সেদিনের কথা আজো মনে পড়ে। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি। অনার্স জীবনের প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছিল সেদিন। অনেক জ্ঞানী-গুণি শিক্ষেকের মাঝে আমরা তখন নিতান্তই শিশু। মনের ভিতর অসীম উদ্দীপনা, একদিকে ভাললাগা, অন্যদিকে বুকের ভিতর দূরু দূরু কাঁপন- নতুন জায়গা; নতুন পরিবেশ; নতুন ক্লাস; নতুন শিক্ষক; নতুন আরো যে কত কি!!
প্রথম কয়েকটি ক্লাসে মুগ্ধ হলাম। স্যারদের লেকচার, অসাধারণ যুক্তিনিষ্ঠতা আর অগাধ জ্ঞান ভাণ্ডার দেখে আমার মুগ্ধতার সীমা রইল না। মনে হল ইশ!! যদি আরো কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারতাম!!
কিন্তু পরক্ষণেই যে আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে এমন ঘোর বিপত্তির উদয় হবে কে জানতো? পরবর্তী ক্লাসে উপস্থিতি দেয়ার সময় "yes sir" বলে পড়লাম মহা বিপাকে। বাংলা বিভাগের ছাত্র হয়ে ইংরেজ আচরণ! এই আমাদের ভাষা প্রেম!! তারপর সে কি অপমান! আমাদের কয়েকজনকে তো ক্লাস থেকেই বের করে দিলেন ক্লাস টিচার। অজান্তেই ঐ শিক্ষককে নিয়ে মনের মধ্যে এক দূর্দান্ত ভয় বাসা বেঁধে নিল। মনে হল, বাবা যেন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এ সংসারে আমার আর কোথাও জায়গা নেই।
বলছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার প্রিয় শিক্ষাগুরু ড. মিজানুর রহমান খান (প্রফেসর বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) সম্পর্কে। একটা মানুষ যে এত ভাল হতে পারে ঐদিন তা বুঝতে পারিনি। আর যখন বুঝেছি তখনই তিনি চলে এসেছেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বের তালিকায়।
প্রথম প্রথম স্যারকে দেখলে অনেক দূর দিয়ে যেতাম। মনের ভিতরে সেই ভয়টা তখনও ছিল। একদিন হঠাৎ করেই স্টেডিয়ামের সামনে স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। আগে থেকে স্যারকে দেখতে পেলে হয়ত দূর দিয়ে যেতাম। কিন্তু হঠাৎ সামনা সামনি হয়ে যাওয়াতে পালানোর কোন উপায় ছিল না। কি আর করা। অগত্যা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। একবুক সাহস নিয়ে স্যারের সাথে কথা বললাম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না কিভাবে স্যারের সাথে কথা বলে ফেললাম। একটা জিনিস খুব ভালভাবে লক্ষ করলাম কিন্তু ক্লাসরুমের মিজান স্যার আর বাইরের মিজান স্যারকে কিছুতেই এক করতে পারলাম না। মানুষ এতটাও আন্তরিক হতে পারে!!
এই মানুষটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে উঠল। গতদিন কথা বলে যে সাহসটুকু পেয়েছিলাম সেই সাহসটাই কাজে লাগালাম। ক্লাসরুমের বাইরে- বিশেষ করে প্রতিটি পিকনিকে, প্রতিটি খেলার মাঠে, নিরিবিলি চেম্বারে একজন আদর্শ মানুষের পরিচয় পেতে লাগলাম। তাঁর কথার যেমন তেজ, তেমনি যুক্তিনিষ্ঠতা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান এমন কিছু নেই যা তাঁর ছায়াতলে থেকে শিক্ষা নেয়া যায় না। তারপর থেকে যতদিন যেতে লাগল ততই তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে ভয়টা ভালবাসায় রুপান্তরিত হল।
একজন শিক্ষক- অথচ তিনি কখনো হয়ে ওঠেন বন্ধুর মত, কখনো বাবার মত, কখনো বড় ভাইয়ের মত আবার কখনো হয়ে ওঠেন নির্মম শাসক।
ভয়?? ভালবাসার মানুষ একটু ভয় দেখালে মিষ্টিই লাগে মনে হয়।