গইরত আইস্যেদে’, দেরি করে আসাতে রাজপুত্তর বলে গালি দেয়, কাজ করতে হবে না জানিয়ে খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে থাকে কানু কাকা। ‘কিরে ধান লইত পারিবি না?’, জানতে চায় আশু কাকা। ‘জ্বর আইস্যে’ বলতেই হাত দিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেখে তাকে বারান্দা থেকে পিঁড়িটা নিয়ে এসে বসতে বলে নিজে মেশিনে উঠে পড়ে। ধান মাড়াইয়ের মেশিনটা ঘোঁ ঘোঁ আওয়াজ তুলতে থাকে। আশু কাকা আর কানু কাকা পা দিয়ে মেশিন চালায় আর ধান মাড়াই করতে থাকে, ওরা দু’জন দুই দিক থেকে মুঠো মুঠো করে ধানের গোছা এগিয়ে দিতে থাকে।

বিকেল গড়াতেই আশু কাকা তাকে ছেড়ে দেয়, কাজ থেকে চলে যেতে বলে জ্বর বেশি আসাতে। সে দ্বিধায় পড়ে বুঝে উঠতে পারে না কী করা উচিত। একদিকে ভয় হয়, যদি টাকা কম দেয়, অন্যদিকে দুঃশ্চিন্তা বাড়ে তার এরকম জ্বর থাকলে পরীক্ষা দেয়ার জন্য শহরে যেতে পারবে কিনা। হাড়কাঁপুনি জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে তার মায়ের পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। ঠান্ডায় থাকতে না পেরে উঠে মাছা থেকে একটা পুরনো ছেঁড়া কাঁথা নামিয়ে নেয়; খুব ইচ্ছে হয় মাকে ডাকে, পাছে ভয় হয় মা নিশ্চয় বকা দেবে, এমনকি মারও জুটতে পারে কপালে।

২.
জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ছুটে গেলে সে দেখতে পায় তার মুখের উপর মায়ের মুখটি ঝুঁকে আছে, তাতে একরাশ উদ্বেগ আর রাতজাগা ক্লান্তি; পাশে পাটিতে বসে তার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। কেরোসিনের হ্যারিকেনটি টিমটিম করে জ্বলছে। ‘কিছু ন খাবি, ভোগ ন লাগে’? কিছু খাবে কিনা জানতে চায় তার মা। ‘নাহ্, ভালা ন লাগের, আঁর গাল তিতা অই গ্যাইয়ে’, তার মুখ তেতো হয়ে গেছে বলে ভালো লাগছে না বলে জানিয়ে পাশ ফিরে শোয় সে। ওপাশের বাঁশের বেড়ার মাঝামাঝিতে তার মায়ের হাতের পাখার নাচন হ্যারিকেন-এর আলোর সাথে লুকোচুরি খেলছে। জলপট্টি দেয়ার জন্য তার মা তাকে আবার চিৎ করে শুইয়ে দেয়। ‘অ মা, আঁই পরীক্ষা দিত ন পাইয্যুম?’, পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা জানতে চায় সে। ‘আগে ভালা অ, তারপর দেখা যাইবু, কনে কইয়্যাদে তোরে কাম গইরত যাইতু, অ্যাঁ’, কাজে যাওয়ার জন্য মা তাকে বকা দিতে থাকে। মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসে তার দু’চোখ জুড়ে।

