অনুবাদ : আশরাফ মাসরূর
দুর্যোগময় প্রথম দিনের সকাল
রোজকার মতই লোকেরা সকালে জেগে উঠে প্রাত:কৃত্য সেরে পানি, চা-কফি বা অন্য যে কোন পানীয় পান করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেদিন পানির সরবরাহ ছিল বন্ধ। ফলে যাদের রিজার্ভ ট্যাংক নেই, তারা বাধ্য হল ফ্রিজে রাখা বোতলের পানি ব্যবহার করতে।
তারপর বেলা বাড়তেই সবাই আপন আপন কর্মেক্ষেত্রে যেতে লাগল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দুপুরে ফেরত আসতে আসতে যে পানির সরবরাহ আবার চালু হবে, সে ব্যাপারে কারো মনে দুরাশাটিও জাগছিল না। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল, যখন সকলে কর্মেেত্র একত্র হল, তখন। শহরের সকলেই পানির ব্যাপারে বলাবলি করছিল। এই অদ্ভুতুরে ব্যাপারে সবাই মোটামুটি বিমূঢ়। পানির সরবরাহ সব এলাকায় বন্ধ। সবার ধারণা, পানির মূল কেন্দ্রে নিশ্চয় বড় কোন সমস্যা হয়েছে। স্বভাবতই, পানির সরবরাহ বন্ধ থাকবে কয়েক ঘন্টার জন্য। আবার হতে পারে বেশ কয়েক দিনেও পানির সরবরাহ চালু হবে না।
সবাই বাসায় যাবার পথেই পানির বোতল ইত্যাদী কিনে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু পানির বোতলের ষ্টক মার্কেটগুলিতে বিশেষ একটা ছিল না। ফলে শহরে বোতলজাত পানির টান পড়ে যায়। যা ছিল দুএকটি, বিকোতে থাকে নাগালের বাইরের দূর্মূল্যে। ক্রমশ মার্কেটগুলি থেকে পানির বোতল একেবারে নি:শেষ হয়ে আসে।
দুর্যোগ মোকাবিলা
যখন দূর্যোগ শহরে ব্যপক আকারে ছড়িয়ে পড়লো, পানি কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, সে ব্যাপারে সবাই পরামর্শ করতে বসল।
জনৈক ব্যক্তির প্রস্তাব,-
-‘ প্রত্যেকে স্বীয় প্রয়োজনানুসারে পাত্র নিবে। তারপর আমরা সবাই শহরের অদূরে যে ঝর্ণা আছে, সেখানে যাবো। যতন পর্যন্ত পানির প্রবাহ থাকবে, আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুসারে পানি নিতে থাকবো।’
সমর্থনসূচক আওয়াজে চারদিক উচ্চকিত হয়ে উঠল।
-‘ ঠিক.....
-‘ আমরা একমত......
-‘ জলদি কর.......
যারাই শুনতে পেয়েছে, প্রত্যেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই প্রস্তাবটি প্রায় সবারই মন:পুত হয়েছে। পানির স্থায়ী সমাধান হওয়ার পূর্বপর্যন্ত আপাতত লোকেরা এই প্রস্তাবটিকেই উপযোগী মনে করছে। কিন্তু, বিপদ সম্পর্কে তারা তখনো বিশেষ একটা ধারণা করে উঠতে পারেনি; ঘটনা ছিল আরো ভয়াবহ ও অদ্ভুতুরে। ঝর্নায় যেতে গিয়ে পথিমধ্যেই তারা এমন অনেককেই পেল, পূর্বেই ঝর্ণায় গিয়ে যারা হতাশ হয়ে ফিরে আসছে। ঝর্ণা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এমনকি তার তলদেশে কাদার চিন্থমাত্রটিও নেই; শুকিয়ে মাটি একদম খটমট করছে।
পানি সরবরাহকেন্দ্র ও আবহাওয়া কেন্দ্রের ভাষ্য
পানি সরবরাহকেন্দ্রে সেই সকাল হতেই Ñযখন থেকে পানির সরবরাহ বন্ধ- সারাদেশের নানা জায়গা থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। অবশেষে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, এই অদ্ভুতুরে অবস্থার বিস্তার ঘটেছে দেশজুড়ে।
