আন্তঃব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার সঙ্কট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ডলারের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে উভয় বাজারে বাড়ছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম। আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসায় এ সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। অপর দিকে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। অবমুক্ত হচ্ছে না বিদেশী ঋণ বা অনুদান। ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে পারছে না। কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল পাওয়ারের জন্য বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমদানি দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে। এতে সঙ্কটে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পরিসি'তি এমন অবস'ায় যাচ্ছে, সামনে প্রতি ডলারের দাম ১০০ টাকায় চলে যেতে পারে বলে বাজার বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান পরিসি'তি মোকাবেলার জন্য সরকারের কাছে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান নেই। তবে সরকারের ব্যয়ের খাত কমাতে হবে। কমাতে হবে অপ্রয়োজনীয় আমদানি। পাশাপাশি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান বাড়াতে হবে। অন্যথায় রিজার্ভ আরো কমে যাবে। ডলার সরবরাহ বাড়াতে না পারলে টাকার মান আরো কমে যাবে। এতে বাড়বে আমদানি ব্যয়। আর এর প্রভাব সরাসরি পড়বে মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ডলার সঙ্কট কাটাতে ও টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে ডলার সরবরাহ অবশ্যই বাড়াতে হবে।
আইএমএফের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে আকবর আলি খান বলেন, আইএমএফ ইতোমধ্যে অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বলেছে। পাশাপাশি সরকারের ব্যয় সঙ্কোচন করতে বলেছে। তিনি বলেন, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে এবং বৈদেশিক ঋণ না এলে ডলারের সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। টাকার মান কমে যাবে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। অপর দিকে রিজার্ভ কমে গেলে এবং কোনো ব্যাংকের ওপর আস'ার সঙ্কট দেখা দিলে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে আমদানিকারকদের থার্ড পার্টি গ্যারান্টি দিতে হবে। এতে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। আর আমদানি ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে, যা গরিব মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বর্তমান পরিসি'তি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। গত আগস্ট থেকেই ডলারের সঙ্কট চলছে। এখন হয়তো এ সঙ্কট আরো বেড়ে গেছে। এ সঙ্কট মেটানোর মধ্যে সরকারের কাছে তাৎক্ষণিক কোনো উপাদান নেই। তিনি মনে করেন, ডলারের সরবরাহ বাড়াতে না পারলে সামনে কঠিন সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, তখন আমদানি বাড়বে। কিন' রিজার্ভ কমে যাবে। তখন আমদানি দায় মেটানোই দুষ্কর হয়ে পড়বে।
চাপ বাড়ছে লেনদেনের ভারসাম্যে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩২৭ কোটি ১৮ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। অক্টোবরে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে হয়েছে ৩২৮ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২৯ শতাংশ বেশি। কিন' অক্টোবরে রফতানি আয় হয়েছে ১৯৫ কোটি ডলার। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬৫ শতাংশ। অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ বাড়ছে।
কাঙ্ক্ষিত হারে বৈদেশিক ঋণ আসছে না : এ দিকে নানা কারণে দাতারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণ অবমুক্ত করছে না। যেটুকু অবমুক্ত করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধে ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট বৈদেশিক ঋণ অবমুক্ত হয়েছে মাত্র দুই কোটি ২৮ লাখ ডলার। আলোচ্য তিন মাসে বিদেশী ঋণ ও আনুদান পাওয়া গেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার। কিন' সুদ ও আসল বাবদ দাতাদের পরিশোধ করা হয়েছে ২২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। সরকার বিবেচ্য সময়ে নিট ঋণ ও অনুদান পেয়েছে মাত্র দুই কোটি ২৮ লাখ ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে সরকার দাতাদের কাছ থেকে নিট ঋণ ও আনুদান পেয়েছিল ১৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার।