ঘামে ভেজা গেঞ্জি আর কাঁথার ঠান্ডা স্পর্শে তার ঘুম ভেঙে যায় পরদিন সকালটায়। জ্বরটা ছেড়ে গেছে, তবু কাতর হয়ে মাকে ডাকতে থাকে সে, ‘অ মা, আঁত্তে পেডর ভোগ লাইগ্যে’, ক্ষুধা লেগেছে বলে জানায়। ‘সবুর গর’ রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয় মা। একটু পরেই এক বাটি মুড়ি আর দু’টা বেলা বিস্কুট নিয়ে আসে তার মা। মুড়ি ক’টা মুখে দিতেই তেতো ভাবটা টের পায় সে, বাটিটা রেখে দেয় ‘আর কিছু থাগিলে দ না’, আর কিছু আছে কিনা জানতে চায় সে; যদিও জানে তার সম্ভাবনা খুব কম; ভাত-তরকারি ছাড়া জোটে ঐ মুড়ি আর বড়জোর বেলা বিস্কুট। ‘বাটার বন খাবি না?’ ‘কনে আইন্যেদে’ কে এনেছে জানতে চায় সে। ‘তোর বদ্দা (বড় ভাই)’, শুনে লাফ দেয় সে। খুশিতে চোখ-মুখ ভরে উঠে তার, লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। তার ভাইটি চলে এসেছে, তাহলে তার শহরে যাওয়ার আর কোনো চিন্তা নেই। তার পরীক্ষা দেয়াটা নিশ্চিত। বাটার মাখানো বানটা মুখে দিতেই তার আন্ন্দ বহুগুণ বেড়ে যায়; কতদিন পরপর জোটে এ অমৃত!

৩.
একটা পলিথিনের শক্ত ঠোঙা চেয়ে নিয়েছিল সে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে, ওর চাচা বিদেশে থাকে, উনি পাঠান মাঝে মাঝে মাল-পত্তরের সাথে। তাতে তার বই-খাতা-কলম সব, সাথে একটা হাফ প্যান্ট আর একটা ছিটে পরা হাফ শার্ট ভরে নেয় সে। এক হাতে পলিথিনের সেই ঠোঙাটি, অন্য হাতে বড় ভাইয়ের হাত ধরে বিকেলে রওনা দেয় শহরের উদ্দেশে। বাড়ি থেকে প্রায় মাইলখানেক পথ হাঁটলে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক। তারপর মূল রাস্তা হয়ে আরও কোয়ার্টার মাইল পশ্চিমে গিয়ে ব্রাম্মণ হাট থেকে শহরগামী বাস ধরতে হয় তাদের।

যথারীতি বিস্ময় নিয়ে সে বাস থেকে দেখতে তাকে আশপাশ। নোয়াপাড়া পথের হাট, কর্ণফুলী নদীর উপর মদুনাঘাট স্টেশন, কাপ্তাই রাস্তার মাথা একে একে পেরিয়ে বহদ্দারহাট এসে বাস থেকে নেমে কালুরঘাট বাস সার্ভিস-এর আরেকটি গাড়িতে চড়ে এসে ওরা নামে টেরিবাজার মোড়ে। এদিকেই কোথাও থাকার ব্যবস্থা হবে তার, কেননা এখান থেকেই স্কুলটা কাছে হয়।

