somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৩০ | চার্চ বনাম রাষ্ট্র: পোপ ও সম্রাটের দ্বন্ধ

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অটোনিয়ান শাসনের সময় থেকে ইউরোপের ক্যাথলিক যাজকরা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে যেতে শুরু করেন। সর্বশেষ অটোনিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় হেনরি (১০১৪-১০২৪ সাল) তাঁর রাজকর্মচারী হিসেবে সেক্যুলার ব্যক্তিদের স্থলে ক্যাথলিক ধর্মযাজকদেরকে অধিক হারে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। চার্চে ব্যাপক হারে অনুদান প্রদান এবং সাম্রাজ্যজুড়ে নতুন নতুন ডায়োসিস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হেনরি তাঁর শাসনের ভিতকে মজবুত করেছিলেন এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তাঁর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছিলেন।

দ্বিতীয় হেনরির মতো স্যালিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় কনরাডও চার্চের ক্ষমতায়নের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চার্চ সংগঠনকে রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজন্য তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চার্চের বিশপদেরকে বহাল করেছিলেন; সেক্যুলার লর্ডদের ওপরে স্থান দিয়েছিলেন চার্চের বিশপদেরকে। দ্বিতীয় হেনরির মতো কনরাড ইতালির ওপর বিশেষ করে রোম নগরীর ওপর সদয় দৃষ্টি বজায় রেখেছিলেন।


চিত্র: ক্লুনির মঠ

প্রশাসনিক কাজে বিশপদের নিয়োগের এ ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়েও বজায় থাকে। কেবল প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজারা অনেক সময় চার্চ সংগঠনের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্যও তাদের পছন্দের ব্যক্তি নির্ধারণ করে দিতেন। যাজকীয় দপ্তরগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব রাজকীয় হস্তক্ষেপ ছিল ধর্মীয় এখতিয়ার বহির্ভূত। তবে একাদশ শতকের পূর্বে এ নিয়ে চার্চের তেমন কোন অভিযোগের কথা জানা যায় না যদিও এর বহু পূর্বেই শুরু হওয়া ক্লুনি মঠের (মনাস্টেরি) সংস্কার আন্দোলনের ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে ধীরে ধীরে সমালোচনার চোখে দেখা হচ্ছিল।

দশম শতাব্দী থেকেই পশ্চিম ইউরোপের মঠবাসী সন্ন্যাসীদেরকে জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখার জন্য মঠগুলোতে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বারগান্ডির ক্লুনিতে অবস্থিত একটি মঠ ছিল এই সংস্কার আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। ক্লুনির মঠটি সংস্কার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখায় এ সংস্কার কর্মসূচিটি ‘ক্লুনির সংস্কার’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। সামন্ততন্ত্রের প্রভাবে যে মঠবাসী সন্ন্যাসীরা আধ্যাত্মিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন তাদেরকে মূল আদর্শে ফিরিয়ে আনাই ছিল ক্লুনির সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য।


চিত্র: পোপ দ্বিতীয় নিকোলাস

সংস্কারপন্থীরা চেয়েছিলেন মনাস্টেরি চার্চগুলোকে চার্চ বহির্ভূত ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে এবং মনাস্টেরিগুলোর স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে। তাদের এ প্রচেষ্টা একটি সফল সংস্কার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। তবে ক্লুনির মঠ পরবর্তীতে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে। এ সময় পোপ নেতৃত্বাধীন চার্চ সংগঠন ক্লুনির মঠের মতই রাজা বা সামন্তপ্রভুদের প্রভাবমুক্ত হতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের সাথে চার্চের এ বিরোধ চরম রূপ নিয়েছিল পোপ সপ্তম গ্রেগরি ও স্যালিয়ান সম্রাট চতুর্থ হেনরির সময়ে।

চার্চ ও রাষ্ট্রের বিরোধের বিষয়টির গভীরে যাওয়ার পূর্বে দেখা প্রয়োজন এ বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন ছিল। দশম ও একাদশ শতাব্দীতে অটোনিয়ান-স্যাক্সন রাজবংশ এবং স্যালিয়ান-ফ্রাঙ্কিশ রাজবংশের সম্রাটরা জার্মানি রাজ্যটিকে কেন্দ্র করে তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্যকে সুসংহত করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা চার্চ ও যাজকদের সহযোগিতাও পেয়েছিলেন। তখন চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