কেন্দ্র থেকে যোগাযোগকারীদের এই আশ্বাস দেয়া হতে লাগলÑ সমস্যাটি সাময়ীক। ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অচিরেই কোন সমাধান বেরিয়ে আসবে। জনসাধারণের মাঝে যেন কোন ধরণের গোলযোগ ছড়িয়ে না পড়ে, তাই এই ধরণের ঘোষনা বারবার দেয়া হতে লাগল। কিন্তু কেন্দ্রও পানির সরবরাহ বন্দ হবার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
ওদিকে আবহাওয়া কেন্দ্রও পানির প্রাকৃতিক যে উৎসগুলি আছে, সেগুলি শুকিয়ে যাবার কোন যৌক্তিক এবং বাস্তবানূগ কারণ চিন্থিত করতে পারেনি। উল্টো তারা যে বিষয়টি নিশ্চিত করল,- ভূমির উপরিভাগ ও অভ্যন্তরের পানি শুকিয়ে যাবার কারণে গরম বৃদ্ধি পাবে প্রচন্ড আকারে। আর আকাশে মেঘ না থাকায় বৃষ্টিরও কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে ফসলের তেগুলি শুকিয়ে যাবে, পশুপাখীর পানি পান করার স্থানগুলি একেবারেই পানিশুন্য হয়ে পড়বে। সবচে ভয়ের কথা,- পানির অভাবে পিপাসায় মানুষ মরে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।
দেশজুড়ে অস্থিরতা
জনসাধারণ রাজপথে নেমে আসল। তারা সরকার থেকে পানির নূন্যতম সরবরাহের আশ্বাসটুকু পেতে চায়। শহরগুলিতে বিােভ ছড়িয়ে পড়ল। পিপাসার্ত লোকেরা পানির খালি বোতল উঁচু করে পানির প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে লাগল। তারা সরকারের কাছে পানির যতদ্রুত সম্ভব, নিরাপদ সরবরাহের আশ্বাস লাভ করতে চায়।
এভাবে বিক্ষোভকারীরা পানিকেন্দ্রের সম্মুখে গিয়ে হাজির হল; সেখানে তারা বিক্ষোভ করতে থাকল। পানির খালি বোতল ছুড়ে ছুড়ে মারল। কেউ কেউ আবার পানিকেন্দ্রের দরজা ভাঙ্গতে লাগল। পানিকেন্দ্র ভবনে ঢুকে পড়ে সেখানে আগুন লাগিয়ে দিল। ফায়ার বিগ্রেডের লোকেরা পানি ছাড়াই আগুন নিয়ন্ত্রন আনার চেষ্টা করতে থাকল।
অবশেষে পুলিশবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। তারা কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। পানি কামান পানির শুন্য থাকায় তারা তা ব্যবহার করতে পারছিল না।
সরকারের ভাষ্য
এক জরূরী মিটিংয়ে শহরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাবৃন্দ একত্রিত হন। সেদিন টেবিলে কোন পানপাত্র ছিল না। এমনকি সাধারণত মিটিংগুলিতে যে সকল পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, সেগুলিও অনুপস্থিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রি কথা বলবেন। আজ তিনি শেভ করে আসেননি। বরাদ্দকৃত সামান্য পানিটুকু গিলেই শুরু করলেন,-
-“ বিষয়টি আর গোপন নেই। আমাদের রিজার্ভ পানিও ক্রমশ কমে আসছে। এখন অল্প কিছু পরিমাণেই অবশিষ্ট আছে। আর এই ব্যাপারে আমরা দায়িও নই। ঘটনা আমাদের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। এই অদ্ভুত অবস্থা এখন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। পানির সকল উৎসই শুকিয়ে গেছে, এমনকি ভূপৃষ্ঠের যত সমুদ্র ও মহাসমুদ্র আছে সেগুলির পানি পর্যন্ত সম্পুর্ণরূপে ফুরিয়ে গেছে। সমুদ্রগুলি ভরার জন্য আমাদের নিকট এক বিন্দু পরিমাণ পানিও নেই। আমরা প্রতিবেশী মেরু অঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলির সাথে যোগাযোগ করেছি। তাদের আমরা বরফের চাই যোগান দিতে বলেছিলাম। আমাদের তারা জানিয়েছে, বরফের চাইগুলি সব উবে গেছে যেন। আবার আকাশে এটুকুন মেঘও দেখা যাচ্ছে না, বিজ্ঞানের সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে যা বর্ষানো সম্ভব।”