‘আয়, এক জোড়া জোতা চাই’ রাস্তা পার হয়ে ওপারে হাজারি লেইনের মুখে তার ভাই টেনে নেয় একটি জুতার দোকানের দিকে। লাল-সাদা রঙের সুন্দর সাইনবোর্ডের বিশাল দোকানটি তাকে মোহিত করে; কাঁচের তাকে সুন্দর সুন্দর জুতা আর স্যান্ডেলের সারি দেখে হা হয়ে যায সে; দু’ ফিতেওয়ালা স্যান্ডেল ছাড়া আর কিছু দেখার সুযোগ খুব কমই হয় তার। তাদের ঘরে শুধু বাবারই এক জোড়া প্লাস্টিকের জুতো রয়েছে। খুব কালেভদ্রে মা কাঠের মাচা থেকে পলিথিন খুলে নামিয়ে দেয়, খুব দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হলে। পাঞ্জাবির মতো করে বানানো সাদা হাফ শাটর্টা কাঁধে ফেলে দিয়ে জুতো জোড়া হাতে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে রওনা দিত ওরা। আত্নীয় বাড়ির খুব কাছাকাছি কোথাও পৌঁছে কোন পুকুর বা ডোবার পানিতে পা ধুয়ে জুতোটা পায়ে গলিয়ে শাটর্টা পরে নিত বাবা। তার ভাই একটি একটি করে জুতার দাম জিজ্ঞেস করে আর দাম শুনে কেমন যেন বিপন্নতায় তার দিকে তাকায়। নীল আর সাদা রঙের কাপড়ে তৈরি খুব কম দামি এক জোড়া জুতা পেয়ে যায় তারা অবশেষে, মাঝখানে জিহ্বার মতো লম্বা একটা অংশ; তার উভয় পাশে প্রতিটিতে পাঁচটা করে মোট দশটা ফুটো, তাতে সুন্দর সাদা রঙের ফিতে গলানো। তার পায়ের মাপমতো জুতসই এক জোড়া পায়ে গলিয়ে দিয়ে একটু হেঁটে দেখতে বলে দোকানি, কেমন যেন একটু অস্বস্তি হয় তার, লজ্জ্বা ঘিরে ধরে তাকে জুতো পায়ে হাঁটছে বলে। ‘হাফ প্যানর অঙ্গে পরিবু তো, মৌজা লাগিবু, নইলে ভালা লাইগদু ন’, হাফ প্যান্টের সাথে মোজা আর জুতার দরদাম করতে করতে চুলের ফাঁক বেয়ে ঘাম নেমে আসে তার বড় ভাইয়ের।

হাতের পলিথিনের মুখটা খুলে বই-খাতার ফাঁক হাতড়ে সে টাকা খুঁজতে থাকে, বাংলা বইটার আটার-ঊনিশ পৃষ্টার ফাঁকে টাকাটা রেখেছিল সে। ‘কী অইয়েদে, কী তোয়দ্দে?’ কী খুঁজছে জানতে চায় তার বড় ভাই। ‘আঁত্তে ট্যাঁয়া আছে’, তার কাছে টাকা আছে বলে জানায় সে| ‘তোত্তে ট্যাঁয়া (তোর কাছে টাকা)’ ‘অ, একশ বিশ ট্যাঁয়া আছে’, তার কাছে একশ বিশ টাকা আছে বলে জানায় এবং দু’টা পঞ্চাশ টাকার নোট, একটা দশ টাকা আর দু’টা পাঁচ টাকার নোট বের করে দেয় ‘ট্যাঁয়া কডে পাইয়্যুযে তুই?’ টাকা কোথায় পেয়েছে শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে তার বড় ভাই। ছোট ভাইটাকে বকাঝকা করবে ভেবে দিনমজুরীর কথাটা বাড়িতে কেউ জানায়নি তাকে। পরম আদরে ছোট ভাইটিকে বুকে টেনে নেয় সে। দু’জনেরই চোখের কোনায় চিকচিক করতে থাকে নোনাজল; কেউ কারোরটা টের পায় না।

