বাস থেকে নেমেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাস স্টপে কোন রিক্সা ভ্যানের দেখা নেই। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। এই রাতের বেলা এখানে কারো থাকারও কথা না। ঢাকা হাইওয়ের উপর ছোট্ট একটা বাস স্টপেজ। এমনিতে এখানে তেমন একটা বাস থামেনা, তবে যাত্রী নামার থাকলে বাস কিছু্টা স্লো করে নামিয়ে দেয়। আগে এখানে কিছুই ছিল না। ইদানিং দুই একটা ছোট ছোট চায়ের দোকান বসেছে, সেগুলোও সন্ধ্যা নামার পর পরই বন্ধ হয়ে যায়। সারাদিন গ্রামের মধ্যে যাতায়াতের জন্য রিক্সা ভ্যান পাওয়া যায়। রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত কিছু কিছু রিক্সাচালক যাত্রীর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে, তার পরে আর কোন যানবাহন পাওয়ার আশা নেই। এখন রাত দশটার মত বাজে। এত রাতে কোন বাহনের আশা করাই বোকামি।
এখন নিজের বোকামির উপর নিজেরই রাগ লাগছে। দুপুরেই অফিস থেকে ছুটি পাওয়া গিয়েছিল। লাঞ্চের পরপরই বেরিয়ে পড়লে এতক্ষন বাড়ি চলে যেতে পারতাম। কিন্তু ফিরে এসে করলেও হতো এমন একটা কম জরুরী কাজে হাত দিয়েই বের হতে দেরি হয়ে গেল। এখন এই রাতের বেলা এতোটা পথ হেঁটে যেতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। এমনিতে শুক্লপক্ষের রাত, আকাশে বেশ বড় একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় পথ দেখে দেখে যেতে তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু হাতে একটা বেশ বড় সড়ো ব্যাগ থাকায় সেটা টেনে নিয়ে যাওয়াই সমস্যা। এখন কিছুই করার নেই, যত কষ্টই হোক, এটাকে টেনে নিয়েই যেতে হবে। সাহায্য করার জন্য কাউকেই এখানে পাওয়া যাবে না। নিজের উপর কিছুটা রাগ আর বিরক্তি নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
"পথ তো খুব বেশি না। সামনের ছোট মাঠটা পার হলেই মহেশপুর বাজার। সেখানে আমাদের গ্রামের কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবেই।" -- নিজেই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু এতো রাতে ওখানেও কি কাউকে পাওয়া যাবে? নিজেকেই প্রশ্ন করি। না পাওয়া গেলে নাই। কি আর এমন পথ। নিজেকে প্রবোধ দেই। মহেশপুর বাজারের পরে আর একটা ছোট্ট মাঠ। তারপরেই আমাদের বাড়ি। এইটুকু পথ একাই চলে যেতে পারব। এর চেয়ে বেশি রাতেও আমি একা একা চলাফেরা করেছি আগে। ভয়ের কি আছে!
-- ভয়? ভয়ের কথা তো আমি বলিনি। কিসের ভয়?
তাহলে ভয়ের কথা মনে আসলো কেন? আমি কি কোন কিছুতে ভয় পাচ্ছি? নাহ। কোন কারন নেই। ছোটবেলা থেকেই আমি এই এলাকাতেই বড় হয়েছি। প্রতিটি রাস্তাঘাট আমার পরিচিত।বাবার পরিচয়ের সুবাদে এখানকার সবাই আমাকে চেনে, যদিও আমি এখন নতুন প্রজন্মের অনেককেই চিনতে পারিনা। তাতে কি? এখানে আগে কখনও চোর-ডাকাত-ছিনতাইয়ের কথা শুনিনি। তবে ইদানিং নাকি কিছু কিছু চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এইতো কয়েক মাস আগে আমাদের গ্রামের মতি মিয়ার ছেলে কাশেমের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে কারা যেনো। কাশেম মহেশপুর হাটে কিসের একটা ব্যবসা শুরু করেছিল। সেদিন বেচাকেনা শেষ করতে রাত একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। বেশি হলেও কতই বা বেশি হবে? রাত আটটা নয়টার বেশি না। কিন্তু আমি তো তার চেয়ে বেশি রাতেও এই রাস্তায় চলাফেরা করেছি। কই, কখনো তো কোন অঘটন ঘটেনি। তাহলে আর ভয়ের কথা ভাবছি কেন?
