ঘটনা-১
ইন্টার্নশীপ এর পর বাসায় ফিরছি। ভয়াবহ ব্যস্ত রাস্তা। রাস্তা ক্রস করার চেষ্টা করছি। একটা বাস ব্যাঁকাতেড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী যোগাড়ের চেষ্টায় রত। বাসের হেল্পার আমাকে বারবার বলছে আপা উঠেন আপা উঠেন।
আমিঃ আমি এই রুটে যাবো না।
হেল্পারঃ আরে আপা উঠেন। বাসে এসি আসে আল্লাহ্র কসম লাগে। বমির জন্য পলিথিন ফ্রী। কাপাসিয়া পৌঁছার আগে আজান দিয়ে দিলে আমাদের বাস অবশ্যই কোথাও থামবে। ইফতারের জন্য কোন চিন্তাই কইরেন না আপা……
আমিঃ আপাতত তো্মার বাস সরাও। আমি রাস্তা পার হবো।
হেল্পারঃএই বাস চল, বাস চল। আপা রাস্তা পার হবেক। মোজাম্মেল ভাই বাস ছাড়েন।
ঘটনা-২
রাস্তা পার হয়ে বনানী-মহাখালি রুটের বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। বিআরটিসি পাচ্ছি না। যেহেতু এক দেড় ঘন্টা জার্নির ব্যাপার, মাঝে মাঝে তা তিন-সাড়ে তিন ঘন্টায় পৌঁছা্লেও অবাক হবার কিছু নেই, তার উপর রোজার মাস, তাই বিআরটিসির ডাবল ডেকারে উঠার চেষ্টা করি। দোতলায় উঠে মাঝামাঝি কোন একটা সিটে বসে পড়ি আর যদি উড়িয়ে নেয়া বাতাস থাকে তাহলে তো কথাই নেই। শহরটাকে সেদিন বড় ভালো লাগে। তাই যেদিন বিআরটিসি ডাবল ডেকার পেয়ে যাই সেদিন নিজেকে শহরের রানী মনে হয়। যাই হোক, প্রায় আধা ঘন্টা মাথা-ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও যখন বনানী রুটের কোন বাস পেলাম না, তখন মহাখালী-নরসিংদী রুটের মিডল টাইপ এক বাসে উঠে পড়লাম। যদিও মহাখালী রুটের বাস, কনডাক্টর ছোকড়া ঘোষণা করলো এই বাস ক্যাপ্টেন্স ওয়ার্ল্ডের(শাহীন কমপ্লেক্স) সামনে দিয়ে যাবে।
ঘটনা-৩
বাসের লম্বা জ্যামে মানুষ বিরক্ত হয়। আমি বিরক্ত হই না। প্রায় প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার পথের বিভিন্ন অনুষঙ্গও আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি। যেন ঢাকা শহর আজকেই নতুন এসেছি। অচেনা মানুষজন দেখতে দেখতে আমি অনেক সময় চেনা মানুষজন সামনে পড়ে গেলেও চিনতে পারি না। পুরানো অভ্যেস। আজকেও দেখছি, হঠাৎ পাশের আংকেলের মাথা আমার কাঁধে!