৪.
হাজারি লেইনের ছোট্ট একটা ঔষধ ঘরের সামনে একটা টুলে বসিয়ে রেখে বড় ভাইটি সে লোকটাকে খুঁজতে যায়, যার বাসায় তাদের রাত কাটানোর কথা। এক হাতে বইয়ের পলিথিন, অন্য হাতে জুতার থলেটা নিয়ে চারদিকে অসংখ্য লোকজনের আনাগোনা আর রিকশার টুংটাং শব্দে ডুবে যায় সে। ‘মানুস্যা ত বাসাত নাই, এহন কী গরি’, লোকটা বাসায় নেই বলে জানায় তার বড় ভাই। ‘আর কনমিক্যা থাগন ন যাইবু, মামার বাসাত গেইলে কেন অয়?’ আর কোথাও থাকা যায় কিনা জানতে চায় সে, জানতে চায় মামার বাসায় গেলে কেমন হয়। নিকটেই কোথাও তার মামার বাসা সে বুঝতে পারে, যদিও ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না। ‘মামার বাসাত থাগিত পাইরলে কি আর এঁইক্যা অঁইক্যা ঘুইত্তাম না, মামারার মত পইসাঅলা অইলে বাসাত জাগা অইত দে এরি; বড় অ বুঝিবি’, মামার বাসায় থাকতে পারলে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করতে হত না বলে জানায় তার বড় ভাই; বলে মামাদের মত বড় লোক হলেই কেবল সেখানে থাকার সুযোগ হত। বড় ভাইয়ের কন্ঠে হতাশা না ক্রোধ কোনটা বেশি বুঝে উঠতে সময় লাগে তার। যদিও সে বলছে, তারও ভয় হয় মামির কথা মনে পড়ে তার ‘অই, উগ্যা ভাতঅ যেন নিচে ন পড়ে, মইলা অইলে পিট ফাডাই ফেলাইয়ুম (এই, একটা ভাতও যেন নিচে না পড়ে, ময়লা হলে পিট ফাটিয়ে ফেলব)’ তার মামি চিৎকার করে বলছিল ডাইনিং টেবিল থেকে, পাশে মামা আর তার মামাতো বোনরা বসে খাচ্ছিল সবাই, তাকে নিচে মেঝেতে খেতে দেয়া হয়েছিল ডাইনিং টেবিল নোংরা হবে এইজন্যে।

৫.
‘আয়, নাম’ বহুতলা কলোনির গেটে এসে রিকশাটা থামে। তাদের দূরসম্পর্কীয় এক কাকার বাসা এখানে, যদি থাকা যায় সেই ভরসায় চলে আসা। ‘এইতারাতো মানুষ ভালা, চাই থাগন যাইব অয়ত’ এরা ভালো মানুষ এবং থাকতে দেয়ার সম্ভাবনা আছে বলে তাকে আশ্বস্ত করতে থাকে তার ভাই। দু’পাশে সারি সারি সমান সাইজের, একই রঙের বিল্ডিং, মাঝে বেশ বড়সড় রাস্তা আর দু’পাশে খেলার মাঠ। এজন্যই বোধহয় এই নাম জায়গাটার, ইস্, এখানে যদি থাকতে পারতাম, ভাবে সে। দরজার কলিং বেল বাজতেই তার বুকটা দুরুদুরু করতে শুরু করে, এক ধরণের আড়ষ্টতা ভিড় করে তার মনে, কি জানি ওরা কেমন হয়।

‘কেন আছন, কাকিমা (কেমন আছেন কাকিমা)’ দরজার পেছনে একটা মুখ উঁকি দিতেই তার ভাই সামনে ঝুঁকে পড়ে প্রণাম করে। ‘আছি বাজি, ভালা আছি, তোঁয়ারা কেন আছ? আইয়ু, ভিতরে আইয়ু, ওমা, পিছদি এইবা কন’ কুশল বিনিময় করে খুশিমনে ওদেরকে ভেতরে আহ্বান জানায় আর গ্রামের লোকজন পেয়ে একনাগাড়ে কথা বলতে থাকে কাকিমা। সব শুনে খুশি হন তিনি, যতদিন প্রয়োজন হয়, থাকতে বলেন, কোন অসুবিধে নেই। চাচাতো চার ভাই-বোনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা তার জন্য একটা পড়ার টেবিল খালি করে দেয়, তাতেও তার অস্বস্তি হয় খুব, সে তো সবসময় হয় মাটি নয় পিঁড়ি বা পাটিতে বসে লেখাপড়া করে। ‘এ দু’ তিন দিন তোমাদের দাদাকে কেউ বিরক্ত করবে না, দাদার পরীক্ষা আছে’ সবাইকে বলে দেয় কাকিমা। কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয় তার; গরীবের ঘরে বেড়ে ওঠা; আত্নীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন মানেই তো অনাদর আর অবহেলা, শুধু অবজ্ঞা আর উপেক্ষারই স্মৃতি সব; এমনকি মামার বাসায়ও যেখানে জায়গা হয় না ওদের। এখানে কেমন যেন একটু খাপছাড়া মনে হয় তার। রাত্রে তার ভাই বেরিয়ে গেলে আরও অস্বস্তি তাকে ক্রমাগত কাবু করতে থাকে। সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে চাচাতো ভাইদের সাথে শুতে গিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অসহায় মনে হয় তার; দু’হাত তুলে বগলের গন্ধ শুঁকে দেখে বেশি লাগছে কিনা, চাচাতো ভাইরা টের পাবে না তো। কোনরকমে রাত্রে সে শুয়ে পড়ে তাদের পাশে, সংকোচের দূরত্ব রেখে গুটিশুটি পায়ে। কথাবার্তাও বলে খুব সাবধানে, সবাই সাধু ভাষায় কথা বলে ওরা এখানে।

