somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-২৬ | ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্য (৮০০-৮৮৮ সাল)

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


৮০০ সালের ডিসেম্বর মাসে রোম নগরীতে আয়োজিত বড়দিনের অনুষ্ঠানে রোমের পোপ তৃতীয় লিও ফ্রাংক রাজা চার্লসকে ‘রোমান সম্রাটের’ মর্যাদায় ভূষিত করেন। পোপ চার্লসের মাথায় ‘রোমান সম্রাটের’ মুকুট তোলে দেন। এভাবে ফ্রাংক সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বহনকারি এক নব্য সাম্রাজ্য হিসেবে পোপীয় স্বীকৃতি লাভ করে। ইতিহাসে এ নব্য সাম্রাজ্য ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত।

পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে কেবলমাত্র পোপকেই রোমান সভ্যতার একমাত্র ধারক ও বাহক বিবেচনা করা হতো। পোপীয় স্বীকৃতির ফলে ফ্রাংক সাম্রাজ্য নব্য ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে’ পরিণত হয় এবং চার্লস হয়ে যান নব্য ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’। এভাবে ৪৭৬ সালে হারিয়ে যাওয়া পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের নবজন্ম হয়। অবশ্য পোপীয় স্বীকৃতির এই ধারা সবসময় সঠিকভাবে বজায় থাকেনি এবং এর কার্যকারিতাও ছিল সামান্যই।


চিত্র: পোপের হাতে পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে শার্লামেনের অভিষেক

তাই শার্লামেনের অভিষেক পরবর্তী ফ্রাংক সাম্রাজ্য সভ্যতার ইতিহাসে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ হিসেবে যতটা না পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত ‘ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্য’ হিসেবেই। ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তীতে ৯৬২ সালে জার্মানি ও ইতালিজুড়ে প্রতিষ্ঠিত অটোনিয়ান সাম্রাজ্যও পোপীয়ভাবে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে ১৮০৬ সালে।

পোপীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে অভিষিক্ত হওয়ার ফলে ফ্রাংক সাম্রাজ্য চার্চের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে এবং ফ্রাংকদের মাঝে ক্যারোলিঞ্জীয় আধিপত্য স্থায়ী বৈধতা লাভ করে। ফ্রাংক রাজা চার্লস ইউরোপজুড়ে সম্রাট শার্লামেন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সম্রাট হিসেবে শার্লামেনের পরবর্তী স্বীকৃতি আসে বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছ থেকে।

বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম মাইকেল ৮১২ সালে শার্লামেনকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন। ইতিহাসের অন্যতম সফল সম্রাট শার্লামেন ৮১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বর্তমান পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থিত আখেন শহরে মারা যান। তাকে আখেনের রাজপ্রাসাদের চ্যাপেলে সমাহিত করা হয়েছিল।


চিত্র: সম্রাট শার্লামেনের অভিষেক অনুষ্ঠান

শার্লামেনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি হন তাঁর তৃতীয় পুত্র লুইস দ্য পায়াস বা ১ম লুইস (শাসনকাল: ৮১৪-৮৪০ সাল)। ৭৮১ সালে সম্রাট শার্লামেন তাঁর এই পুত্রকে আকিতাইন রাজ্যের শাসক বানিয়েছিলেন। আকিতাইনের পাশে ছিল মুর মুসলিমদের রাজ্য আন্দালুসিয়া। লুইস মুরদের আক্রমণ থেকে আকিতাইনকে নিরাপদ রাখতে সফল হয়েছিলেন। ৮০১ সালে তিনি মুরদেরকে পরাজিত করে বার্সেলোনা অঞ্চল উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এর দুই বছর পূর্বে মুররা বর্সেলোনা দখল করেছিল।

৮০৬ সালে সম্রাট শার্লামেন তাঁর সাম্রাজ্যকে তিনটি অংশে ভাগ করেন এবং তাঁর তিন বৈধ পুত্র চার্লস, পেপিন ও লুইসকে এ তিনটি অংশ শাসনের দায়িত্ব প্রদান করেন। লুইস সাম্রাজ্যর পশ্চিম অংশের আকিতাইন, বারগান্ডি এবং স্পেনিশ মার্চের দায়িত্ব পান। এর কয়েক বছরের মধ্যে চার্লস ও পেপিন মারা যান এবং শার্লামেনের উত্তরসূরি হওয়ার জন্য কেবল লুইস বেঁচে থাকেন।