জার্মানিকে কেন্দ্র করে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ সুসংহত হওয়ার পাশাপাশি চার্চ ও পোপতন্ত্রও সুসংগঠিত হচ্ছিল। চার্চ ও পোপতন্ত্রের শক্তি, সম্পদ ও প্রভাব বৃদ্ধিতে তখন জার্মান রাজতন্ত্রের সরাসরি সহযোগী ভূমিকা ছিল। অটোনিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় হেনরি ও স্যালিয়ান সম্রাট তৃতীয় হেনরি ছিলেন চার্চের ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে তখনকার পোপরাও চার্চের ওপর এসব সম্রাটদের কর্তৃত্বকে মেনে নিয়েছিলেন। তাই চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়নি।

একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চার্চ ও রাষ্ট্রের এ সম্পর্কে ফাঁটল ধরে। পোপের ক্ষমতা তখন হঠাৎ করে নবপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে কোন কোন পোপ চার্চের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করলেও তা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। মধ্য ইতালির পোপীয় রাষ্ট্রটি সবসময়েই জার্মানি-ইতালির রাজার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পোপ নাটকীয়ভাবে খ্রিষ্টান দুনিয়ার নেতৃত্বে চলে আসেন। চার্চের ক্ষমতাকে সুসংহত করে তিনি ক্রমে সম্রাটের প্রতিপক্ষে পরিণত হন।

পোপতন্ত্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কে প্রথম ফাঁটল ধরে সম্রাট তৃতীয় হেনরির মৃত্যুর পর। আগেই বলা হয়েছে সম্রাট তৃতীয় হেনরি পোপতন্ত্রের সহযোগী ছিলেন। কিন্তু ১০৫৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তৃতীয় হেনরির মৃত্যুর পর জার্মানির সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেন তাঁর ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্র চতুর্থ হেনরি। কিন্তু চতুর্থ হেনরি নিতান্ত বালক হওয়ায় তাঁর রিজেন্ট হিসেবে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের’ দায়িত্ব হাতে তোলে নিয়েছিলেন রাজমাতা অ্যাগনেস অভ আকিতাইন। এ সময় রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভিত্তি যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়ে।

এমতাবস্থায় ১০৫৮ সালে রোমের নতুন পোপ হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন দ্বিতীয় নিকোলাস। পোপ দ্বিতীয় নিকোলাস রাষ্ট্রের দুর্বলতার সুযোগে চার্চের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পথ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। চার্চের সংস্কার ও জার্মানির দুর্বল ‘রিজেন্সি’ সরকারের কর্তৃত্ব ও প্রভাব থেকে রোমান চার্চকে মুক্ত করার জন্য তিনি শক্তিসঞ্চয়ের চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশী শক্তির সাথে আঁতাত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

১০৫৯ সালে তিনি নর্মানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁর আহ্বানে সাঁড়া দিয়ে নর্মানরা চার্চ ও পোপতন্ত্রকে সাহায্য করতে রাজী হয় এবং রোমে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। এদের সহায়তায় পোপ চার্চের সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। দ্রুত সফলতা লাভ করায় পোপের চার্চ সংস্কার কর্মসূচিকে অনেক অভিজাতও সমর্থন দিয়েছিলেন। এসব অভিজাতরা ক্লুনির সংস্কার আন্দোলনের জোরালো সমর্থক ছিলেন।


চিত্র: সিসিলির নর্মান রাজ্য

পোপ বুদ্ধি করে ক্লুনির সংস্কার আন্দোলনেও সহযোগী ভূমিকা পালন করেন। তিনি মঠের (মনাস্টেরি) বিশপদেরকে ধর্মপ্রচার ও আরাধনার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মঠসংস্কার আন্দোলনকে বেগবান করার চেষ্টা করেন। এতে পশ্চিম ইউরোপের চার্চ আরও সুসংগঠিত হয়। পোপ নিকোলাসের সময় এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে শাসকবর্গের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতা রহিত করা হয়।

পোপ দ্বিতীয় নিকোলাস মারা গিয়েছিলেন ১০৬১ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর নতুন পোপ নিয়োগের ব্যাপারে রোমের সংস্কারবাদী বিশপদের সাথে জার্মানির রিজেন্সি সরকারের বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে। সংস্কারবাদীরা রাজশক্তির পোপ নির্বাচনের অধিকারে বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা কেবল কার্ডিনালদের দ্বারা নির্বাচিত পোপকেই বৈধ পোপ বলে ঘোষণা দেন। রোমের যেসব বিশপরা পোপ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার রাখতেন তাদের উপাধী ছিল ‘কার্ডিনাল’।

