somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুঃস্বপ্ন

২৮ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই পথ দিয়ে কতবার আসা যাওয়া করেছি, সেই ছোটবেলা থেকে। মধুময় অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর সাথে। তার কতকটা ব’ই কি সবই আনন্দের! ছোটবেলার দিনগুলো সকলেরই কি আমার মত মধুর ছিলো ! মায়ের বকুনি, বাবার শাসন তার মাঝেও দুষ্টুমির কমতি ছিল না। ছোটবেলার সেই জীবনে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে কিছু স্মৃতি রূপকথা হয়ে হৃদয়ে উঁকি মারে, কিছুটা ঝাপসা, কিছুটা .... সব কি আর মনে করতে পারি!

কাকার হাত ধরে সেই কত হেটেছি এই পথে। এই যে ডান দিকে যে মাঠটা নদীতে গিয়ে বিলিন হয়ে গিয়েছে সেটাতে সময়ে অসময়ে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি; নদীর জলে পাড়ার ছেলেরা মিলে কত ঝাপুড় খেলেছি; দলবেঁধে বকের পিছে পিছে অকারণে দৌঁড়িয়েছি। সেসব কথাগুলো আজ মনে আসলে হাসি পাই; নিজের অজান্তেই নিজের শৈশব স্মৃতিগুলো লজ্জায় মুখ লুকায়।

ওই দেখ যে রাস্তাটা একটু সামনে থেকে বাঁম দিকে বেঁকে গিয়েছে অনেকটা সারসের গলার মত, ওইখানটাতে একটা বড় বটগাছ ছিলো। অনেক দিনের পুরানো। দাদুর মুখে কত গল্প শুনেছি গাছটাকে নিয়ে। বাবারে, সে কি যে ভয়ংকর ! মাঝে মাঝে এখনও শরীরের লোমগুলো শিউরে উঠে; বুকের ভিতরটা ধপ ধপ শব্দ করে। কিন্তু সেই গাছটা কোথায় ! এখানে তো তার সেই শিতল ছায়াটুকুও নেয়!

আর একটু এগুলেই একটা চৌরাস্তা চোখে পড়বে। রাস্তার মোড়ে মতিন চাচার দোকান ছিলো। ছোট একটি দোকান। কাঠ দিয়ে দু’জন মিস্ত্রি কিভাবে যে তৈরী করল ! খুব অবাক হয়েছিলাম। ভেবে ছিলাম বড় হয়ে কাঠ মিস্ত্রি হব। সেখানে আজ একটা বড় দোকান হয়েছে। একতলা কিংবা দোতলা নয়, ছয় তলা ফ্লাট।

আর একটু এগিয়ে গেলেই আমাদের বাড়িটা। দোতলা বাড়ি। পাক প্রিয়ডে দাদুর হাতে গড়া বাড়িটা। একসময় লোকারণ্য ছিলো। এখন প্রায় শূন্যই থাকে। যাদব কাকার কথা তাদের মধ্যে খুব বেশি মনে পড়তো বিদেশ থাকার সময়। যদিও মাঝে মাঝে বাবা চিঠিতে কাকার কথা লিখতেন, কিন্তু তাতে মনে তৃষ্ণা নিবারণ হত না। কাছে না থাকলে মানব মনের চাহিদা মেটে না, দূরে থেকে বুঝেছি। আমাকে যাদব কাকা খুব বেশি ভালোবাসতেন, যতটা প্রয়োজন ছিলো না ঠিক তার চেয়েও বেশি। মায়ের মুখে শুনেছিলাম আমার মত একটি ছেলে ছিলো যাবদ কাকার, জন্ডিসে মারা গেছে। আমার মনে আছে একবার মাধবপুরে বৈশাখি মেলা বসেছিল। তখন আমি ছোট। অনেক বড় মেলা। নগরদোলা, ঘোড়দৌড়, পুতুল নাচসহ অনেক কিছু বসেছিল। একটা কথা বলে রাখা ভাল মাধবপুর আমাদের গ্রাম থেকে চার কিলো পথ। বাবার কাছে গিয়ে বাইনা ধরলাম মেলায় যাব। বাবা নিয়ে গেলেন না। বললেন তার নাকি কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যাদব কাকাকে বললাম যাদব কাকা না করলেন না। পুরো পথ স্তুপের মত কাকার কাঁধে ভর করে গিয়েছিলাম।

