somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রাবণের শেষ রাত (ছোটগল্প)

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মা যেদিন বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখেছে, সেদিনই আমার মনে কি যেন এক আশংকা দোলা দিয়ে ছিল। সমস্ত বিবেক স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। মায়ের মুখে বিজয়ে হাসিতে আমি সেদিন আর না বলতে পারিনি। অথচ, কত প্রতিজ্ঞা করেছি চির কুমার থাকার জন্য। সে সব প্রতিজ্ঞা চোখের সামনে ধুলোয় পড়ে গড়াগড়ি করছে, আমি নির্বাক, অসহায়ের মত দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

মানুষের জীবনের উপর থেকে এ বিষয়গুলো অবধারিত কিনা জানি না, তবে হইতো ইচ্ছে করলেই আমি এগুলোকে এড়িয়ে চলতে পারতাম। এ বিষয়ে বন্ধুদের মধ্যে অনেক কটাক্ষ্যও শুনেছি। তারা এককবার বলেছিল, এখন বলছিস বিয়ে করবিনা, কিন্তু সময়মত দেখবি ঠিকই দৌড়াবি।
সত্য সত্যই আমি দৌড়াচ্ছি। জানিনা এ দৌড়ের শেষ কোথায়!

মা বললেন, খোকা মেয়ে দেখতে রাজকন্যা, যেমনি রূপ, তেমনি গুণ। ও মেয়েকে ঘরে আনলে আমার ঘর আলোকিন হবে তুই আর না বলিস না বাবা। বড় ভালো মেয়ে তোদের দুজনে বড় ভালো মানাবে!

মায়ের সে কথায় সেদিন কথা বলিনি, সাহস করে মায়ের আনন্দভরা চোখের দিকেও চোখ রাখিনি। শুধু অপরাধির মত বিবেকের কটাক্ষের কাছে বার বার পরাজিত সৈনিক হয়ে দাড়িয়ে থেকেছি। ভেবেছিলাম সকলের সামনেই বিয়েটাতে দ্বিমত করবো। আমার সিন্ধান্তটা সকলকে জানিয়ে দেব। কিন্তু যখন মায়ের কাছ থেকে একটি ছবি পেলাম। তখন বুকের মধ্যেটাতে আর একটা অজানা আশংকা ছুঁয়ে দিয়ে গেল। যদি হারিয়ে যায়!

আজন্মের সাধনা শেষ হতে চলেছে এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ রইল না। ছবিটা এখনও বুক পকেটে রাখি। মাঝে মাঝে খুব বেশি মনে পড়লে ছবিটা বুকে চেপে ধরি। আমার সম্মতি পেয়ে বাবা বিয়ের দিন ধার্য করলেন। শেষ মেষ বিয়েও করে ফেললাম।

আমার অর্ধাঙ্গীর নাম অন্তিকা। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন। অনেক আদরেই বড় হয়েছে। আমার শ্বশুরের অনেক সহায় সম্পত্তি আছে, শুনেছি মাঠেও নাকি অনেক জমি আছে। তিনি সেগুলোই দেখাশোনা করেন। তাছাড়া গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবেই দু-পাঁচ গ্রামের মানুষ তাকে চেনেন।

অন্তিকা এ সংসারে এসে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নতুন করে সংসারটিকে সাজিয়ে নিয়েছে। মায়ের টুকিটাকি কাজগুলোতে সাহায্য করা, বাবাকে সময়মত ঔষধ খাওয়ানো তার প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে। আমার দিকে দৃষ্টিপাত করার অবসরটুকুও যেন সে খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে প্রচন্ড অভিমান হতো, আমি স্বামী আমার খোঁজ খবর নেবে না! কিন্তু মা যখন তার নববৌমার প্রসংশা করতেন তখন মনে হতো তাইতো ভালোইতো আছি। মাঝে মাঝে আমাকে ডেকেও দেখাতেন খোকা দেখ, বৌমা আমার গ্রামের মধ্যে একটাই, পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এমন চাঁদ পাওয়া যাবে না। বাবাও মাঝে মাঝে তার বৌমার প্রসংশায় পঞ্চমুখ করে গল্প করতেন। বলতেন খুব ভাগ্যবান হলেই এমন পুত্রবধু কপালে জোটে।