দ্বিতীয় নিকোলাসের পর জার্মান রিজেন্সি ক্যাডালুকস নামে জনৈক বিশপকে পোপ পদে নিয়োগ দেন। অন্যদিকে রোমের কার্ডিনালরা আনসেম নামে জনৈক বিশপকে পোপ হিসেবে নির্বাচিত করেন। তারা জার্মান রিজেন্সি মনোনীত ক্যাডালুসকে পোপ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এর ফলে একই সময়ে দুজন পরস্পর বিরোধী পোপের অস্তিত্ব দেখা দেয়। ক্যাডালুসের মৃত্যু পর্যন্ত চার্চের এই অচলাবস্থা চলতে থাকে।


চিত্র: পোপ সপ্তম গ্রেগরি

এর পরবর্তীতে র্চার্চ ও রাষ্ট্রের এই বিরোধকে চূড়ান্ত রূপদান করেন পোপ সপ্তম গ্রেগরি। প্রশ্ন হলো এ পরিস্থিতিতে তাকে পোপ বানিয়েছিল কে? জার্মান রাষ্ট্রশক্তি নাকি রোমের কার্ডিনালরা? মজার ব্যাপার হলো এ দু’পক্ষের কোন পক্ষই তাকে পোপ নির্বাচিত করেনি। নাটকীয়ভাবে তাকে পোপ হিসেবে নির্বাচিত করেছিল রোমের জনগণ। সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে সম্রাট কর্তৃক পোপ নিয়োগের যে রীতি প্রচলিত ছিল সে রীতি অনুযায়ী সম্রাটের কাছ থেকে বিশেষ প্রতীক সম্বলিত আংটি ও দণ্ড গ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন পোপ তাঁর পদে অধিষ্ঠিত হতেন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরি প্রচলিত প্রথার বাইরে এক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে পোপ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১০৭৩ সালের ২২ এপ্রিল। সেদিন ছিল সদ্য প্রয়াত পোপ দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃতদেহ সমাধিস্থ করার দিন। প্রয়াত পোপ দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রোমের শোকাকূল জনতার প্রচণ্ড ভীড় সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। উপস্থিত হাজার হাজার জনতার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন: কে হবেন রোমের নতুন পোপ?

পোপ দ্বিতীয় নিকোলাসের সময় শাসকবর্গের পোপ নিয়োগের অধিকার রহিত করে যে ডিক্রি জারি করা হয়েছিল সে ডিক্রি সম্পর্কে জনসাধারণ অবহিত ছিল। এ ডিক্রির প্রতি তাদের সমর্থন ছিল অর্থাৎ পোপ নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজাতবর্গ কিংবা সম্রাটের হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিল তারা। তাই উপস্থিত জনতা সেদিন দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়; পোপ নিয়োগের অধিকার জনতা নিজের হাতেই তোলে নেয়।

পূর্ববর্তী নিয়ম অনুযায়ী কোন পোপ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর শব সৎকার, অনশন পালন ও নানারূপ আচার অনুষ্ঠানের পর রাজকীয় পছন্দ অনুযায়ী নতুন পোপ নির্বাচন করা হতো। কিন্তু সেদিনের বিপ্লবী জনতা সকল প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নতুন পোপ নিয়োগের অধিকার নিজেদের হাতেই তোলে নেয়। তাঁরা আচার অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে ছুটে যায় জনপ্রিয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সপ্তম গ্রেগরির কাছে এবং কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে পোপের খালি আসনে বসিয়ে দেয়। এভাবে জনসাধারণের দ্বারা অভিষিক্ত হওয়ার এক নাটকীয় ঘটনা পোপতন্ত্রের ইতিহাসে স্থান করে নেয়।

অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে পোপ পদে আসীন হওয়ার পর পোপ সপ্তম গ্রেগরি শক্ত হাতে চার্চ সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পোপ দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মতো আপোষকামী মনোভাব তাঁর মধ্যে ছিল না। পোপতন্ত্রকে স্বাধীনতা ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করার জন্য তিনি আপসহীন ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। চার্চ সংগঠন ও পোপতন্ত্রের মর্যাদাকে রাষ্ট্রের চেয়েও ওপরে অধিষ্ঠিত করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরি সম্রাট কর্তৃক পোপ নিয়োগের প্রথার স্পষ্ট বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, পোপ সরাসরি ইশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করেন। পোপ পৃথিবীতে ইশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এ কারণে পোপ পৃথিবীতে কারও অধীন হতে পারেন না। ইশ্বর ছাড়া অন্য কারও কাছে পোপের কাজের জবাবদিহিতা উচিত হতে পারে না। সপ্তম গ্রেগরি দাবী করেন যে, পোপ ইশ্বরের অধীন আর ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলেই পৃথিবীর সকল মানুষ পোপের অধীন।


