১.
দীর্ঘ দিন, নাহ্, বলা যায় দীর্ঘ বছর পর কোন বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ানো। জীবনটা কেমন যেন থমকে গেছে – যানজট, ধোঁয়া, ধূলার আবর্তের প্রাণহীন এ ঢাকা শহরে। ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটা ছুঁতেই কেমন যেন অস্থিরতা শুরু হয় নিজের মধ্যে, কখন অফিস ছেড়ে বের হতে পারব। এদিক ওদিক কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না সে সময়ে, যখন প্রতিটা সেকেন্ডই মূল্যবান। একটা মিনিট দেরীর খেসারত ঘন্টায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে!
‘কী নিয়ে যাওয়া যায়’?
‘একটা কেক নাও, তুমি না বলছিলে ওর জন্মদিন ছিল’।
‘সে তো আজ না, সেদিন তো তোমার জন্য আসা হয়নি, তুমিই বাগড়া দিলে – আমিও যাব’।
‘শুধু জন্মদিনেই কেক নিয়ে যেতে হবে, এমনতো কোন কথা নেই, আজ নিয়ে গেলে সমস্যা কি’? রীতিমতো ধমক দিয়ে উঠল ও, আমার স্ত্রী।
আবুল হোটেলের সামনে রিকশা থেকে নেমে একটু সামনেই সুমী’জ হট কেক থেকে একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে নিজেই দামটা মিটিয়ে দিয়ে প্যাকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দেয় সে, ‘নাও, এবার হাঁটো’। সময়ে অসময়েই এসবের মুখোমুখি হতে হয় আমার। কারণ, বাইরে কোথাও যাবার ক্ষেত্রে বাধা দিই আমিই বেশি, ও যেখানে এক পা বাড়িয়েই থাকে সবসময়।
২.
‘কয় তলায় বাসা তোর’?
‘তিন তলায়’।
‘দরজা খোল্’, মোবাইলটা কান থেকে নামাতে না নামাতেই দরজাটা খুলে যায়। অনলাইন বন্ধুত্বের জোয়ারে ভাসা আজকের এ সময়ে আমরা একজনের পা, পাছায় মাথা রেখে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটানো বন্ধুরা ক্রমাগত দূরে সরতে সরতে কোথায় গিয়ে ঠেকেছি তাই ভাবি – অবাকই লাগে যে আমি ওর বাসা চিনি না আজ!
একটু সময় যেতেই ডুবে যাই বিগত আড্ডা, বিগত ঠাট্টায় পশ্চিম চৌধুরীপাড়ার কানাগলির এ বাসাটায়। আমাদের হাসি, খোঁচাখুঁচি, গল্প জমে গেল সেই পুরনো দিনগুলোর মতোই, সেই পুরনো আবেশে – এর তোড় সইতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে হল বেচারার অসুস্থ বউটাকেও। বিশ্বজিৎ থেকে অভিজিৎ হত্যাকান্ড হয়ে সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রীত্ব, প্রফেসর সৈয়দ জামাল নজরুল ইসলাম থেকে শুরু হয়ে ডিসি হিলের নজরুল চত্বর ঘুরে একসময় নিজেদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ঠেসে যেতে থাকি ক্রমাগত, টের পাই কেমন যেন ছোট হয়ে গেছে আমাদের পৃথিবী। নিজেদের সংসার, চাকরি-বাকরিতে ঠেকে আমরা হাঁসফাঁস করতে থাকি।
৩.