৮১৩ সালে সম্রাট শার্লামেন পুত্র লুইস দ্য পায়াসকে তাঁর ‘সহসম্রাট’ ঘোষণা করেছিলেন। ‘সহসম্রাট’ ধারণাটি এসেছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে। বাইজেন্টাইন সম্রাটরা ‘সহসম্রাট’ পদটি সৃষ্টি করেছিলেন। লুইস দ্য পায়াস সহসম্রাট হওয়ার পরের বছর সম্রাট শার্লামেন মারা যান এবং লুইস তাঁর পিতার পুরো সাম্রাজ্যের একক অধিপতি হন।


চিত্র: সম্রাট শার্লামেনের দরবার

পিতার মৃত্যুর পর লুইস দ্য পায়াস আখেনের মসনদে আসীন হন। তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে বেনেডিক্ট অভ এনিয়ানকে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা বানান। বেনেডিক্টকে কর্নেলিমুনস্টার মঠের অধ্যক্ষও বানানো হয়। বানিয়েছিলেন, যা কাছাকাছি ছিল। বার্নার্ড অভ সেপ্টেমানিয়া এবং রেমিসের আর্চবিশপ ইবোও তার সিনিয়র উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন। ৮১৬ সালে তিনি ক্যাথলিক চার্চের সংস্কার ও একে শক্তিশালী করার জন্য প্রথমবারের মতো কয়েকটি সম্মেলনের আয়োজন করেন।

৮১৭ সালে লুইস দ্য পায়াস তাঁর সাম্রাজ্যের তিনটি অংশ শাসনের ভার তোলে দেন তাঁর কনিষ্ঠ দুই পুত্র ও এক ভাতিজার হাতে। একই বছর তিনি তাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র লোথারকে (১ম লোথার) তাঁর উত্তরাধিকারী এবং ‘সহসম্রাট’ ঘোষণা করেন। এভাবে তিনি তাঁর পিতার দৃষ্টান্ত এবং ফ্রাঙ্কিশ ঐতিহ্য- দু’টিই বজায় রাখেন (সহসম্রাটের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর পিতা শার্লামেন আর সন্তানদের মধ্যে রাজ্য বন্টনের ঐতিহ্যটি ছিল একটি ফ্রাঙ্কিশ ঐতিহ্য)। লুইস দ্য পায়াস তাঁর পুত্র পেপিনকে দিয়েছিলেন আকিতাইন রাজ্য এবং লুইস দ্য জার্মানকে (২য় লুইস) দিয়েছিলেন বাভারিয়া রাজ্য।


চিত্র: সম্রাট লুইস দ্য পায়াস

লুইস দ্য পায়াস তাঁর ভাতিজা বার্নার্ডকেও বঞ্চিত করননি। বার্নার্ডকে তিনি ইতালির সিংহাসনে বসান এবং ইতালীর সিংহাসনের জন্য তাকে বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু বার্নার্ড স্বাধীনভাবে ইতালি শাসন করতে চান এবং এজন্য তিনি লুইসের বিরুদ্ধে চলে যান। লুইস দ্য পায়াস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বার্নার্ডকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তাকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বার্নার্ড মানসিক আঘাতে মারা যান। এ ঘটনায় লুইস কষ্ট পান এবং এজন্য তিনি ৮২২ সালে পোপের সামনে অনুশোচনা করেন।

বার্নার্ডের মৃত্যুর পর ইতালি শাসনের ভার লাভ করেন ১ম লোথার। ইতোপূর্বে লুইস দ্য পায়াস জ্যোষ্ঠপুত্র ১ম লোথারকে তাঁর প্রধান উত্তরাধিকারী ও সহসম্রাট ঘোষণা করেছিলেন এবং তাকে পেপিন দ্য আকিতাইন, লুইস দ্য জার্মান ও বর্নাড দ্য ইতালির ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছিলেন। সেই সাথে এ নিয়মও করা হয়েছিল যে, এ তিনজনের কেউ রাজ্যের উত্তরাধিকারী না রেখে মারা গেলে তাঁর রাজ্যের অধিকারী হবেন ১ম লোথার। সে অনুযায়ী বার্নার্ডের পর ইতালীর অধিকারী হন ১ম লোথার। এর পরের বছর তিনি পোপের কাছ থেকে ‘রোমান সম্রাটের’ স্বীকৃতি লাভ করেন।