এই যে এতোটা পথ হেঁটে আসলাম, ভয় পাওয়ার মতো তো কিছুই ঘটেনি। চাঁদের আলোয় বেশ পথ দেখা যাচ্ছে। হেঁটে যেতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। মাঝে মাঝে অবশ্য মাঠের মধ্যে দু একটা শেয়াল ডেকে উঠছে। তাতে আর কি, ছোটবেলা থেকেই তো শেয়ালের ডাক শুনে আসছি। রাস্তার দু'পাশে থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। কি একটা পোকা যেন অনেকক্ষন থেকে ডেকেই চলেছে। একটানা ডাকছে।অনেকদিন পরে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলার সন্ধ্যাগুলো তো এসব পোকার ডাক শুনেই কেটেছে। এখন শহুরে জীবনে এদের দেখাই পাওয়া যায়না।
তাহলে ভয়ের কথা মনে হল কেন? আমি কি কোন কারনে ভয় পাচ্ছি? ভাবতে ভাবতেই আচমকা রাস্তার পাশের গাছ থেকে কি একটা রাত জাগা পাখি শব্দ করে উড়ে গেল। এতোটাই আচমকা যে কিছু সময়ের জন্য আমি ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম। আরে ধুর! কি ভাবছি এসব! পাখি কি বাঘ না সাপ যে ভয় পাবো? সাপ দেখেই বা ভয় পাবার কি আছে? কিছুক্ষন আগেই একটা সাপ অলস ভঙ্গিতে রাস্তা পার হয়ে গেল। আবছা আলো-ছায়ায় কি সাপ তা চিনতে পারলাম না। অবশ্যি ভাল করে দেখতে পেলেও যে চিনতে পারতাম তার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। এখন আর কোনটা কোন সাপ ভাল করে চিনতে পারি না।
মনে আছে ছোটবেলায় একবার মামাবাড়িতে ইয়াবড় একটা সাপ মারা পড়েছিল। সন্ধ্যাবেলা মামাদের কাজের মেয়েটা সিঁড়ি ঘরে গিয়ে কিসের যেন ফোঁস ফাঁস শব্দ শুনে চিৎকার শুরু করে দেয়। তার চিৎকার শুনেই আশেপাশের বাড়ি থেকে অনেকে ছুটে আসে লাঠি-বর্শা নিয়ে। কিন্তু ভয়ে কেউ কাছে যেতে পারছেনা। সাপের কি রাগ! কি তার ফোঁসফাঁস শব্দ! আমি দুরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। পরে সবাই মিলে সাপটাকে মেরে ফেলে। আমি অনেকদিন আর একা একা সিঁড়ি ঘরে যাইনি।
কিন্তু সেটাতো ছোটবেলার ঘটনা। এখন আর তেমন বড় কোন সাপ দেখাও যায় না, ভয়ও লাগে না। আচ্ছা আমার মাথায় ভয় শব্দটা ঢুকে গেল কেন? আর বেরই হচ্ছে না, আজব!