কমে যাচ্ছে টাকার মান : এ দিকে ডলারের সরবরাহ কমে আসায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান ক্রমেই কমে আসছে। গত ১ ডিসেম্বর প্রতি ডলার পেতে আমদানিকারকদের ব্যয় করতে হয়েছে সাড়ে ৭৮ থেকে ৭৯ টাকা, যেখানে গত বছর ২৯ নভেম্বরে ছিল ৭১ টাকা। ডলারের মান বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ অনেক কম। যেসব ব্যাংক আগে আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করত, তাদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ডলারের সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ক্রমেই চাপ বেড়ে চলেছে। সামনে এ চাপ আরো বাড়বে। তার কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা জানান, সামনে যে হারে আমদানি দায় বাড়ছে সেই হারে সরবরাহ বাড়ছে না। তিনি চলতি মাসের চাহিদার চিত্র তুলে ধরে জানান, চলতি মাসে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানির জন্য পরিশোধ করতে হবে ৫০ কোটি ডলার। এর বাইরে পামওয়েল ও গম আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ, পেট্রোবাংলা বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি শেভরনের পাওনা পরিশোধ, বিসিআইসির সার আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। অপর দিকে কয়েকটি ব্যাংকের বকেয়া আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। সব মিলে চলতি মাসে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে অন্য মাসের তুলনায় বেশি। কিন' কাঙ্ক্ষিত হারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে না। আর সরবরাহ না বাড়লে বিদ্যমান রিজার্ভ থেকে দায় পরিশোধ করতে হবে। ওই কর্মকর্তার মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ কোটি ডলার সরাসরি বিক্রি করা হয়েছে। আর বাকি ধার দেয়া হয়েছিল, যার মধ্যে এখনো ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করেনি ব্যাংকগুলো। সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে ৮০০ কোটি ডলারে আসতে পারে।
আপদকালীন দায় সঙ্কট : অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের আপদকালীন ব্যয় মেটাতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। কিন' বর্তমানে গড়ে সোয়া তিন বিলিয়ন ডলার করে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। সে হিসাবে তিন মাসে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার রিজার্ভ রাখতে হয়। দাতা সংস'া আইএমএফ বরাবর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার কোটি বা ১০ বিলিয়ন ডলার রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন' গত ১ ডিসেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৩০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অথচ গত মার্চে এক হাজার ১০০ কোটি ডলার ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সামনে রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসবে। একজন কর্মকর্তা বলেন, বিপিসিসহ সামগ্রিক আমদানি দায়ের পাশাপাশি আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আমদানি দায় অর্থাৎ আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) দায় পরিশোধ করতে হবে ৮৫ কোটি ডলার। কিন' কোনো বড় ধরনের তহবিল এ সময় অবমুক্ত হবে না। সব মিলে আগামী মাসেই রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে। আর রিজার্ভ এ পরিসি'তিতে চলে আসলে আপদকালীন দায় মেটানো দুষ্কর হয়ে পড়বে। বিদেশী ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি গ্রহণের জন্য অতিরিক্ত গ্যারান্টি দাবি করবে। এতে আমদানি ব্যয় আড়াই শতাংশ মতো বেড়ে যেতে পারে।
বাড়বে আমদানি দায়ের ঝুঁকি : যেসব সূচকের ওপর নির্ভর করে একটি দেশের ঋণদানের ঝুঁকি মানদণ্ড নির্ণয় করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিদেশী ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করা হয় মূলত একটি দেশের রিজার্ভের মাধ্যমে। রিজার্ভ বেশি থাকলে রেটিংও ভালো হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং হলো বি-৩, যা সন্তোষজনক। রিজার্ভ কমে গেলে রেটিং কমে যাবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস'াপনা পরিচালক এ কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, রিজার্ভ কমতে শুরু করায় অনেক দেশের রফতানিকারক থার্ড পার্টি গ্যারান্টি চাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে এ সঙ্কট আরো বাড়বে।
http://www.dailynayadiganta.com/details/14340
আলোচিত ব্লগ
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।
১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।