চিত্র: ডিক্টেটাস পাপা গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা

পোপ সপ্তম গ্রেগরি ইউরোপের সমস্ত চার্চের বিশপদের ওপর এই মর্মে আদেশ জারি করেন যে, তারা সামন্ত অভিজাতদের সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র পোপের অধীনস্ত হবে এবং কেবলমাত্র পোপের আদেশই অনুসরণ করবে। তিনি পোপের অধিকার ও ক্ষমতাসংক্রান্ত দলিলপত্র সংগ্রহ করে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।

১০৭৫ সালে তিনি তাঁর নতুন বিধান সম্বলিত গ্রন্থ ‘ডিক্টেটাস পাপা’ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর অভিমতের সপক্ষে নানা দলিল ও যুক্তি পেশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি পোপের সার্বভৌম ক্ষমতার পক্ষে নানা যুক্তি তোলে ধরেন। শুধু তাই নয়, তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান যে, পোপ এমনকি সম্রাটকেও ক্ষমতাচ্যুত করার পূর্ণ ও আইনানুগ অধিকার রাখেন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরির ‘ডিক্টেটাস পাপা’ গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এ গ্রন্থটি খ্রিষ্টান দুনিয়ার এক নতুন মেরুকরণের পর্বকে তোলে ধরেছিল। ইতোপূর্বে খ্রিষ্টধর্মের সংস্কার আন্দোলন, বিশেষ করে ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন চার্চকে রাজনৈতিক তথা জাগতিক বিষয় থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল। মূলত সমন্তপ্রভূদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই সংস্কারবাদীরা চার্চকে জাগতিক ক্ষমতার সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখে কেবল আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই নিয়োজিত রাখতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সপ্তম গ্রেগরির সময়ে সমাজের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় চার্চকে জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা কমে গিয়েছিল। সপ্তম গ্রেগরি তাঁর বইয়ে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই চার্চের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। পূর্ববর্তী সংস্কারবাদীদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা অর্জিত হওয়ায় চার্চের জাগতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে সামন্তপ্রভু বা রাষ্ট্রের অধীনস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আর তেমনভাবে ছিল না। তাই পোপ গ্রেগরি এবার উল্টো সুরে কথা বলতে শুরু করেন।

তিনি তাঁর বইয়ে চার্চের জাগতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তোলে ধরেন এ কারণেই যে ক্ষমতার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জাগতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে চার্চের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নয় বরং উল্টো রাষ্ট্রের ওপর চার্চের কর্তৃত্বের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তাঁর বইয়ে পোপের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও কর্মকাণ্ডের পক্ষে যুক্তি তোলে ধরেন। তিনি উদাহরণস্বরূপ পোপ জ্যাকারিয়াস কর্তৃক শেষ মরোভিঞ্জিয়ান রাজাকে বহিস্কারের ঘটনা উল্লেখ করেন এবং সেইন্ট আমব্রোস কর্তৃক সম্রাট থিওজেসিয়াসকে সমাজচ্যুত করার ঘটনাও তোলে ধরেন।

এই উদাহরণগুলো সামনে রেখে তিনি প্রমাণ করেন যে, কেবল চার্চ সংগঠনই নয় খ্রিষ্টানজগতের রাষ্ট্রও পোপের অধীন; পোপ চাইলে খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যের সম্রাটকে অপসারণ করতে পারেন ও নতুন সম্রাট নিয়োগ দিতে পারেন। এভাবে পোপ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে শাসকবর্গের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে পোপ প্রথমেই শাসকবর্গের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নামলেন না। তিনি প্রথমে পুরো ক্যাথলিক ইউরোপের যাজকসম্প্রদায়ের ওপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন।