কিছুক্ষন থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি। কিছুটা সামনের দিকে রাস্তা থেকে নিচে ক্ষেতের মধ্যে কেউ একজন নড়াচড়া করছে। কিন্তু এতো রাতে এখানে, এই মাঠের মধ্যে কে আসবে? আশেপাশে কোন বাড়িঘরও নেই। থাকলে না হয় ভাবতাম ওইসব বাড়ি থেকে কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছে। তাহলে কি ওটা? আমার হাঁটার সাথে সাথে তার নড়াচড়াও বাড়ছে। আমি ডানে বামে কাত হয়ে দেখতে গেলে সেটাও ডানে বামে কাত হচ্ছে, আমি কিছুটা নিচু হয়ে দেখতে গেলে মনে হচ্ছে সেটাও বসে পড়ছে। আমি উঠে দাঁড়ালে সেও দাঁড়াচ্ছে। আমাকে কপি করছে? কি ওটা? আমার মনের মধ্যে ভয় ভয় লাগছে কেন? আমি সামনের দিকে পা তুলতে পারছি না কেন? ভয় পাচ্ছি কেন? কোন অশরীরি কিছু? ভুত? কিন্তু আমি তো ভুতে বিশ্বাস করিনি কখনো? যেটা বিশ্বাস করিনা তাকে ভয় পাবার কি আছে। আমি দেখবই কি ওটা। যা হয় হবে। আশ্চর্য! এই কথাটা ভাবতেই মনে সাহস চলে এলো। এখন স্বাভাবিকভাবেই সামনে এগিয়ে যেতে পারছি। জিনিসটার কাছাকাছি এসেই হাসি পেয়ে গেল।
আরে ধুর!! এটাতো একটা বাঁশের কঞ্চি। গ্রামের কেউ একজন তার ক্ষেতের মধ্যে পুঁতে রেখে গেছে। কঞ্চি আর তার মরা সাদা পাতার উপর চাঁদের আলো পড়ে একধরনের ইল্যুশন তৈরে করেছিল । আর সেটা দেখেই আমি এতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছলাম। ভাবতেই হাসি লাগছে। আবার নিজের উপর রাগও লাগছে।
ভুতের ভয় আমার কখনওই ছিল না। যার অস্তিত্বই বিশ্বাস করি না, তাকে ভয় পাব কেন! তবে আমার ছোটবোন, মিনু ছোটবেলায় অনেক ভয় পেতো। কি দিনে কি রাতে সে একা একা কোন রুমে থাকতে পারতো না। একদিন সন্ধ্যায় মিনুকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললাম, আচ্ছা আপু, তুমি ভুতের ভয় পাও কেন? কখনো শুনেছো যে ভুত কাউকে ধরে মেরেছে? এই যে আমরা এখানে বসে আছি, মনে করো, সামনের ওই পথ দিয়ে একটা ভুত হেঁটে যাচ্ছে, তো সেটা দেখে ভয় পাবার কি আছে? সে তো আর আমাদের মারতে আসছে না।
"ভাইয়া, আম্মা ডাকছে, যাই" বলেই সে দ্রুত সেখান থেকে পালালো। কোথায় আমি ওর ভুতের ভয় তাড়ানোর জন্য কথাগুলো বললাম, আর সে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল। এই ঘটনার অনেকদিন পরে মিনু একবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছিল। মিনু তখন কলেজ হোস্টেলে থাকে। একদিন সন্ধ্যার পরে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখে ল্যাম্পপোস্টের কাছে একটা কাল রঙের বিড়াল বা ওই জাতীয় কিছু একটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আর ওই জন্তুটার চোখ-মুখ দিয়ে আগুনের মত আলো বের হচ্ছে। দেখেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপরের অনেকগুলা দিন তার ক্লিনিকের বেডে শুয়ে কাটে।