চিত্র: লুইস দ্য পায়াসের অভিষেক

লুইসের দ্বিতীয় রাণী জুডিথ তাদের শিশু সন্তান চার্লসকে (চার্লস দ্য ব্যাল্ড) সাম্রাজ্যের কিছু অংশ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যকে পুনরায় বিভাজিত করতে অনুরোধ করেন। ৮২৯ সালে তিনি তা-ই করলেন। চার্লসের বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। চার্লসকে জার্মানি অঞ্চলের বেশিরভাগই প্রদান করা হয়। এতে লুইসের অন্যান্য তিন পুত্র অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁরা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ১ম লোথার সম্রাটের মুকুট কেঁড়ে নেন, কিন্তু ভাইদের মধ্যে তিক্ততার ঘটনা লুইসকে মুকুটটি ফিরে পেতে সাহায্য করে।

৮৩২ সালে ১ম লোথার আবারও বিদ্রোহ করেন। পোপ ১ম লোথারের পক্ষ নেন এবং লুইস দ্য পায়াসকে আবারও ১ম লোথারের কাছে মুকুট সমর্পণ করতে হয়। লুইসের অন্য দুই পুত্র পিতার পক্ষ নেন এবং মুকুট ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা দিতে থাকেন। ৮৩৮ সালে দুই পুত্রের একজন পেপিন মারা যান এবং লুইস দ্য পায়াস তাঁর জীবিত পুত্রদের মধ্যে সাম্রাজ্যকে আবার নতুন করে ভাগ করে দেন। সর্বশেষ এই ভাগাভাগিতে তাঁর পুত্র লুইস দ্য জার্মানকে কেবলমাত্র বাভারিয়া অঞ্চলটি প্রদান করা হয়; কিন্তু সাম্রাজ্যের বাকী অংশ ১ম লোথার এবং চার্লসের মধ্যে সমানভাবে ভাগাভাগি হয়। ১ম লোথার ইতালি এবং রন-সাইনা উপত্যকার পূর্বের ভূখণ্ড লাভ করেন এবং চার্লস লাভ করেন পশ্চিম ফ্রান্সিয়া।


চিত্র: ভার্দুন চুক্তির ভিত্তিতে বিভক্ত ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্য

৮৪০ সালে লুইস দ্য পায়াসের মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। তিন বছর লড়াইয়ের পর ৮৪৩ সালে তিন ভাইয়ের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তি ভার্দুন চুক্তি (ট্রিটি অভ ভার্দুন) নামে পরিচিত। ভার্দুন চুক্তির ভিত্তিতে ফ্রাংক সাম্রাজ্যকে তিনটি অংশে ভাগ করে ফেলা হয়। ভাগাভাগিতে চার্লস দ্য ব্যাল্ড পান পশ্চিম ফ্রান্সিয়া; লুইস দ্য জার্মান লাভ করেন পূর্ব ফ্রান্সিয়া এবং ১ম লোথার পান মধ্য ফ্রান্সিয়া। রন নদীর পশ্চিমে ছিল পশ্চিম ফ্রান্সিয়া, রাইন নদীর পূর্বে ছিল পূর্ব ফ্রান্সিয়া এবং এ দুটি রাজ্যের মাঝখানে ছিল মধ্য ফ্রান্সিয়া। এ ঘটনার পর থেকে পশ্চিম ইউরোপ ক্রমে আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে থাকে।

১ম লোথার মধ্য ফ্রান্সিয়াকে তিনটি অংশে ভাগ করে তাঁর ছেলেদের হাতে দিয়ে যান। এ তিনটি অংশ হল বারগান্ডি, ইতালি এবং লোথারিঞ্জিয়া। তবে বারগান্ডি ও লোথারিঞ্জিয়া শীঘ্রই পূর্ব ফ্রান্সিয়া ও পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার অধিকারে চলে যায়। এ দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রায়ই সেসব সীমান্ত এলাকা নিয়ে লড়াই বেধে যেতো যেসব এলাকা পরবর্তীতে ফ্রাংক সাম্রাজ্যের বিভাজনকে আরও গতিশীল করেছিল। রোমান্স ভাষাভাষী পশ্চিম ফ্রান্সিয়া পরবর্তীতে হয়ে যায় ফ্রান্স রাজ্য এবং জার্মান ভাষাভাষী পূর্ব ফ্রান্সিয়া হয়ে যায় ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’। মধ্য ফ্রান্সিয়া আর কখনোই রাজনৈতিকভাবে সংহত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