যাদব কাকার গ্রাম কোথায় আজো আমার জানা নেই। বাবার সাথে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল তাও আমার অজানা। ছোট বেলা থেকেই কাকাকে দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে, তাই প্রশ্নটা মনের মধ্যে উঁকি মারে নি। তবে মায়ের মুখে শুনেছিলাম কাকা দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের লোক। নিজের অঞ্চল ছেড়ে কাজের সন্ধানে এখানে এসেছিলো। যখন আসে তার সাথে দুবছরের একটি মেয়ে ছিল। কাকার মেয়ে। শুনেছি মহাদেবের পূজার দিনে এই কন্যা প্রথম পৃথিবীর আলো বাতাস স্পর্শ করেছিল। মঙ্গলক্ষণে জন্ম এবং এক জ্যোতিষীর গনণায় ঈশানীর ভাগ্য মঙ্গল বলে বিবেচিত হওয়াতে তার নাম রেখেছিলেন কাকা। অনেকদিন হলো তারও কোন সংবাদ পাইনি। প্রথম প্রথম ঈশানীর সাথে চিঠি আদান প্রদান হত, পরে আস্তে আস্তে সেটার বিলুপ্তি ঘটে।

আজ অনেক দিন পর বাড়ি ফিরছি। দির্ঘ বিশ বছর পর। আমার শৈশবের গ্রাম আর এই গ্রাম এক মনে হচ্ছে না। এই যে, এইখানে একটু বড় পুকুর ছিল আমাদের, সেটাও তো দেখছি নেই। সব কিছু কেমন যেন পাল্টে গেছে। কিছু যে আর চিনতে পারছি না। সময়ের সাথে কত কিছু পরিবর্তন হয়! শুধু আমিই্ হয়তো পরিবর্তন হতে পারি নি। যুগের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি নি। বিদেশের মাটিতে থেকে আমার গ্রামের মাটির প্রতি গভীর টান উপলব্ধি করতে পারতাম। বার বার ফিরে আসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারি নি। ছেলেরা যতটাই চালাক হোক না কেন একটা বোকামী থাকেই। হইতো আমার এটাই সেই বোকামী।

আমাদের বাড়িটা সেই আগের মতই আছে। দোতলা বাড়ি। আশে পাশে অনেকগুলো বড় বড় বাড়ি উঠেছে। তাদের ছাঁয়াতলে আমাদের বাড়িটা সামান্যই মনে হয়। বাবা মুরুব্বি হয়েছেন। চুলে পাক ধরে সাদা হয়েছে, মা’ও তাই। আমার আসার সংবাদ এরা আগেই পেয়েছে। যাদব কাকা আমাকে দেখার জন্য ছুটে এলো। তারও গোঁফে চুলে সাদা রং লেপটিয়ে আছে। সম্ভবত আমাকে দেখে তিনি লজ্জাবোধ করছিলেন। মৃদ্যু কন্ঠে বলল, বাবা ঠাকুর ভালো আছো তো ? প্রতি উত্তরে আমি তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বললেন, আর বাবা ভালো, মহাদেব রেখেছেন কোন হালে। বৃদ্ধ হয়েছি, এখন ভগবানের পা স্পর্শ করতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত। তিনি আমাকে আমার ঘরে নিয়ে গেলেন। যাবার পথে ঈশানীর কথা জানতে চেয়েছিলাম। কোন উত্তর করে নি। মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আমার ঘরে ঘুমাতে গেলাম। নিজের ঘর যেন নিজের কাছেই কেমন অপরিচিত লাগছে। সেই যে ছোট বেলাতে এই ঘরে ঘুমিয়েছি, এর মধ্যে কত দিন চলেগেছে ঘরটির দিকে তাকাবারও সময় পায়নি। কেন যেন ঘুম আসতে চাইছে না। কি সব যেন ভাবছি। যদি এমন হতো মানুষ বড় হবে না। পৃথিবী পাল্টাবে না। নিজের দেশ ছেড়ে অন্যদেশে যেতে হবে না। তাহলে. না তা কি আর কখন হয়। এভাবে আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে যে কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারি নি। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। আবার শব্দটিকে শুনতে চেষ্টা করালাম। না শুনতে পেলাম না। ভাবলাম হয়তো বা স্থান পরিবর্তনের ফলে এমনটি ঘটছে। সারাদিনের ভ্রমণে এমন বিভ্রম হতেই পারে। শুয়ে পড়লাম। আবার সেই শব্দ। উঠে বললাম, কে, কে দরজায় ? কোন কথা কানে এলো না। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললাম। চাঁদের আলোর বিকশিত রূপরেখা কলঙ্কহীনা আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। চন্দ্ররেখায় বাঁকানো ঠোটদুটো যেন কিছু বলতে চাচ্ছে আমাকে। সে ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার গভীর রজনীতে লোপ পেল।পিছনে মেঘকালো চুল রাতের ¯িœগ্ধ বাতাসে বার বার দোল খাচ্ছে। শাড়ীর আঁচল বাতাসে ভেসে চলেছে। মৃদু কন্ঠে বললাম, কে তুমি ? সেই মোমের পুতুলের ন্যায় অপরূপ পুতুলের মুখ থেকে স্তব্ধ বাতাসে দোলা দিয়ে গেল, আমাকে চিনতে পারছো না ? ক্ষণিকের জন্য মনের মধ্যে শংঙ্কা লাগল। কেন যেন কি একটা অপরাধবোধ কাজ করছে ভিতরে। তাহলে কি আমি সত্তিই কাছের মানুষদের চিনতে পারি না ? বললাম ঈশানী ? কোন উত্তর পেলাম। না। সে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। দুজন সামনা সামনি অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। বর্ষার বাতাস জানালা দিয়ে হুহু করে ঘরের মধ্যে নির্দিধায় প্রবেশ করছে। জানালার পাশে একটি গাছে রাতজাগা পাখি বার বার ডেকে চলেছে। পৃথিবীতে হইত এমন নির্জন মুহূর্তে মানব মানবীর মধ্যে আমি এবং ঈশানীই জেগে আছি। আর সমস্ত পৃথিবী গভীর ঘুমে মত্ত। কারো মুখে কোন কথা নেই। আমি স্তব্ধতাটুকু দূর করবার জন্য বললাম, তুমি এত রাতে ?