কিন্তু এখন আমি এসব কথা ভাবছি কেন? আমার মনের ভেতর থেকে কি কেউ বোঝাতে চাইছে যে ভুত বলে আসলেই কিছু আছে? লাভ নেই। আমি কখনই বিশ্বাস করব না। অশরীরি বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। মানুষের ব্যক্ষ্যাতিত কিছুই নেই। খুব রহস্যময় বিষয়েরও দেখা যায় একটা সহজ সরল ব্যক্ষ্যা আছে। এই এখন যেমন আমার মনে হচ্ছে আমার পেছনে পেছনে কেউ একজন হেঁটে আসছে। তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পেছনে তাকালেই দেখব কেউ নেই। ভুতের বিশ্বাস থাকলে হয়ত পেছনে তাকিয়ে দেখতে ভয় লাগত। পেছনে কিছু একটার অস্তিত্ব কল্পনা করে চমকে উঠতাম। শুনেছি এমন পরিস্থিতিতে কারো কারো মনে হয় ঠিক মেরদন্ডের পেছনে কেউ হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। মেরুদন্ডে একটা শিরশিরে অনুভুতি টের পাওয়া যায়। কিন্তু আমি জানি এসবই মনের একধরনের কল্পনা। রাতের সুনসান নিস্তব্ধতার মধ্যে আমার পায়ের শব্দেরই একটা সুক্ষ্ণ প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি এখন। আমি বিশ্বাস করি যে আমার পেছনে পেছনে কেউ আসছে না। অশরীরি বলে কোন কিছুই নেই। যার অস্তিত্ব আছে তার একটা ফিজিক্যাল অবস্থান আছে -- কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, যাই হোক না কেন।
আমার নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়াও অন্য একটা পায়ের আওয়াজ যে শুনতে পাচ্ছি সেটা আমার পায়ের শব্দেরই প্রতিধ্বনি। কারন একটু আগেই আমি পেছনে তাকিয়ে দেখেছি, কেউ আমাকে ফলো করছে না। কিন্তু একটা ব্যাপারে মনের মধ্যে খুতখুত করছে। আমি কি পথ হারিয়ে ফেললাম নাকি? কিন্তু তা কি করে হয়! আমি তো একটা পথ ধরেই হেঁটে আসছি, পথ ভুল করার তো কথা না। কিন্তু আমি যতক্ষন হাঁটছি তাতে মহেশপুর বাজার পৌঁছে যাবার কথা। অথচ এখনও বাজারের কোন চিহ্নই দেখতে পাচ্ছিনা। শুধু বাজার না, মহেশপুর গ্রামই তো এখনও অনেক দুরে মনে হচ্ছে। এতোটা দুরে কি ছিল।
-- "হ্যাঁ তাই তো"।
কে বলল কথাটা? আশে পাশে, সামনে পিছে তো কেউ নেই। কিন্তু আমি তো স্পষ্ট শুনতে পেলাম শুব্দগুলো। নিশ্চয় আমার মনের ভুল।অনেকটা পথ বাস জার্নি করেছি, তারপর এতোটা পথ হেঁটে আসছি, শরীর তো একটু দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো দুরের কোন শব্দ বাতাসে ভেসে এসেছে। এমনটা হতেই পারে। যাইহোক আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই মহেশপুর গ্রামের প্রথম বাড়িটা পাওয়া যাবে। তারমানে সব ঠিকই আছে, আমি কোন ভুল করিনি।
কে গেল? এটা কি হলো? আমি যেন কারো ছায়া দেখলাম আমার পায়ের কাছ দিয়ে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশে চালে গেল? কিন্তু আশেপাশে তো সত্যিই কেউ নেই, কে যাবে? নিশ্চয়ই চাঁদের উপর দিয়ে কোন মেঘ উড়ে গেছে, তার ছায়া পড়েছে। কিন্তু এটা কি? আমার মাথার চুলে কে যেন হাত বুলিয়ে গেল। কি হচ্ছে এসব? আসলেই কি এমন কিছু ঘটেছে নাকি দুর্বল শরীর থেকে দুর্বল মনের কল্পনা? অনেকটা পথ হাঁটা হয়েছে। এখন একটু বিশ্রাম দরকার। সামনেই রাস্তার পাশে একটা কদমগাছের সাথে বাঁশ দিয়ে একটা মাচা করা আছে। এখানেই কিছুটা বসে শরীরে একটু শক্তি জোগাড় করে নেই, সাথে যদি মনটাও একটু শক্তি পায়।
মাচায় বসার সাথে সাথে কদমগাছের ডালে কি বাতাস বেড়ে গেল নাকি? কেমন যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। উপরের দিকে তাকাতেই গাছের ডালে আলোড়ন তুলে কিছু একটা মাচার উপর লাফ দিয়ে পড়ে দৌড়ে চলে গেল। কি ওটা? কি? মানুষ? মানুষ কি এমন হয়? অন্য জগতের কিছু? কি ওটা? আমার চোখের সামনে কি হলো? এতো অন্ধকার কেন? আমি কি জ্ঞান হারাচ্ছি............?