ওর মিটিমিটি হাসিটা দেখেই আমি বুঝলাম ওর কিছু একটা মনে পড়েছে। চাকরি জীবন, তার মাঝে মাঝে মৌসুমী বেকারত্ব - এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল আমাদের। ‘তুই হাসছিস কী জন্য, বলতো’? বলতেই যেন আরো ফেটে পড়ল কায়সার, আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ‘নিশ্চয়ই সেই ইন্টারভিউয়ের কথা মনে করে?’ ও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল প্রায়। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউয়ের দিনটা আমারও মনে পড়ে; খুব স্পষ্ট। আরো মনে পড়ে যখন কোন চাকরির জন্য দরখাস্ত লিখতে বসি অথবা পরীক্ষা দিতে যাই।
জে. এম. সেন হল মোড়ের ঠিক উল্টো দিকে কথাকলি লাইব্রেরির গলিটা আজো চোখের সামনে ভাসে। সরু গলির খাড়া আর অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে কেমন যেন ঘামতে শুরু করি আমি, বুকটা ধুরুধুরু কাঁপছে। কী জানি কী জিজ্ঞেস করে, ঠিকমতো বলতে পারব কিনা, চাকরিটা হবে কি হবে না এ ভাবনাতেই সব গুলিয়ে যাচ্ছিল আমার। ‘কী রে, কী অবস্থা তোর’, সাহস দেয়ার জন্য হাত বাড়ায় কায়সার। ওর সূত্র ধরেই এ চাকরিটার খবর পাওয়া। উকিলটার একজন সহকারী লাগবে, খবর নিয়ে আসে সে একদিন। কী কাজ তার কোন ধারণা নেই, তবু বললাম আমি করব, এ মূহুর্তে যে রকমই হোক একটা চাকরি খুব দরকার আমার। ‘একটা বায়োডাটা লাগবে’, বলতেই আমি অথৈ সাগরে পড়ি। আমার কোন ধারণাই নেই এটা কী বস্তু, কেমন এর চেহারা। বন্ধুরাই মিলে তা বানিয়ে দিল। আমাকে অনেক শিখাল, পড়াল, কী জিজ্ঞাসা করলে কী বলতে হবে, কীভাবে বললে চাকরিদাতা খুশি হবে। সিঁড়ি পেরিয়ে উকিলের রুমটায় পা রাখতে রাখতে আমি সব গুলিয়ে ফেলতে থাকি ক্রমাগত।
পুরনো একটা বেতের সোফায় বসে টেনেটুনে শার্টটা ঠিক করছিলাম বারবার, দেখছিলাম বোতাম, কলার সব ঠিকঠাক আছে কিনা; তখনো শার্ট ইন করে পরতে শিখিনি আমি। সামনের টেবিলের ওপারে আলমারিতে তাক জুড়ে বই আর ফাইলপত্তর, ওগুলোর দিকে তাকাই আমি আর ভাবি এগুলোরই বোধহয় কাজ করতে দেবে আমাকে। ‘কীরে টেনশন হচ্ছে তোর?’ জানতে চায় কায়সার। ‘নাহ্’ জোর গলায় বলে উঠি আমি, কিন্তু টের পাই আমার গলা শুকিয়ে আসছে। জিহ্বায় বারবার ঠোঁট চাটতে থাকি আমি।
৪.
পাজামা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটিকে দেখে যত না উকিল তার চাইতেও বেশি মনে হচ্ছিল মৌলভী বলে। সালাম দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর আমাকে ডেকে সামনের টেবিলটার এপারে চেয়ারে বসতে বললেন। টেবিলের ওপারে আমার ঠিক উল্টোদিকে চেয়ার টেনে বসে খুব নিবিষ্ট মনে উকিল সাহেব চোখ বোলাচ্ছিলেন আমার বায়োডাটা’র উপর। আর আমি বসে বসে ভাবছিলাম কোন প্রশ্নটা আসতে পারে।
‘তো চাকরি দরকার, হ্যাঁ’
‘জ্বি স্যার’
‘কী নাম’? অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বললেন উকিল সাহেব ‘দেখি, সংক্ষেপে একটু নিজের সম্পর্কে বলতো শুনি’।
আমি জন্ম থেকে শুরু করে পড়াশুনা পযর্ন্ত এগিয়ে গেলাম।
‘তোমার বাবা কী করে’? হঠাৎ করেই আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তিনি।
আমি একটু ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলাম এ প্রশ্ন শুনে। এ প্রশ্নটা আসতে পারে আমি ভাবিনি; বন্ধুসমেত প্রস্তুতিতেও কেউ এটা নিয়ে কথা বলেনি। থতমত খেয়ে বলে উঠেছিলাম ‘কিছুই করে না, স্যার, বাবা আপাতত বৃদ্ধ’; রুগ্ন, শয্যাশায়িত আমার পিতার চেহারাটা তখন ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। ‘আপাততঃ বৃদ্ধ মানে, আবার কি যৌবন ফিরে পাবে তোমার বাবা?’ আমি চমকে উঠলাম উকিল সাহেবের হাসির শব্দ শুনে। সত্যিই তো এ কী বললাম আমি, বিসমিল্লায় গলদ করলাম! পেছন থেকে আমার বন্ধু কায়সােরের হাসি ভেসে আসতে আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম লজ্জায়, অপমানে। উকিল সাহেব আরো কী যেন প্রশ্ন করে গেলেন, কী শুনেছি, কী উত্তর দিয়েছি নিজেই জানি না। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু উকিল সাহেব আর বন্ধুর হাসিটা। পরদিন থেকেই বন্ধুমহলে আমার নাম হয়ে গেল ‘আপাতত বৃদ্ধ’। যখনই কোন বন্ধুর মুখে শুনি, আমার মনে পড়ে সে দিনটার কথা, আর আমার বাবার সেই মুখখানা। এই একটা কারণেই সারাজীবন বাবাকে না ভুলে থাকার একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল আমার।
৫.