লুইস দ্য পায়াসের সময়কালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের কারণে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল রোমের পোপতন্ত্র। ফ্রাংক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিরোধ পোপতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছিল। পোপ একেকবার একেক দিকে পক্ষপাত প্রদর্শন করেছিলেন। এভাবে সকল পক্ষের কাছেই পোপের সমর্থনের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল।

ইতোপূর্বে ৮১৬ সালে পোপ চতুর্থ স্টিফেন একবার লুইস দ্য পায়াসকে নিজের হাতে অভিষিক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ফ্রান্সিয়ার রেমিস শহরে লুইস দ্য পায়াসকে শপথ পড়িয়ে তাঁর মাথায় রোমান সম্রাটের মুকুট তোলে দিতে চেয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের ব্যাপারে তিনি লুইসকে প্রলুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। লুইস দ্য পায়াস ৮১৩ সালে সহসম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আখেন শহরে, রোমের পোপের কাছে নয়।

পোপ লুইসকে নিজের হাতে অভিষিক্ত করে এই ‘ভুল’ শোধরাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। ৮০০ সালে ফ্রাংক সম্রাট শার্লামেন ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে পোপীয় স্বীকৃতি নিয়ে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটালেও বাস্তবে এই পোপীয় স্বীকৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার তেমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। এছাড়াও সম্রাট শার্লামেন যে ‘সহসম্রাটের’ পদটি সৃষ্টি করেছিলেন সে পদের পোপীয় স্বীকৃতি আবশ্যক কিনা তা-ও পরিস্কার ছিল না। কিন্তু ফ্রাংক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে পরিস্থিতি যায় বদলে। ফ্রাংক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিরোধ পোপীয় সমর্থনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়।


চিত্র: সম্রাট লুইস দ্য পায়াসের জ্যোষ্ঠপুত্র সম্রাট ১ম লোথার

সম্রাট লুইস দ্য পায়াস ৮১৭ সালে পোপীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র ১ম লোথারকে তাঁর সহসম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। বার্নার্ডের মৃত্যুর পর লোথার ইতালির সিংহাসনে বসলে তিনি পোপের ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। তখন বুদ্ধিমান ১ম লোথার তাঁর সহসম্রাট উপাধীটি পাকাপোক্ত করার জন্য পোপের স্বীকৃতি আদায় করে নেন। ৮২৩ সালের ৫ এপ্রিল তিনি রোমের পোপ ১ম প্যাসকেলের কাছে ‘রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং পোপের কাছ থেকে সম্রাটের মুকুট লাভ করেন। এভাবে ফ্রাংক সাম্রাজ্য তথা পশ্চিম ইউরোপে পোপীয় স্বীকৃতির বিষয়টি পোপীয় কর্তৃত্বের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে তোলে।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ান সম্রাটের দেহরক্ষী সৈন্য

৮৪৪ সালে ১ম লোথার তাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র ২য় লুইসের (লুইস অভ ইতালি) হাতে ইতালির শাসনভার তোলে দিয়ে শাসনকার্য থেকে অবসর নেন। ৮৫০ সালে তিনি লুইস অভ ইতালিকে সহসম্রাটের মর্যাদা প্রদান করেন। লুইস অভ ইতালি পোপের কাছ থেকেই সম্রাটের মুকুট গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে পোপীয় স্বীকৃতি নিয়ে ১ম লোথারের পরবর্তী ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হলেন লুইস অভ ইতালি। ৮৫৫ সালে ১ম লোথার মৃত্যুবরণ করেন; এর পূর্বে তিনি সাম্রাজ্যকে তিনটি অংশে বিভক্ত করে তাঁর পুত্রদের হাতে তোলে দিয়েছিলেন।

