‘ফাঁস ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর কল্যাণে প্রতিনিয়ত ‘বিজয় মশাই’ আমাদের দরজায় টাক্ টাক্ করে বলছেন, ‘সুস্থ আছেন তো?’ প্রসঙ্গত একটি গানের লাইন মনে পড়ছে, ‘পাগল মন-মন রে, মন কেন এত কথা বলে!’ মনের এই দুর্বলতা বা সবলতার সুযোগে গিট্টু খুলে বেরিয়ে আসে গোপন সব কথা। ফুরুৎ করে ফাঁস হয়ে যায় বাড়ির প্রতি ম্যাডামের মমতার কথা, তালপাখার প্রতি মন্ত্রী মহোদয়ের ভালোবাসার কথা। এসব ‘লাভ স্টোরি ফাঁস’ ছাড়াও ‘ফাঁস’ পরিবারে আরো আছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’, ‘তথ্য ফাঁস’, ‘দুর্নীতি ফাঁস’ ইত্যাদি। ফাঁসের ফাঁসে পড়ে ভুক্তভোগীদের হয় হাস-ফাঁস অবস্থা। তবুও ফাঁসের এই দুর্যোগ আছে বলেই বিজয়ের সুযোগ তৈরি হয়।
‘ফাঁসিং’ প্রক্রিয়া চলছে বিদেশেও। উইকিলিকস থলের বিড়াল ফাঁস করে দেওয়ায় অনেক আন্তর্জাতিক রুই-কাতলা ফেঁসে গেছেন। বেফাঁসের এই চলমান প্রক্রিয়ায় ‘ধ্রুপদী নৃত্য’ ছাড়া জনদরদীদের আর কিছুই করার নেই। অক্টোপাস ‘পল’ করত ভবিষ্যত ফাঁস আর জুলিয়ান ‘পল’ অ্যাসাঞ্জ করছেন অতীত ফাঁস! এজন্য অবশ্য জুলিয়ান পলকেও ফাঁসানো হয়েছে গুরুতর ইভ টিজিংয়ের অপরাধে। ভদ্রলোক গোপন তথ্য ফাঁসের আনন্দ লুটে নেবার পর জনগণের বন্ধু বলে পরিচিত পুলিশের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন; সেইসাথে ফেঁসে গেছেন রিমান্ডের ফাঁসে। ফাঁসাফাঁসির এ নাটক অন্যায়কে জয় করার পাশাপাশি পাবলিকের হাসাহাসির খোরাক যোগাচ্ছে।
কেউ ফাঁস করে, কেউ ফাঁসে পড়ে! যেমন: তহবিল সরানোর দোষে ফেঁসে গিয়েছেন ইউনূস সাহেব। ‘হুদাই লস্করি চাল’ চেলে ফেঁসেছেন আমাদের নাজমুল হুদা। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি ঠিকই; কিন্তু অ্যানালগ মন-মানসিকতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ফাঁসে আটকে যাচ্ছি। যেমন: ভণ্ড পীর-পীরানির বিরানি-পানি পড়া খেয়ে অনেক মহান ব্যক্তি বর্তমানে স্যালাইনের উপর আছেন। এসব জয় করতে পীর বাবাজির ভণ্ডামি ফাঁস করা জরুরি। মানুষের রয়েছে পাঁচটি সেন্স বা ইন্দ্রিয়। সেগুলো হলো: স্পর্শ, স্বাদ, ঘ্রাণ, দৃষ্টি এবং শ্রবণের ক্ষমতা। এগুলো ছাড়াও জীবনে জয়ী হতে আরেকটি ‘সেন্স’ অপরিহার্য। সেটা হলো ‘কমন সেন্স’! এসব ভণ্ডামি সনাক্তকরণে কমন সেন্স-ই ভরসা।
বর্তমানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল খাবারের ভেজাল। এখনকার অবস্থা দেখলে কবিগুরু নিজ দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘ওগো, আজ তোরা খাস নে ঘরের বাহিরে।’ কিন্তু আমরা ঘরের ভিতর সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি দেখেও যে সবজি রান্না করছি, তাতেও যে ফরমালিন। আমাদের পূর্বসুরী থুক্কু দক্ষিণসুরীরা মনে হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিঙিয়ে কেমিক্যাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে! ভেজাল জয়ের জন্য এদের পরিচয়কে আলোর মুখ দেখানো জরুরি।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য গোপন কথা ফাঁসের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে মহল্লার বেকার জনগোষ্ঠী। সেসব প্রতিযোগিতার নাম হতে পারে ‘গোপন ফাঁসের তারকা-তারকাদের তারকা’, ‘বেফাঁস ওয়ান-তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। এছাড়া আমরা ঘরে ঘরে ‘দুদক’ গড়ে তুলতে পারি। আসুন, এই বিজয়ের মাসেই আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। ‘গোপনীয়’ যা জানি, তা-ই ফাঁস করি। আমরা তো আর জ্বালাও-পোড়াও, ধর-পাকড় করতে পারব না; তাই ফাঁসের মাধ্যমে যদি দেশে মাঝারি মাত্রার বিবেক-কম্পনও ঘটাতে পারি, তাহলে তা জাতীয় জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই বিজয় লাভে সাহায্য করবে।