‘তুমি কেমন বোকা ছিলে, না?’ বলে হেসে উঠে আমার স্ত্রী, সে রাত্রে বিছানায় আমরা দু’জন; পাশাপাশি।
‘তার মানে’? আমি জানতে চাই।
‘তোমাকে বলল বাবা কী করে, আর তুমি বললে বাবা আপাতত বৃদ্ধ’!
সেদিনের সেই হাসিতে আমি অপমানিত বোধ করছিলাম, লজ্জ্বা হচ্ছিল আমার খুব। আজ সেরকম কোন অনুভূতি নেই। শব্দটা শুনলেই আমার সেই বৃদ্ধ বাবার থুড়থুড়ে চেহারাটা ভেসে উঠে চোখের সামনে; সামনের বারান্দার সোফায় বসে হাতের লাঠিটির মাথায় একটি হাতের উপর আরেকটি হাতের তালু, তার উপর বাম গালটা রাখা, একটু পরপরই ডান হাতের চারটি আঙুলে বোল তোলা সেই মানুষটির নিবিষ্ট মনে দরজার বাইরে তাকিয়ে থাকা।
‘কী হল, রাগ করলে? কিছু বলছ না যে’? আমার স্ত্রী’র মায়াবি গলা।
‘নাহ্, আমি ভাবছি তুমি আমাকে কী বলবে যদি আমার বায়োডাটা দেখ’।
‘কী? কী আছে বায়োডাটাতে?’ তেমনিই ঠাট্টার হাসি তার মুখে।
‘হুম! দেখ, কী আছে।’
বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে আলমারি খুলে আমার ফাইলটা থেকে বায়োডাটা বের করে পড়তে শুরু করে সে। আমি আঙুল দিয়ে ওকে আমার পিতার নামটি দেখাই।
‘এই সিভিটা কতবার আপডেট করেছি, প্রতিবারই আমি এ জায়গাটায় এসে আটকে গেছি। বাবার নামের আগে ’মৃত’ বিশেষণটা আমি এখনো যোগ করে উঠতে পারিনি অথচ বাবা মারা গেল আজ ৮ বৎসর পেরিয়ে যাচ্ছে’। টের পাই আমি আমার বাবার মৃত চেহারাটা কোনভাবেই খুঁজে পাচ্ছি না। বন্ধুরা আমার যে কী উপকার করল অজান্তে, নিজেরাই জানে না।
‘এটার কোন মানে হল?’
‘তুমি এখন বুঝবে না, যেদিন তোমার বাবা মারা যাবে সেদিন বুঝবে’ বলতে গিয়েও আটকে যায় আমার জিহ্বা, আমার স্ত্রী কষ্ট পাবে ভেবে। ওর তো বোঝার কথাও নয়।
৬.
আমি মনে মনে ঠিক করি এভাবেই আমার পুরনো বন্ধুদের বাসায় বাসায় ঘুরে বেড়াব আরো। মেতে উঠব পুরনো দিনের গল্প আর আড্ডায়; আমি টেনে আনব চাকরির প্রসঙ্গ, ইন্টাভিউয়ের বৃত্তান্ত। আমার বন্ধুরা হাসবে, আমায় ডাকবে ‘আপাতত বৃদ্ধ’ বলে। আমায় আর অপমান ব্যথিত করবে না; বরং আমিও প্রাণ খুলে হাসব, আড্ডা দেব। সবার অলক্ষ্যে আমার চোখের সামনে ভর করবে এক অদৃশ্য পর্দা, তাতে ঝুলতে থাকবে থুরথুরে চেহারার সেই মুখটি, লাঠির মাথায় হাতের উপর হাত, তার উপর বাম গাল, ডান হাতের চারটি আঙুল তাতে বোল তুলছে – আমৃত্যু; জীবনের শেষ দিনটি পযর্ন্ত।
আশীষ বড়ুয়া
১৩.০৭.২০১৫
রংপুর।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৬