মিডিয়ার ভূমিকা
পৃথিবীব্যাপী যে অদ্ভুতুরে কান্ড ঘটছে, রূপালী পর্দায় তা দেখানো হতে থাকে। সেখানে ফুটে উঠে,- শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্র ও মহাসমুদ্র। মেরূ অঞ্চল শুকিয়ে একেবারে খটখটে অবস্থা; সেখানে বিপ্তিভাবে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঙ্গুঈন সহ নানা মেরুপ্রাণী। এদিকে হাসপাতালগুলিতে এমন কোন ঔষুধ নেই, যা দিয়ে ব্যাপক আকারে, গণহারে মানুষের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুদের মৃত্যু।
সমগ্র শহর ক্রমশ গোরস্থানে পরিণত হতে থাকল- পিপাসার্ত ব্যক্তিদের লাশে লাশে। এখানে সেখানে লাশ পড়ে আছে; দাফন ও সৎকার বিহীন অবস্থায়।
মানবধিকার সংস্থাগুলির বিবৃতি
আমরা অন্য গ্যালাক্সিগুলিতে, গ্রহগুলিতে পানির তালাশে কোন মহাকাশযান পাঠাবো, এমন সময়ও নেই। তাছাড়া এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার। তাই আমরা অশেষ দু:খের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি,- “কোন সাহায্যই করতে আমরা আর সম নই। আমরা দলে মানুষের মৃত্যু ও মানব সভ্যতার ধ্বংসের পূর্বেই কোন সমাধান বেরিয়ে আসবে এই আশাই করতে পারি। আর কিছুই নয় !!
হ্যা ! আমরা এখন একটি কাজ করতে পারি। পৃথিবীর দলজাতী নির্বিশেষ সকল ধর্মগোষ্ঠির লোকদের নিকট আবেদন রাখাÑ তারা যেন বিশ্বজুড়ে পানির জন্য প্রার্থনা করেন ! ”
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির জরূরী বৈঠকের শেষ মুহুর্তের গোপন সিদ্ধান্ত
পৃথিবীর তাবৎ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি একটি গোপন মিটিংয়ে একত্র হয়। সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়Ñ যেহেতু জীবিত মানুষ ছাড়া পানির কোন দাম নেই। তাই আমরা রক্ত থেকে পানি বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার করবো। কারণ, এই মুহুর্তে এটিই একমাত্র উৎস হতে পারে, যেখান থেকে আমরা পানি পেতে পারি। তারপর আমরা সে পানিকে পান করার উপযোগী করে তুলব। আর যেহেতু প্রানীকূল ক্রমশই শেষ হয়ে আসছে, তাই যতদ্রুত সম্ভব, আমাদের কাজে হাত দিতে হবে।
এছাড়াও আমরা একটি গবেষণা চালাতে পারি। যারা এখনো পিপাসায় মারা যায়নি, তাদের জন্য কীভাবে,-সম্ভব হলে- মানুষের খুন থেকেও পান করার উপযোগী জল তৈরি করা যায় !!!
সামির আনোয়ার শিমালী; সিরিয়ান লেখক। জন্ম, ১৯৭১; হিমস শহরে। ছোটগল্প, বড় গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য সমালোচনা, প্রবন্ধ,নিবন্ধ এবং শিশুতোষ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি অঙ্গণেই রয়েছে তার সাবলিল পদচারণা। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট - আগত ভবিষ্যতের কল্পনায় ছলকে উঠা ভয়গুলির রূপায়ন তার লেখায় ঘটে অত্যন্ত সার্থকভাবে। ছোটগল্পের মধ্যে তার লেখা রয়েছে- আলো বিষয়ক একটি আলোচনা, মৃত্যুর করতালি, এবং জল ও খুন। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে - একটি সম্মিলিত আত্মজীবনী। শিশু সাহিত্যের অন্যতম তার কয়েকটি অবদান হচ্ছে- ছোট্র লেখকটি, উজ্জল ঘাসগুলির তারকা, বাদশাহী গুপ্তধন ইত্যাদি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ১০:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