অন্তিকার ফুল বাগানে বড় শখ ছিল। একদিন আমাকে ডেকে বলল, কইগো শুনছো? একটু এদিকে আসবে?
আমি গিয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে?
মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলাম। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা যেন নিরব লজ্জায় মাটিমুখ হয়ে রয়েছে। বিয়ে হয়েছে কয়েকমাস হলো এখনো আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও সে অর্জন করতে পারে নি। হইত মেয়েদের স্বভাবই এমন! এই নিরিহ বধুটির চন্দ্রবদন দেখার সাধ আমার আজ মিটল। সত্যই তো সুন্দর! এরও কি প্রশংসা আছে! সুন্দরের প্রশংসা করা যায়; কিন্তু অপরুপ সুন্দরের প্রসংশা কি?
বলল, আমাকে একটি বকুলের চারা এনে দিবে?
আমি অবাক হয়েছিলাম, বকুলের চারা কেন? গোলাপ চাইতে পারতো, রজনীগন্ধা চাইতে পারবো কিংবা আমার প্রিয় হাসনাহেনাও চাইতে পারতো, এত কিছু রেখে বকুল, কেন?

এমনিভাবে কয়েক মাস চলে গেল। আমাদের সংসারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় অল্প অল্প করে স্থান করে নিয়েছে অন্তিকা। প্রথম প্রথম বাড়ির কথা মনে করে খুব মন খারাপ করতো। বেশ কয়েকবার আমি তাকে নিয়েও গিয়েছি। এখন আর বাড়ির কথা বলে না। যেনবা আমাদের বাড়িটাই তার নিজের, সে অন্যজন্মেও অন্যগৃহে জন্ম কিংবা বসবাস করে নায়।

সেইবার যখন সে বাবার বাড়ি যেতে চাইলো আমি নিয়ে যাইনি, অনুরোধও করেনি। শুধু যাবার বেলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমাকে আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি তার সে কথার জবাব দিতে পারিনি, শুধু তার অশ্রুস্বিক্ত চোখের দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম। সে চোখের ভাষা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু পতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। তাই আজ রিক্তবদনে বসে থাকা। নাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!

আজ শ্রাবনের শেষ রাত্রি। এসময় অন্তিকাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। গতবছর এ রাতটি ছিলও ছিল একাকী, এখনও একাকী। সে এ সংসারে এসে যে বকুল গাছটি লাগিয়ে ছিল সেটির তলায় সবুজ শ্যাওলা জন্মেছে। বকুল ফুল বর্ষার বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ে। কিন্তু ওখানে যেতে সাহস পাই না, যদি অন্তিকার মত এই শ্যাওলাগুলোও হারিয়ে যায়! এগুলো ছাড়া যে আমার কাছে অন্তিকার শেষ স্মৃতি কিছুই নেই।

শ্রাবণের ধারা আকাশ ফেটে ধরনীর বুকে লুটিয়ে পড়ে; তার কষ্টগুলো ভোলার জন্য। আমার বুকের ভিতরে যে শ্রাবণের মেঘ জমাট বেঁধেছে তাকে কি করে ধরনীর বুকে লুটিয়ে দেব, কি করে শ্রাবণ জলের মত মিশিয়ে দেব মাটির বুকে নিজের অন্তর্দহনগুলো? অন্তিকাইতো শিখিয়েছিল যত দুঃখ-কষ্টই আসুক না কেন পুরুষদের কাঁদতে নেই। দেখ, অন্তিকা, আমি কাঁদছি না, আমি তোমার সেই আগের মতই আছি, যেমনটি তুমি রেখেগিয়েছিলে।

ক্রমাগত চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে, শ্রাবণের শেষ রাতে শ্রাবণকলঙ্ক ঘুচাবার জন্য মাথার উপরে একচিলতি মেঘ এসে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, ধিরে ধিরে রাত গভীর হয়ে আসে, বকুল বাদলগন্ধে রাতের সাথে সাথে মিলিয়ে যায়। শুধু আমি একা বসে থাকি এই নির্জন শ্রাবণের শেষ রাতে...
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×