ক্যাথলিক ধর্মজগতের ওপর যাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পোপ সপ্তম গ্রেগরি কঠোর ধর্মসংস্কারের পথ বেছে নেন। তিনি যাজকদেরকে বিয়ে ও সাংসারিক জীবন থেকে দূরে রাখার জন্য তাদের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। বিবাহিত যাজকদেরকে তিনি অপছন্দ করতেন। তিনি নিয়ম করেন যে, বিবাহিত যাজকগণ স্যাকরামেন্ট অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন না। এসব বিধি-নিষেধ মেনে নেওয়া অনেক চার্চের বিশপদের জন্য বেশ কষ্টকর ছিল।


চিত্র: সম্রাট চতুর্থ হেনরি

তবুও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের চার্চগুলো পোপের আদেশ মেনে নেয়। কিন্তু জার্মানির বহু চার্চ সহজে পোপের আদেশ মেনে নিতে চায়নি। জার্মানির অনেকগুলো চার্চ পোপের অবাধ্য হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর অতিরিক্ত কঠোরতা। পোপ বিবাহিত বিশপদেরকে তাদের স্ত্রী-সন্তান পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পোপের এই অমানবিক কঠোর নির্দেশ মেনে নিতে চাননি জার্মানির বহু বিশপ। তারা পোপের প্রতিনিধিদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

এতে পোপ তাদের ওপর ভয়ানকভাবে রুষ্ট হন। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি কিছুটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত এসব বিশপরা পোপের প্রতি তাদের অবাধ্যতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেননি। পোপ সপ্তম গ্রেগরি ধীরে ধীরে ক্যাথলিক যাজকসম্প্রদায়ের ওপর তাঁর অবাধ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। যাজকসম্প্রদায়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের পর পোপ রাষ্ট্রশক্তির ওপর তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপনের পথে অগ্রসর হন।

জার্মানিতে তখন আর রিজেন্সি সরকার নেই। চতুর্থ হেনরি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর জার্মানির রাজার দায়িত্ব নিয়েছেন। পোপ তাঁর প্রচারিত বিধান অনুযায়ী জার্মানি-ইতালির রাষ্ট্রশক্তির ওপরে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হন। জার্মানির রাজার সাথে তিনি প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ১০৭৫ সালে। সেবছর অনুষ্ঠিত লেন্ট সম্মেলনে তিনি ‘ধর্মবিরোধী আচরণের’ জন্য চতুর্থ হেনরির পাঁচজন প্রধান পরামর্শককে সমাজচ্যুত করার আদেশ দেন।


চিত্র: পোপ গ্রেগরির নেতৃত্বাধীন সামন্ত নৃপতিগণ

এই সমাজচ্যুতির ব্যাপারে তিনি চতুর্থ হেনরিকে পূর্ব থেকে কোন কিছু অবহিত করেননি। এর মাধ্যমে তিনি চতুর্থ হেনরিকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি চতুর্থ হেনরিকেও সমাজচ্যুত ও ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার রাখেন। এরপর পোপ হস্তক্ষেপ করলেন সামন্ততন্ত্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ ইনভেস্টিচার প্রথার ব্যাপারে। সামন্ততন্ত্রী ইউরোপের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী যে অনুষ্ঠানে একজন ধর্মযাজক কিংবা সামন্ত ভূস্বামী তাঁর উর্দ্ধতন সামন্তপ্রভুর ‘ভাসাল’ বা অনুগত মিত্রে পরিণত হতেন সে অনুষ্ঠানকে ইনভেস্টিচার অনুষ্ঠান বলা হতো।

ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে সামন্ত ভূস্বামীরা সরাসরি রাজার অধীনস্ত থাকতেন না। মাঝখানে কতগুলো ধাপ বজায় ছিলো। অবশ্য দেশের জমির মালিক থাকতেন রাজাই। রাজার কাছ থেকে ভূস্বামীরা সরাসরি জমি পেতেন না। রাজার কাছ থেকে হয়ত ডিউক পেতেন, ডিউকের কাছ থেকে ব্যারন; ব্যারনের কাছ থেকে নাইট। একজন নাইটের উর্দ্ধতন সামন্তপ্রভু ব্যারন, ব্যারনের ওপরে ডিউক, ডিউকের ওপরে রাজা।

এক্ষেত্রে অধঃস্তন ব্যক্তি উর্দ্ধতন ব্যক্তির ‘ভাসাল’ বা ‘অনুগত মিত্র’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন। অধঃস্তন ভাসালকে জমি দেয়া হতো এই শর্তে যে, তিনি নিজের সৈন্য নিয়ে তাঁর উর্দ্ধতন সামন্তপ্রভুর পক্ষে লড়বেন। এ ধরণের শর্তাধীনে জমি প্রদানকে বলা হতো ‘ফিউড’। ফিউড থেকে ফিউডালিজম শব্দের উৎপত্তি। এ পদ্ধতিতে ভূস্বামী ভাসাল তাঁর প্রভুর স্বার্থ সংরক্ষণ এবং প্রভুর দুঃসময়ে তাকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রদানে বাধ্য থাকতেন।