ইতালির নিয়ন্ত্রণ লুইস অভ ইতালির হাতেই থাকে, নিম্ন বারগান্ডি অঞ্চল লাভ করেন তৃতীয় পুত্র চার্লস অভ প্রোভেন্স এবং উচ্চ বারগান্ডিসহ সাম্রাজ্যের বাকী অংশ লাভ করেন দ্বিতীয় পু্ত্র ২য় লোথার। ২য় লোথারের শাসনাধীন এলাকার নাম হয় লোথারিঞ্জিয়া। লুইস অভ ইতালি তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আর কোন অতিরিক্ত অঞ্চল না পাওয়ায় অসন্তুষ্ট হন।


চিত্র: সম্রাট লুইস দ্য জার্মান

তিনি ৮৫৮ সালে তাঁর ভাই ২য় লোথার এবং চাচা চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর বিরুদ্ধে আরেক চাচা লুইস দ্য জার্মানকে নিয়ে একটি জোট বাঁধেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এ বিরোধ মিটমাট হয়ে যায়। চার্লস দ্য ব্যাল্ড তাঁর সাম্রাজ্য পশ্চিম ফ্রান্সিয়ায় এতটা অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁর দেশের লোকজন দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাদের দেশে পূর্ব ফ্রান্সিয়ার রাজা লুইস দ্য জার্মান এর আক্রমণ কামনা করে। লুইস দ্য জার্মান ৮৫৮ সালে পশ্চিম ফ্রান্সিয়ায় আক্রমণ চালান।

চার্লস দ্য ব্যাল্ড আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সেনাবাহিনী নিযুক্ত করতে ব্যর্থ হন এবং দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বারগন্ডিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এর পরের বছর লুইস দ্য জার্মান পশ্চিম ফ্রান্সিয়ায় তাঁর এক বছরের রাজত্বের চার্টার ইস্যু করেন। কিন্তু তাঁর সৈনিকদের প্রতারণা ও ছলনা এবং চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর পক্ষে আকিতাইনের বিশপদের শক্ত অবস্থানের কারণে পশ্চিম ফ্রান্সিয়ায় তাঁর দখল স্থায়ী হয়নি।


চিত্র: সম্রাট চার্লস দ্য ব্যাল্ড

বিশপরা লুইস দ্য জার্মানকে পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার রাজমুকুট পরাতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ফলে চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর রাজ্য রক্ষা পায়। ৮৬০ সালের ৭ জুন লুইস দ্য জার্মান ও চার্লস দ্য ব্যাল্ড কবলেঞ্জে মিলিত হন এবং শান্তি রক্ষার ব্যাপারে প্রকাশ্যে শপথ করেন। এরপর চার্লস দ্য ব্যাল্ড তাঁর রাজ্য ফিরে পান।

একই বছর তিনি চার্লস অভ প্রোভেন্সের বারগান্ডিতে আক্রমণ করে বসেন; কিন্তু আক্রমণ ব্যর্থ হয়। ৮৬৩ সালে চার্লস অভ প্রোভেন্স মারা যান এবং তাঁর রাজ্যের মালিক হন লুইস অভ ইতালি। অন্যদিকে ৮৬২ সালে ২য় লোথারও লুইস অভ ইতালির হাতে তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা তোলে দিয়েছিলেন। নানামুখী চাপে পড়ে ২য় লোথারের সমর্থন লাভের জন্য তিনি এ কাজ করেছিলেন।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ান স্থাপত্যরীতি

৮৬৯ সালে ২য় লোথার কোন বৈধ উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তখন লুইস অভ ইতালি ছিলেন মারাত্মকভাবে অসুস্থ এবং তাঁর সেনাবাহিনীও মোরাভিয়ানদের সাথে একটি যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল। তাই এ সুযোগে পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার চার্লস দ্য ব্যাল্ড এক ঝটিক অভিযান চালিয়ে ২য় লোথারের রাজ্য লোথারিঞ্জিয়া দখল করে নেন। এমতাবস্থায় পূর্ব ফ্রান্সিয়ার লুইস দ্য জার্মানও বসে থাকলেন না।