আমিঃ আংকেল, উঠেন। ঠিকমত ঘুমান।
আংকেলঃ ও স্যরি। আসলে বাসের সিটগুলা একদম ভালো না, হে হে হে।
এই বলে আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেগে নাক ডেকে ঠিকমত ঘুমাতে লাগলেন।
ঘটনা-৪
মাত্র ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট বাস থেমে থেমে চলে নষ্ট হয়ে যাবার পর বাস থেকে নেমে পড়লাম। আড়াই মাইল হেঁটে আসার পথে বার কয়েক পেপসি,সেভেন আপ,ফ্রুটিকার বিজ্ঞাপন দেখলাম। রোজা শুরু হবার পর ইন্টার্নিতে যাবার সময় আমি ব্যাগ ভারী করে হলেও একটা গল্পের বই নিয়ে যাই। এতে দুটা লাভ হয়, নামাজের সময় যখন সবাই নামাজ পড়তে যায় আমি চুপচাপ গান না শুনে বইটা পড়ি। আর দ্বিতীয়ত, আসা-যাওয়ার পথে যেহেতু বিভিন্ন ধরনের বিলবোর্ড চোখের সামনে পড়ে, তাই সেগুলো এই মাহে রমজানে না দেখে বই পড়ার চেষ্টা করি। যদিও সেটা এই পর্যন্ত সফল হয় নাই, দেখা যায় নিজের অজান্তে বইয়ের পাতা ছেড়ে আমার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার প্রিয় রকমারি পণ্যের বিলবোর্ড গুলোতে। ঠিক যেখানে যেখানে বিলবোর্ড গুলো আছে থিক সেখানে সেখানেই আমার বই পড়া নিজের অজান্তে বন্ধ হয়ে যায়। তো স্বভাবত কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনও আমার চোখ এড়ায় নি। আর আমার মত কোমল পানীয় প্রিয় মানুষের জন্য, যারা এই জিনিসটা কমিয়ে আনার চেষ্টায় আছে, তাদের জন্য এসব বিলবোর্ড নাচুনে বুড়ির উপর ঢোলের বাড়ির মত। আম্মু এর মধ্যে ফোন দিলে জিজ্ঞেস করলাম ফ্রিজে কি কি আছে। আম্মু পাহাড় সমান জিনিসপত্রের নাম বললেও জানালো যে ফ্রিজে কোন কোক নাই। এই রমজানে এইসব খাবার-দাবার আর পানীয়র বিজ্ঞাপন গুলো সন্ধ্যা পর্যন্ত না রাখলে কি হয় এই চিন্তা করতে করতে খপ করে আরেকটা বাসে উঠে পড়লাম। এই বাসে এসি না থাকলেও ফ্যান আছে।
ঘটনা-৫
বাস থেকে নেমে সিএনজি, অতঃপর রিকশায় বাসায় ফিরতে হলো। এর মধ্যে এক ফ্র্রেন্ড ফোন দিয়ে সন্ধ্যর পর দেখা করতে বললো। এতদিন গাড়ীর তেল ফুরা্লেও আমার তেল ফুরায় নাই। ইন্টার্নি থেকে ফিরেও ঘুরাফিরা, আড্ডা, মুভিটাইম সবই ঠিক ছিলো কিন্তু এটা তো রমজান মাস। তাই বললাম আজ না। তেল না থাকলে খরচ করার প্রশ্নই উঠে না। ফেরার পথে পকেটের প্রায় টাকা খরচ করে ইগলু ম্যাংগো ফ্লেভার আইসক্রীম আর সেভেন আপ কিনে নিয়ে ইফতার এর ২৭ মিনিট আগে বাসায় এসে পৌঁছালাম। সহজ সরল দোকানদার ভাবলেন আমি নতুন চাকুরী পেয়েছি। কেন এখনো বস কে গাড়ী দেয়ার কথা বলছি না তা প্রশ্ন করলেন। আমি জানালাম সময় হলেই বলবো। কোনরকমে বাসায় এসে একটা শাওয়ার নিয়ে কখন ঘুমিয়েও পড়লাম এই অল্প সময়ে। মাগরিবের আযান দেয়ার সাথে সাথে আম্মু তাড়াহূড়ো করে ডেকে ওঠালো। আমি ঘুম ঘুম মাথা আর চোখ নিয়ে একটা বোতল হাতে বেসিনে মুখ ধুতে লাগলাম। মনে হলো বেহেশতী ঝর্ণার পানি আজ আমার মুখ ধোয়ার উপহার। একটু পরে কিছুটা পানি যখন মুখে চলে আসলো, তখন মনে হলো, জীবনে ডাবের পানি দিয়ে এই রোদে পোড়া মুখ ধুই নাই কিন্তু আজকে কোমল পানীয় দিয়ে মুখ ধোয়াটা হয়েই গেলো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