যে অনুষ্ঠানে একজন অধঃস্তন সামন্ত ভূস্বামী নতজানু হয়ে তাঁর উর্দ্ধতন সামন্তপ্রভুর কাছ থেকে ভাসাল হিসেবে স্বীকৃতি গ্রহণ করতেন সে অনুষ্ঠানকে ইনভেস্টিচার অনুষ্ঠান বলা হতো। ইনভেস্টিচারের সময় উর্দ্ধতন সামন্তপ্রভু তাঁর অনুগত ভাসালকে স্বীকৃতির প্রতীক হিসেবে নির্দিষ্ট প্রতীক খচিত আংটি ও দণ্ড প্রদান করতেন। ক্যাথলিক বিশপদেরকেও একইভাবে নতজানু হয়ে স্থানীয় সামন্তপ্রভুর ভাসাল হতে হতো। এভাবে তারা স্থানীয় ভূস্বামীর ক্ষমতার কাছে বাঁধা পড়তেন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরি ধর্মযাজকদের জন্য ইনভেস্টিচার প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পোপ এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেন যে, একজন যাজকের জন্য যাজক নয় এমন ব্যক্তির সামনে নতজানু হয়ে আনুগত্য স্বীকার করা সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী কাজ। অনেক ক্ষেত্রে যাজকদেরকে বিধর্মী সামন্তপ্রভুর ইনভেস্টিচার অনুষ্ঠানেও যেতে হতো। পোপ ঘোষণা করেন যে, বিশপদের নিযুক্তি বা পদচ্যুতির ক্ষমতা একমাত্র পোপের হাতেই সংরক্ষিত এবং ইনভেস্টিচার অনুষ্ঠানে যাজকদেরকে যে আংটি ও দণ্ড প্রদান করা হয় তা এখন থেকে তিনিই প্রদান করবেন। পোপ গ্রেগরি তাঁর ‘ডিক্টেটাস পাপা’ গ্রন্থে যেসব মূল বক্তব্য তোলে ধরেন তাঁর মধ্যে অন্যতম হল:

ক) ক্যাথলিক চার্চ ইশ্বরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
খ) পোপ তাঁর সকল কাজের জন্য কেবল ইশ্বরের কাছেই দায়বদ্ধ।
গ) বিশপদের নিযুক্তি বা পদচ্যুতির ক্ষমতা একমাত্র পোপের হাতেই সংরক্ষিত।
ঘ) সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃত্বও পোপের হাতে সংরক্ষিত। পোপ চাইলে যে কোন শাসককে এবং এমনকি সম্রাটকেও পদচ্যুত করতে পারেন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরি ঘোষণা দেন যে, কেউ তাঁর আদেশ অমান্য করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হবে। পোপের এসব কর্মকাণ্ড তাকে রাষ্ট্রের সাথে মুখোমুখী সংঘাতের পথে নিয়ে যায় এবং একসময় পাল্টাপাল্টি বহিস্কারের ঘটনা ঘটে। পোপ কর্তৃক জার্মানির রাজা চতুর্থ হেনরির পাঁচজন প্রধান পরামর্শক সমাজচ্যুত হওয়ার পর চতুর্থ হেনরি পোপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেন।

তিনি পোপের প্রতি অসন্তুষ্ট বিশপদেরকে তাঁর দলে ভেড়াতে চেষ্টা করেন। এসব বিশপদেরকে সাথে রেখে তিনি লম্বার্ডির সিংহাসন সুরক্ষার জন্য অগ্রসর হন। অন্যদিকে পোপও বসে থাকলেন না। তিনি রাজাকে পোপের অধীনতা মেনে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার আদেশ প্রদান করেন। অন্যথায় তিনি রাজাকে সমাজচ্যুত করবেন বলে হুমকি দেন।