তিনি লোথারিঞ্জিয়ায় ভাগ বসাতে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বসলেন। তাই চার্লস দ্য ব্যাল্ডকে বাধ্য হয়ে লোথারিঞ্জিয়া ভাগাভাগির ব্যাপারে ‘মার্সেন চুক্তি’ সম্পাদন করতে হয়। ৮৭০ সালে এ চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং এ চুক্তি অনুসারে লুইস দ্য জার্মানকে লোথারিঞ্জিয়ার অংশ প্রদান করা হয়। এর কিছুদিনের মধ্যে লুইস দ্য জার্মান তাঁর তিন ছেলের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ান ক্রুশ

এসব ঘটনা যখন ঘটছে তখন পোপীয় স্বীকৃতি অনুসারে সমগ্র ফ্রাংক সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে আসীন রয়েছেন লুইস অভ ইতালি, যদিও ফ্রাংক সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশই তখন তাঁর দখলে রয়েছে। ফ্রাংক সাম্রাজ্যের বড় অংশ তখন ছিল চার্লস দ্য ব্যাল্ড ও লুইস দ্য জার্মান এর দখলে। ফ্রাংক সাম্রাজ্য বা ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্যকে শার্লামেনের সময় ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তখনকার পোপ এবং এ ধারাবাহিকতায়ই লুইস অভ ইতালি ছিলেন পোপ স্বীকৃত রোমান সম্রাট। তাই চার্লস দ্য ব্যাল্ড বা লুইস দ্য জার্মান ফ্রাংক সাম্রাজ্যের বড় অংশ দখল করে নিলেও তারা কেউই পোপের কাছ থেকে ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ উপাধীটি বাগাতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত লুইস অভ ইতালির আকস্মিক মৃত্যুর পর এ সুযোগটির দেখা মিলল।

৮৭৫ সালের ১২ আগস্ট লুইস অভ ইতালি মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ ইতালিতে সারাসিনদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান শেষ করে উত্তর ইতালিতে ফিরে আসার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি চাচাত ভাই (লুইস দ্য জার্মান এর জ্যোষ্ঠপুত্র) কার্লোমানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু চার্লস দ্য ব্যাল্ড কার্লোমানকে সে সুযোগ আর দিলেন না। পোপের সমর্থন নিয়ে তিনি একই সাথে ইতালির রাজা এবং ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হন। ৮৭৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর রোমের পোপ অষ্টম জন তাঁর মাথায় রোমান সম্রাটের মুকুট তোলে দেন। এর পূর্বে ইতালির পাভিয়া শহরে তিনি ইতালির রাজমুকুট পরেছিলেন।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ানদের পোশাক-পরিচ্ছদ

এর পরের বছর পূর্ব ফ্রান্সিয়ার লুইস দ্য জার্মান মারা যান। চার্লস দ্য ব্যাল্ড পূর্ব ফ্রান্সিয়াও তাঁর করায়ত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ৮৭৬ সালের ৬ অক্টোবর এন্ড্রিচের যুদ্ধে লুইস দ্য জার্মান এর পুত্র লুইস দ্য ইয়ংগার (৩য় লুইস) এর হাতে তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ফলে তাঁর পূর্ব ফ্রান্সিয়া দখলের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর পূর্ব ফ্রান্সিয়া লুইস দ্য জার্মান এর তিন পুত্র কার্লোমান অভ বাভারিয়া, লুইস দ্য ইয়ংগার (৩য় লুইস) এবং চার্লস দ্য ফ্যাট এর মধ্যে বিভক্ত হয়।

৮৭৭ সালে রোমের পোপ দক্ষিণ ইতালিতে মুসলিম সারাসিনদের তৎপরতায় ভীত হয়ে চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর কাছে ইতালি রক্ষার আবদন জানান। এতে সাঁড়া দিয়ে চার্লস দ্য ব্যাল্ড আবারও আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে ইতালির দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু এই অভিযানে তিনি স্থানীয় অভিজাতদের তেমন কোন সাঁড়া পেলেন না, এমনকি লম্বার্ডির রাজপ্রতিনিধিও পিছপা রইলেন।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ান সৈনিকদের টহল