ঈশানী বলল, আমিতো রাতেই বের হই। চারি দিকে ঘুরে বেড়াই। দিনের বেলা কি আর আমার বেড়ানোর কোন পথ আছে ?
আমি চুপ করে থাকলাম।

দাদা, তুমি ভালো আছে ? অনেকদিন হয় তোমাকে দেখিনি। আজ তুমি এসেছো বলেই আমি এ বাড়িতে এসেছি, নইলে এ বাড়ির গেটের চৌকাঠ মাড়ানোর মেয়ে আমি নয়।

সত্যই অনেক দিন হয়েগেছে। আমাদের দুজনের দেখা হয় নি। বিশটি বছর অনেক সময় কি না জানি না তবে কম সময় নয়। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। ঈশানী তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তারপর আর দেখা হয় নি। এখন ঈশানীকে দেখে মনে হয় না যে সেই ছোট্ট ঈশানী যে সারাদিন আমার সাথে থাকতো, দুষ্টুমিতে আমাকে বিরক্ত করে রাখতো সব সময়। পৃথিবী কেমন যেন অন্যরকম অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। মানুষ বড় হয়, পৃথিবী পাল্টে যায়, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হয়।

দাদা তোমার জন্য আমার অনেকগুলো কথা জমা হয়ে আছে। অনেকদিন মনের মধ্যে ধুপের ছোঁয়ার সাথে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এগুলো। আজ তোমাকে আমি সবকিছু বলব দাদা। দাদা আমি অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে পৃথিবীর অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আলোর মুখ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই।

তুমি চলে যাবার পর আমি বড় একা হয়ে পড়ি। একা একা স্কুলে যেতে হয়। খেলার বন্ধু নেই। সারাদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম তুমি ফিরে আসবে, আসনি। জান দাদা, যখন শেষ নিঃশাস ত্যাগ করলাম তখনও তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি, তুমি আসনি। হইতো তুমি থাকলে আমাকে এই নিশিচর হতে হতোনা। হইতো পৃথিবীর আলো বাতাসে আমি আরো কিছুদিন ঘুরতে পারতাম, হয়ত এই বাড়ি ঘর ছেড়ে আমাকে একা একা অন্তরের দগ্ধতা নিয়ে অতৃপ্তে পরজন্মের প্রত্যাশায় সময় গুনতে হতো না।

সময় যেতে থাকে। আস্তে আস্তে নিজেকে সামলিয়ে নিতে শিখি। প্রাইমারী শেষ করে, মাধ্যমিকের লেখাপড়াও শেষ করি। এভাবে অনেকগুলো দিন আমার জীবন থেকে অতিবাহিত হয়। আমি তোমাকে যখনকার কথা বলছি কিছুদিন হলো কলেজে ক্লাস আরম্ভ হয়েছে। তখন বাবা আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু কাকা ঠাকুর পড়াশোনায় আমার মন ছিল যথেষ্ট তার কারনে বন্ধ করতে দিলেন না। তুমি কি শুনছো?