চিত্র: অ্যাপিনাইন পর্বতের উপর অবস্থিত ক্যানোসা দূর্গ

চতুর্থ হেনরি উল্টো পোপকে পদচ্যুত করার জন্য ১০৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মানির বিশপদেরকে নিয়ে এক ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওয়ার্মস শহরে আয়োজিত এ ধর্ম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, “পোপ সপ্তম গ্রেগরি যে প্রক্রিয়ায় পোপ নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটি খ্রিষ্টধর্মসম্মত নয়। তাই পোপ পদে থাকার ধর্মীয় বৈধতা তাঁর নেই এবং এ কারণে তাকে পোপ পদ থেকে বহিস্কার করা হল।”

চতুর্থ হেনরি পোপ সপ্তম গ্রেগরির কাছে পত্র পাঠিয়ে তাকে এই বহিস্কারাদেশের ব্যাপারে অবহিত করেন এবং তাকে জানিয়ে দেন যে, তাঁর আর পোপ পদে থাকার অধিকার নেই। এবার পোপ সপ্তম গেগরি রাজা চতুর্থ হেনরিকে পাল্টা বহিস্কারের জন্য রোমে আরেকটি ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে চতুর্থ হেনরিকে সমাজচ্যুত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এর অর্থ হলো পোপীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চতুর্থ হেনরি ধর্মচ্যুত হয়েছেন এবং এখন থেকে চতুর্থ হেনরির অধীনস্ত কেউ রাজদ্রোহে লিপ্ত হলে তা আর ধর্মীয়ভাবে পাপ বলে বিবেচিত হবে না। এভাবে চতুর্থ হেনরিকে অমান্য করার ব্যাপারে সামন্ত ভূস্বামীদেরকে উৎসাহিত করা হলো। পোপ ও রাজার মধ্যে এই প্রত্যক্ষ সংঘাত জার্মানিকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছিল।

এই সংঘাতের ফলে চতুর্থ হেনরির ক্ষমতা আশংকাজনকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ জার্মানি ও স্যাক্সনির অনেক যাজকের পাশাপাশি অনেক ভূস্বামীও রাজার পক্ষ ত্যাগ করেছিল। এরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটি ধর্মীয় আইনগত ভিত্তি পেয়ে গিয়েছিল। পোপের নেতৃত্বাধীন এই সম্মিলিত শক্তি জার্মানির অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিল।

জার্মানির এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী চতুর্থ হেনরিকে অপসারণ করে নিজেদের ক্ষমতা মজবুত করার জন্যই পোপের পক্ষ নিয়েছিল। তারা চতুর্থ হেনরিকে কোনঠাসা করার জন্য পোপকে ব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করে। তারা পোপকে জার্মানিতে আসার আমন্ত্রণ জানায়। জার্মানিতে একটি ধর্ম সম্মেলনে পোপের আসার কথা ছিল।


চিত্র: ক্যানোসা দূর্গের সামনে চতুর্থ হেনরি ও তাঁর পরিবার

এই ধর্ম সম্মেলনে চতুর্থ হেনরিকে সিংহানচ্যুত ঘোষণা করে পোপ কর্তৃক নতুন উত্তরাধিকারী মনোনয়নের কথা ছিল। অন্যদিকে তাঁরা চতুর্থ হেনরিকে শেষ সুযোগ দিয়ে এই মর্মে প্রস্তাব পাঠান যে, ১০৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে তিনি চাইলে পোপের সাথে আপসরফা করতে পারেন। চতুর্থ হেনরি জার্মানিতে সম্মেলনের পূর্বেই পোপের কাছে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নিলেন।

এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রচণ্ড শীতে আল্পস পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছালেন। তিনি পোপের কাছে পৌঁছার পূর্বেই পোপ গোপনে এই আগমণের সংবাদ পেয়ে গিয়েছিলেন। এই আগমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পোপের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তিনি অ্যাপিনাইন পর্বতের উপর অবস্থিত ক্যানোসা দূর্গে অবস্থান নেন। চতুর্থ হেনরি পোপের সাক্ষাতের আশায় তিন দিন তিন রাত ধরে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে সেই দূর্গের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন।

১০৭৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ছিল অপেক্ষার চতুর্থ দিন। এদিন পোপ চতুর্থ হেনরির সাথে দেখা করতে রাজী হন। চতুর্থ হেনরি পোপের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যাজক হিসেবে পোপ একজন অনুতপ্ত ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করতে বাধ্য ছিলেন। ফলে পোপ চতুর্থ হেনরির সমাজচ্যুতির ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু এই ঘটনা জার্মানির গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারেনি। জার্মানির রাজদ্রোহী সামন্তরা পুনরায় চতুর্থ হেনরিকে সিংহাসনে দেখতে চায়নি। তারা চতুর্থ হেনরির বিরুদ্ধে জার্মানির ফর্কহেইমে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। ১০৭৭ সালের মার্চ মাসে আয়োজিত এ সম্মেলনে তারা জার্মানির নতুন রাজা মনোনীত করে সোয়াবিয়ার ডিউক রুডলফকে। এতে জার্মানিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