তারা সকলেই অভিযানে অংশ নিতে প্রত্যাখ্যান করেন। এরই মধ্যে কার্লোমান অভ বাভারিয়া তখন উত্তর ইতালিতে ঢুকে পড়েন। ফলে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে চার্লস দ্য ব্যাল্ড ইতালি থেকে ফিরতি পথ ধরেন। হতাশা জর্জরিত ও অসুস্থ অবস্থায় তাঁর জন্য আল্পস পর্বতমালা পাড়ি দেওয়া বেশ কঠিন কাজ ছিল। ৮৭৭ সালের ৬ অক্টোবর আল্পসের মন্ট চেনিস গিরিপথ অতিক্রম করার সময় চার্লস দ্য ব্যাল্ড মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র লুইস দ্য স্ট্যামারার।

লুইস দ্য স্ট্যামারার পশ্চিম ফ্রান্সিয়ার অধিপতি হলেও তিনি কখনো ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হতে পারেননি। তিনি শারিরিকভাবে খুবই দুর্বল ছিলেন এবং দেড় বছরের মধ্যে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্য জ্যোষ্ঠ দুই পুত্র লুইস অভ স্যাক্সনি (লুইস দ্য ফ্রান্স) এবং কার্লোমান অভ আকিতাইন (২য় কার্লোমান) এর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। লুইস অভ স্যাক্সনি পান নিউস্ট্রিয়া, ও স্যাক্সনি এবং কার্লোমান অভ আকিতাইন পান আকিতাইন ও বারগান্ডি। এ দু’জনের কারও অংশে ইতালি ছিল না। কারণ ইতালি ইতোপূর্বেই বেদখল হয়ে গিয়েছিল।


চিত্র: লুইস দ্য স্ট্যামারার

চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর মৃত্যুর পরবর্তীতে পশ্চিম ফ্রান্সিয়া উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে ব্যাপক ভাইকিং আক্রমণের শিকার হয়। লুদভিগসলিদ নামক এক জার্মান উপাখ্যানে ভাইকিংদের বিরুদ্ধে লুইস অভ স্যাক্সনি এর বিজয়ের গৌরবগাঁথা বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে। সে সময়য় পশ্চিম ফ্রান্সিয়ায় অভ্যন্তরীণ সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ৮৭৯ সালে বোসো অভ প্রোভেন্স নামে একজন শক্তিশালী ডিউক লুইস দ্য স্ট্যামারারের পুত্রদের আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রোভেন্সের নিম্ন বারগান্ডিতে একটি একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।


চিত্র: সম্রাট চার্লস দ্য ফ্যাট

চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর পর তাঁর পুত্র কিংবা পৌত্ররা কেউই ইতালির রাজা এবং ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হতে পারেননি। কারণ ইতালি তাদের পরিবারের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল আগেই। চার্লস দ্য ব্যাল্ড যখন সারাসিনদের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ইতালি থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন কার্লোমান অভ বাভারিয়া ইতালিতে অবস্থান করছেন।

চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর মৃত্যুর পর ইতালি রাজ্যটি কার্লোমান অভ বাভারিয়ার অধিকারে চলে যায় কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ রাজ্যটি তাঁর ভাই চার্লস দ্য ফ্যাট এর হাতে তোলে দেন এবং বাভারিয়া রাজ্যটিও তোলে দেন তাঁর আরেক ভাই লুইস দ্য ইয়ংগারের হাতে। ৮৮১ সালে চার্লস দ্য ফ্যাট ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হন।

সম্রাট শার্লামেন, ১ম লোথার, লুইস অভ ইতালি ও চার্লস দ্য ব্যাল্ড এর পর ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে পোপের স্বীকৃতি লাভ করলেন চার্লস দ্য ফ্যাট। এর পরের বছর লুইস অভ স্যাক্সনি ও বাভারিয়ার লুইস দ্য ইয়ংগার মারা যান এবং স্যাক্সনি ও বাভারিয়া চার্লস দ্য ফ্যাট এর রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।


চিত্র: ৮৮৫ সালে ভাইকিংদের প্যারিস অবরোধ

অন্যদিকে, ফ্রান্সিয়া, নিউস্ট্রিয়া ও নিম্ন বারগান্ডি কার্লোমান অভ আকিতাইন এর অধীনস্ত হয়। ৮৮৪ সালে এক শিকার অভিযানের সময় দুর্ঘটনাক্রমে কার্লোমান অভ আকিতাইন এর মত্যু ঘটে। এরপর তাঁর রাজ্যগুলোও চার্লস দ্য ফ্যাট এর হস্তগত হয়। এভাবে চার্লস দ্য ফ্যাটের সাম্রাজ্য আয়তনের দিক থেকে শার্লামেনের সাম্রাজ্যের সমকক্ষ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