“হুম, শুনছি, তুমি বল”

এর মধ্যে কলেজে আমার বেশ পরিচিতিও বেড়ে গিয়েছে। প্রতিটি শিক্ষকের নজরে পড়েছিলাম আমি। সবাই আমাকে ভালোবাসতেন। যদি তুমি দেশে থাকতে তবে আমার এই অবস্থান দেখে নিশ্চয় তুমি আনন্দে আন্দলিত হতে যে তোমর বোনটি আজ সবলের প্রিয় একজন ব্যাক্তি। যেবার কলেজ টেষ্টে প্রথম হলাম, সবার মুখে মুখে আমার প্রসংশা। বিশ্বাস কর নিজের প্রসংশা শুনতে নিজের কাছে ভালোই লাগতো। মনে হতো পৃথিবীটা বুঝি আমার জন্যই এমন সবুজ-শ্যামল হয়েছে। পাখির গান বুঝি শুধু আমার মনে পুলক লাগানোর জন্য আবিষ্কার হয়েছে, নদীর জল শুধু আমাকে গোসল করানোর জন্য ধরনীতে স্থান লাভ করেছে। কলেজ শেষে যখন অরণ্যে প্লাবিত রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরতাম, এক নাম না জানা পাখি সর্বদা মধুর শব্দে আমাকে গান শোনাত। নদীর জল তার জৈবনের উচ্ছসিত ঢেউ দিয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত চায়তো। মৃদুমন্দ বাতাস যেন আমাকে স্পর্শ না করলে তার ভাল লাগতো না। পথচারীদের মধ্যে অনেকেই আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। যেমনটি তুমি এখন তাকিয়ে রয়েছো। তুমি যেমন অবাক বিশ্ময়ে তাকিয়ে রয়েছ, তারাও ঠিক অবাক বিশ্ময়েই তাকিয়ে থাকতো। শুধু তোমার সাথে তাদের পার্থক হলো তুমি আমার এই কথাগুলো শুনে অবাক হচ্ছ আর তারা আমার প্রতিভা দেখে অবাক হতো।

“থামলে যে !”

এর মধ্যে একদিন কলেজের একটি ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয় ইমন। ইমন খুবই ভালো ছেলে। শুনেছি সে অনেক গুণে গুনান্নিত একজন মানুষ ছিল, এমন মানুষ নাকি পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া দায়! আমার বিশ্বাস হতো না। তোমার বাবা এবং সমাজের কিছু মানুষেরা মিলে তার একটি মাত্র দোষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছিল সে মুসলমানের ছেলে। আচ্ছা দাদা, তুমিওতো মুসলমানের ছেলে। আমি তোমার সাথে মিশি না বল তো। আবার আমি তো তোমাদের বাড়িতেই অর্থাৎ মুসলমানের বাড়িতেই থাকি। তাহলে মুসলমান ছেলের সাথে ভাল সম্পার্কটা কি কোন খারাপ কিছু ছিলো ? যদি দোষ হয়ে থাকে তবে তো আমারও দোষ ছিল, আমাকে এই বাড়ি থেকে বেড় করে দেওয়া উচিত ছিল। ছিল না বল?