৬.
সকালবেলার গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের প্লেটটা সামনে আসতেই ক্ষুধাটা তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মনে পড়ে কাল রাতে পেট ভরে খাওয়া হয়নি, সংকোচ আর বিহ্বলতায়। একটু পরেই কাকিমা গরম ভাপ আর ঘ্রাণ ছড়ানো একটা ভাজা ডিম এনে দেয় তার প্লেটের উপর; সাথে কুচিকুচি করে কাটা ভাজা আলুর টুকরা। কী সৌভাগ্য তার! কালেভদ্রে একটা ডিমের টুকরো কপালে জোটে তাদের, তাও যদি বাড়িতে কখনো কোন মেহমান বেড়াতে আসে তার সুবাদে। আজ আস্ত একটা ডিম, তা আবার পান্তা না; গরম গরম ভাত!

‘কাকিমা, এখন ক’টা বাজে?’ খেয়ে উঠে জানতে চায় সে, তৈরি হতে হবে স্কুলে যাওয়ার জন্য। ‘এখনো দেরি আছে, তুমি পড়ে নাও কিছুক্ষণ, আমি বলব সময় হলে’ বলে কাকিমা। সে বই নিয়ে বসে পড়ে; কিন্তু পড়ায় কেন যেন মন বসে না তার, খুব করে বাড়ির কথা মনে পড়ে, মা কি একবারও ভাবছে কত আরামে আছে তার ছেলেটা। বোনের চেহারাটা ভাসে, নিশ্চয়ই মুড়ির বাটি নিয়ে বসে আছে সে। বাবা হয়তো কাজে বেরিয়ে গেছে। আচ্ছা, আজ বাবার জন্য কাজে পান্তা ভাত নিয়ে যাবে কে, সেইতো এ কাজটা করে সবসময়, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে সে! বাড়ি থেকে আসার আগে একবারও ভাবেনি বিষয়টা।