কিন্তু চার্লস দ্য ফ্যাট এ গৌরব ধরে রাখতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি ভাইকিং আক্রমণকারিদের হাত থেকে সাম্রাজ্য নিরাপদ রাখতে ব্যর্থ হন। ধারণা করা হয় যে তিনি মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি ভাইকিং আক্রমণকারিদেরকে বার বার টাকা-পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছিলেন। ৮৮৫ সালে ভাইকিং সর্দার সিগফ্রেড একটি বিশাল নৌবহর নিয়ে সীন নদীর পথে এগিয়ে আসেন এবং প্যারিস অবরোধ করে রাখেন।

সিগফ্রেড বড় অংকের অর্থ দাবী করেছিলেন। কিন্তু চার্লস দ্য ফ্যাট সে সময়য় ইতালিতে অবস্থান করছিলেন এবং প্যারিসের কাউন্ট ওডো চার্লসের সাহায্য চেয়ে ইতালিতে লোক পাঠান। চার্লস প্রথমে হেনরি অভ স্যাক্সনিকে প্যারিসে পাঠান। ৮৮৬ সালে প্যারিসে রোগ ছড়িয়ে পড়লে ওডো নিজে সাহায্যের জন্য চার্লসের কাছে যান। চার্লস দ্য ফ্যাট একটি বড় সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন এবং প্যারিসের মন্টমার্ত্রে পর্বতের কাছে ক্যাম্প স্থাপন করেন।

কিন্তু চার্লসের যুদ্ধের কোন অভিপ্রায় ছিল না। তিনি আক্রমণকারিদেরকে বারগান্ডিতে লুটপাটের পরামর্শ দেন। কারণ বারগান্ডি তখন চার্লসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত ছিল। পরবর্তী বসন্তে ভাইকিংরা যখন প্যারিস থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় তখন তিনি তাদেরকে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭০০ পাউন্ড রৌপ্য উৎকোচ দেন। এর ফলে ফ্রান্সিয়ায় চার্লসের সুনাম খুবই নীচে নেমে যায়।

ভাইকিংদেরকে অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য বিপুল পরিমাণ উৎকোচ প্রদানের ঘটনাটি চার্লস দ্য ফ্যাট এর কাপুরষোচিত মনোভাব ও অযোগ্যতার পরিচায়ক বলে বিবেচিত হয়। তাঁর সভাসদদের কাছে তাঁর এ ভূমিকা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এ ঘটনার পরের বছর তাঁর ভাতিজা (কার্লোমান অভ বাভারিয়ার অবৈধ পুত্র) আর্নুলফ অভ করিন্থিয়া তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চার্লস দ্য ফ্যাট বিদ্রোহ দমনের পরিবর্তে নাইডিংগেনে পালিয়ে যান এবং পরের বছর ৮৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে এক গভীর সংকট দেখা দেয়।


চিত্র: ক্যারোলিঞ্জিয়ান রাজপ্রাসাদ

ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্য নানা খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। করিন্থিয়া, বাভারিয়া ও লোরাইনসহ (লোথারিঞ্জিয়া) বর্তমান জার্মানি অঞ্চলে আর্নুলফের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। কাউন্ট অডো অভ প্যারিস পশ্চিম ফ্রান্সিয়া অর্থাং বর্তমান ফ্রান্স ভূখন্ডের রাজা নির্বাচিত হন। আকিতাইনের রাজা হন ২য় রানুলফ। ইতালি কাউন্ট বেরেংগার অভ ফ্রিউলির দখলে চলে যায়। উচ্চ বারগান্ডির অধিকারী হন ১ম রুডলফ এবং নিম্ন বারগান্ডি পান লুইস দ্য ব্লাইন্ড (বোসো অভ প্রোভেন্স এর পুত্র)। লোথারিঞ্জিয়ার বাকী অংশ বারগান্ডির ডাচিতে পরিণত হয়। ডিউকের অধীনস্ত জমিদারি এলাকাকে ডাচি বলা হতো।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×