“তুমি বলতে থাক”

“তুমি উত্তর করবে না, তাইতো? আচ্ছা বলছি”

একদিন কাকা ঠাকুর আমাকে ডাকলেন, ঈশানী মা শোন, তোমার কলেজ কেমন চলছে? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তোমার বাবাকে সেই আগের মতই ভয় করি। কিন্তু বিশ্বাস কর কাকা ঠাকুরের প্রতি আমার ভক্তির কমতি নেই। এখন সেটা আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

“সেদিন তোমাদের কলেজে গিয়েছিলাম। ছেলেটা কে মা?” বহুবার বর্জ্যাঘাত হতে দেখেছি। মানুষেরা দুর্বল চিত্তের প্রাণী। তাই তাদের সহজাত ধর্ম চমকিয়ে উঠা। আমিও সেই দিন চমকিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু যেদিন আমার জীবনে সবচেয়ে বড় বর্জ্যাঘাত হলো সেদিন কিন্তু চমকায় নি বরং জীনের নির্মল আনন্দ একটি জীবনে শেষবারের মত উপলব্ধি করেছিলাম। এখনও মাঝে মাঝে ভাবি যদি পূনর্জন্ম হয়, তবে পৃথিবীর সেই আলো বাতাসে ঘুরে বেড়াবো, সেই নদীজল, সেই ডিঙী, সেই মাঠ সেই ঘুড়ি উড়ানো জীবন কত রঙিন, আর মরণ, বিষাদময়!

দু’দিন পরে জানতে পারলাম তোমার বাবা ইমনের সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমি গোপনে আড়াল থেকে শুনতে পেলাম তোমার বাবা ইমনকে বলছে, তুমি মুসলমানের ছেলে। তোমার তো বাবা জাত আছে, কেন মিছে মিছে হিন্দু মেয়ের পিছনে পড়ে আছো ? এসব যে খুবই খারাপ। তোমার জাতও যাবে মেয়েটির জাতও যাবে। শেষে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। দাদা, আসলেই কি এগুলো খারাপ ? জাতহীনা মেয়েদেরকি আসলেই বিয়ে হয় না। আমি আজোও বুঝতে চেষ্টা করি। জান দাদা, যখন আমি মানুষ ছিলাম মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের চেহারাটা মিলিয়ে নিতাম। এখন আর পারি না। আয়নার সামনে গেলে কিছুই দেখতে পারি না। সেজন্য আমার চাঁদবর্ণ মুখটা অনেকদিন দেখা হয়নি। যখন তোমার বাবা ইমনকে এমনকিছু মন্ত্রমুগ্ধ করছিলো। তখন আমার সামনে ঝুলন্ত আয়নাটা যেন বারবার আমাকে ঝিক্কার দিচ্ছিলো। কিসের এত গর্ব তোর ? কিসের বলে তুই তোর রূপ ধরে রেখেছিস ?

ইমন মন ভার করে সেদিন চলে গিয়েছিল। আমি এতক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে তোমার বাবাদের সব কথা শুনছিলাম। দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে এলাম। আমার নির্ঘাত মনে আছে এটাই সেই ঘর। অনেক খোঁজা খুজি করে হাতের কাছে একটি রশি খুঁজে পেলাম। তারপর তোমার জন্য অপেক্ষায় কিছুক্ষণ দাড়িয়েও ছিলাম, তুমি আসনি। জানালা দিয়ে দক্ষিণের বাতাস হুহু বেগে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে, জানালার পাশে একটি পাখি বেদনার্ত চিত্তে গান গায়ছে। তাই জীবনের শেষ আনন্দ অনুভূতিটুকু শেষ বারের মত একা একাই উপলব্ধি করলাম।

যখন আমার জ্ঞান ফিরলো, দেখি চারিদিকে কান্নাকাটি পড়েগেছে। নিজেকে আগের তুলনায় অনেক হালকা লাগছে। এই ঘরে আবার ঢুকলাম। এই চেয়ারটিতে বসে তোমার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছি, তুমি আসনি। শেষে এমন অবস্থা হয় আমার ঘরে থাকতে খুব সমস্যা হত। সকাল সন্ধা বাবা ধুপ দিতেন। ধুপের ধোঁয়ায় থাকতে না পেরে শেষে এক রাতে রেড়িয়ে পরি। তারপর থেকেই শশ্মানের মাঠে বসবাস করছি।

হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। যে চেয়ারটাতে ঈশানী বসে ছিলো সেটা এখনও দুলছে, জানালা দিয়ে হুহু শব্দে বাতাস ঘরের মধ্যে নির্দিধায় প্রবেশ করছে। জানালার পাশে এক অজানা পাখি মুহুরমুহু শব্দে ডেকে চলেছে। শরীরের লোমগুলো শিউরিয়ে উঠেছে। দরজায় বাবা ডাকছেন, আবীর ওঠ। অনেক বেলা হয়েছে।

১৪ জৈষ্ঠ্য ১৪২০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×