‘বাবু, এবার রেডি হয়ে নাও আস্তে আস্তে, তোমার দাদা আসলেই রওনা দিয়ে দেবে’, কাকিমা হাঁক দেয়, সে কলম, প্রবেশ পত্র গুছিয়ে নেয়, রোল নম্বরটা ভালো করে দেখে নেয়। পলিথিন থেকে কাপড় বের করে সাদা সেই চিটে পড়া শাটর্টা গায়ে দেয়, পরণে হাফ প্যান্ট। আরও যারা একসাথে স্কুলে যায়, সবাই কম-বেশি একই রকম কাপড় পরে ওরা, আজ এখানে কেমন যেন খুব বেমানান মনে হয় তার নিজেকে। ‘কই, রেডি হচ্ছো?’ কাকিমা হাঁক দেয় রান্নাঘর থেকে। জুতো জোড়া প্যাকেট থেকে বের সে থমকে যায়, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। তার ভাইটা যে এখনো কেন আসছে না, খুব বিরক্ত লাগে তার! সে আসলে না হয় কিছু একটা হত। ‘তোমার দাদা তো এখনো আসছে না, দেরি হয়ে যাবে তো’ কাকিমার গলার আওয়াজ শুনে সে একটা বই টেনে নেয়, তাতে চোখ বুলানোর ভান করে, যেন উনি বুঝে উঠতে না পারেন। ‘ওমা, তুমি এখনো পড়ছো, রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি, কই দেখি, শাটর্টা ইন করে দাও’, বলে তার শাটর্টা ইন করে দেয়। ‘জুতো পরে নাও তাড়াতাড়ি’ বলে আবার রান্নাঘরে ছুট লাগায়। তার খুব অস্বস্তি হতে থাকে, এখন কী হবে, দাদাটা যে এখনো কেন আসছে না! আর একটু হলেই সে ধরা পড়ে যাবে! এরা সবাই বুঝে যাবে যে এই তার জীবনে প্রথম জুতোজোড়া, কিভাবে পরতে হয় তা সে জানে না, জানে না কিভাবে ফিতে লাগাতে হয়!

‘আহারে, তুমি তো দেখছি দেরি করে ফেলবে, জুতো পরোনি এখনো, কই এদিকে আসে, জুতো নাও, নাও পরে নাও’ বলে তাকে ছোট্ট একটা টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটু ভেঙে মেঝের উপর তার সামনে বসে পড়ে আর ডান পা টেনে নেয় কোলের উপর। আকস্মিক বিস্ময় আর আড়ষ্টতায় সে পা সরিয়ে নেয় চট্ করে। ‘দাও, দাও, কাকিমা পরিয়ে দেই’, বলে আবার পা দু’টো টেনে নেয় কাকিমা। সে কি ধরা পড়ে গেল! কাকিমা দু’পায়ে মোজা পরিয়ে দিয়ে তার পায়ে জুতো পরাতে থাকে; যেন দেবীমূর্তি। তার বুকটা আচমকা মোচড় দিয়ে উঠে। টুলের দু’দিকে দু’টা হাত রেখে সে বসে থাকে নিশ্চল, আর অন্যদিকে তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে অবিরাম; সে অনেক চেষ্টা করে কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারে না। ‘ঠিক আছে, হয়ে গেছে’ জুতা পরানো শেষ করে তার দিকে চোখ তুলতেই অবাক হয় কাকিমা, ‘কী হয়েছে, কাঁদছো কেন তুমি? এ মা’ বলে বুকে টেনে নেয় তাকে। সে কিছুই বলতে পারে না, গলা আটকে আসে তার। তার সারা শরীরটা ভেতরে ভেতরে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মা আর বোনরা ছাড়া কাউকে তো কাছেই ঘেঁষতে দেখেনি কখনো। এ কি অদ্ভূত এক মায়া, এভাবে কেউ এতো স্নেহ করতে পারে! একি স্বপ্ন যে একটি নারী পরম মমতায় তার পা কোলে টেনে নিচ্ছে। মা ছাড়া কেউ তো তার পায়ে হাত দেয়নি কখনো, কেউ দিতে পারে তা ভুলেও কল্পনা করেনি কখনো। তার মাও কি তাকে এভাবে মোজাটা পরিয়ে দিত! নিজেকে সামলাতে পারে না সে, বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠে তার, আর থমকে থমকে বেরিয়ে আসে কান্না। ‘অদ্ভূত ছেলে তো বাবা, কী হযেছে বলো তো’ বলে কাকিমা ঝাঁকুনি দিতে থাকে। এর মাঝেই সবকিছু ভেঙেচুরে দিয়ে জোর শব্দে বেজে উঠে কলিংবেলটা; ঐ বুঝি তার ভাইটা তাকে নিতে এলো।

আশীষ বড়ুয়া
০২.০৫.২০১৫
ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:৩৩
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×