এর পরবর্তী বছর চতুর্থ হেনরি কয়েকটি সামরিক বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হন। জার্মানির এই গৃহযুদ্ধের সংকট সমাধানের জন্য পোপ সপ্তম গ্রেগরি ১০৭৯ সালে জার্মানিতে তাঁর দুজন প্রতিনিধি পাঠান। চতুর্থ হেনরি পোপের প্রতিনিধিদের আপোষ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতে পোপ অপমানিত বোধ করেন।

তিনি চতুর্থ হেনরিকে পুনরায় সমাজচ্যুত ও সিংহাসনচ্যুত ঘোষণা করেন এবং একই সাথে রুডলফকে জার্মানির বৈধ রাজা ঘোষণা করেন। ক্ষুদ্ধ চতুর্থ হেনরিও পুনরায় পোপকে পদচ্যুত করার উদ্যোগ নেন। তিনি তাঁর অনুগত বিশপদেরকে নিয়ে ১০৮০ সালে একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে পোপ সপ্তম গ্রেগরির স্থলে রাভেনার গুইবার্টকে নতুন পোপ ঘোষণা করা হয়।


চিত্র: চতুর্থ হেনরির অনুশোচনা

চতুর্থ হেনরি তাঁর এ কাজে জার্মান বিশপদের তেমন সমর্থন পাননি। চার্চের সমস্ত আইন ও ঐতিহ্যকে পদদলিত করে এভাবে নতুন পোপ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ায় জার্মানির অধিকাংশ বিশপ চতুর্থ হেনরির সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। এতে অবশ্য তিনি দমে যাননি। পোপের স্থলে যেনোতেনোভাবেই হোক নতুন পোপ নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন তিনি।

চতুর্থ হেনরির এ সম্মেলনের পর নতুন করে পোপতন্ত্রের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সংঘাত শুরু হয়। তবে এবার পোপ সপ্তম গ্রেগরির ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না। ১০৮০ সালেই চতুর্থ হেনরির সাথে যুদ্ধে রুডলফ নিহত হয়েছিলেন। চতুর্থ হেনরি ক্রমে জার্মানিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। পোপ সপ্তম গ্রেগরির ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি ১০৮১ সালে ইতালির দিকে অগ্রসর হন।

পোপ সপ্তম গ্রেগরি আত্মরক্ষার জন্য দক্ষিণ ইতালির নর্মানদের সাহায্য গ্রহণ করেন। পরপর দু’বার ব্যর্থ হওয়ার পর ১০৮৩ সালে চতুর্থ হেনরি সফলভাবে রোম আক্রমণ ও দখল করেন। এরপর তিনি তাঁর মনোনীত পোপ গুইবার্টকে পোপের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। গুইবার্ট ‘তৃতীয় ক্লিমেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১০৮৪ সালে এই পুতুল পোপের হাতে চতুর্থ হেনরি ‘ইতালির রাজা’ ও ‘পবিত্র রোমান সম্রাট’ হিসেবে অভিষিক্ত হন।

অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত পোপ সপ্তম গ্রেগরি তাঁর সাথীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো দূর্গে। ১০৮৪ সালে সপ্তম গ্রেগরির সমর্থনে দক্ষিণ ইতালির নর্মান শাসক রবার্ট গুইসকার্ড তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। এতে সম্রাট চতুর্থ হেনরি পিছু হটে যান এবং সপ্তম গ্রেগরি মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সপ্তম গ্রেগরির পিছু ছাড়েনি।

তাঁর উদ্ধারকারি সৈন্যরা তাঁর আদেশের প্রতি সম্মান দেখায়নি। তারা তাকে উদ্ধারের পরপরই ইতলিতে অবাধ লুন্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। তাঁর মিত্রদের এই আচরণ তাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। তিনি রোমের জনসাধারণের সামনে আর যেতে চাইলেন না। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই পোপ স্বেচ্ছানির্বাসনের পথ বেছে নিলেন। শেষ পর্যন্ত ১০৮৫ সালে তিনি নর্মানদের আশ্রয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:০২
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×