বয়স হবার পর থেকে লেজেন্ড যাঁকে চিনি তাঁর কথা মানেই বহুমাত্রিক খবর। সিনেমার বিলবোর্ডের মত সে নাম অগ্রাহ্য হয় না। উত্তর ভারতীয় মূলধারার চলচ্চিত্রের নায়ক যেন, ভোজবাজির মত ঝলসে ওঠা, বক্স-অফিসের লাফড়া হাঙ্গামার নিপুণ অ্যাকশনের সুপার হিরো। ওই রুপালি পর্দার চমক যার চোখে লেগেছে, সে এই প্যাশন, যশ, খ্যাতির মর্ম ভালো বোঝে। ভারতবর্ষের মানুষ তাদের বলিউডি জাদুর বাক্সে নিজেদের দেখতে পায় স্লামডগ মিলিওনিয়ার হবার পৌনঃপুনিক কাহিনি, আর আমরা দেখতে পাই মকবুল ফিদা হুসেনকে। শিল্পজগতের ফিল্মি হিরোকে। তবে এ বাস্তব জীবনের শ্রম ও প্রসাদগুণের বদৌলতে, অন্য কিছু দিয়ে নয়। চলচ্চিত্র জগতে রোজগার শুরু করা হুসেন এই ফিল্মি উচ্চারণের সঙ্গে লীন, প্রবল ‘মওজ’ বা ‘মাস্তি’ তাঁকে বুঁদ করে রাখে কুশীলবের রংমহলার আবেশে। ভেতরে চলে এর গভীর নৃত্য।
তার ছবির সাধারণ মানুষেরা চিত্রনাট্যের ঢঙে পরিবেশিত হয়। উত্তর ভারতীয় আর্টের জনরুচির সাথে মিশেল খাওয়া এক ধাবমান অভিব্যক্তিতে। আমি শ্যাম বেনেগালের ফিল্মের সাথে অনেকদিন ধরে পরিচিত। এ পরিচিতি একটা রুচিবোধ তৈরি করে। বেনেগাল উত্তর ভারতের বিশেষ করে মারাঠি পপুলার জনকাহিনী বর্ণনা করেছেন। তবু নির্মাণে তার ছবি যে কারণে আলাদা ও শৈল্পিক, ফিদাও সে কারণে। স্মৃতিকাতরতা কবিতার মতোই আঁঁকড়ে ধরে রেখেছে তার ছবিকে। সাধারণ গ্রামীণ জীবন হতে শহুরে পরিবার—ভেতরের নানান চালচিত্র ছায়াচিত্রের ব্যঞ্জনায় রাঙিয়ে তুলেছে তাঁর চিত্রপট। সে অর্থে তাঁর ছবি ‘মোশান পেইন্টিং’ও বটে। লিরিক্যাল ও নাটকীয়। আবার ব্যাঙ্গাত্মক। রাজস্থানের মরুপ্রান্তর, নেপালি হিমালয়, কেরালার চিরসবুজ নদীপথ তাড়িয়ে তাড়িয়ে গেছে তাঁকে—চোখ ও হাতকে শান দিয়েছেন তিনি।
ড্রয়িং ও রঙে যে নিপুণ দক্ষতা অর্জন করেছেন তার তুলনা মেলা ভার। কেউ কেউ বলেন এছাড়া আর কী আছে তার ছবিতে বিশেষ। আরেকটিতো আছেই, ‘কম্পোজিশন’। এমনটা কেউ করে দেখিয়েছেন এইভাবে? ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেপরোয়াভাবে কোথা থেকে কোথায় সেধিঁয়ে রঙে আর ছিটেফোঁটা ড্রয়িংয়ে—এ কম্পোজিশনের বাহার কারো মতো নয়। প্রকৃতি, মিথ, বিশ্বাস, পুরোনো স্থাপনা, উত্সব মুহূর্ত এইসব অতীত উচ্চারণ রয়েছে যাতে। জয়পুর আল্লাদিয়া ঘরানার রাগসঙ্গীতের ঢংয়ে—গান ধরবার কেমন বাচনিক অসচেতনতা, অবলীলা—বহুক্ষণ ধরেই যেন গাওয়া হচ্ছে, হঠাত্ শুনতে পেলাম, তেমন স্বাভাবিক লয়ে তার ছবির প্রবহমানতা...! একটি ছবিই যেন আঁঁকছেন জীবনভর। কী করে তাকে আলাদা করা যায়, একটি হতে আরেকটিকে! জীবন নামের এ রঙ্গমঞ্চের কেনো অবশিষ্টই যেন ফেলে রেখে দেননি তিনি। সব উজাড় করে দিয়েছেন ছবিতে। তর্কে-বিতর্কে পার করেছেন চিত্র-উপলব্ধির বিস্তৃত জগতকে। তার ছবিকে নিন্দা-মন্দের বিচারে আনা হলেও উপেক্ষা করতে পারেননি কেউ। না দর্শক, না সমালোচক, না সহযাত্রী। খরিদ্দার তো নয়ই।
সুফীর ‘নৈঃশব্দ’ ও ‘ধ্যান’ এর ভেতর দিয়ে তাঁর কাজ শুরু হতে চায়। কিন্তু একসময় সময়কে পার হয়ে যেতে দেন না তিনি। খুব ভালোভাবে বুঝতে চান একে। নিজের দেখা শৈশবের সাথে অদেখা আস্বাদের বিচিত্র সৃজনক্রিয়ায় যে বর্তমান চিত্রপট চিরে বেরোয় তার বহুগামিতা অনবদ্য। চিত্রে সাধারণ ফর্মের ভেতর দিয়ে, সাংগীতিক রংয়ের সংবেদনার ভেতর দিয়ে গেয়েছেন তিনি সৌন্দর্যের জয়গান। অন্যদিকে ব্যক্ত হয়েছে সমাজ চেতনা মমতাময়ী রূপে। অসামঞ্জস্য ও হিপোক্রেসি ওঠে এসেছে তাঁর ছবির ভেতর। চরিত্রগুলো একই চিত্রপটে যেন ভিন্ন ভিন্ন সত্তায় আবির্ভূত ও আলাদা। হুসেন খুঁজতে চেয়েছেন পরিচয়, এইসব মানুষের সাথে নিজেরও; যেমনটা ফেলে এসেছিলেন জুমা মসজিদ গলির পথে পথে, দিল্লীর মহফিল-আবেশী সংস্কৃতিতে। এঁকেছেন অশ্বের দ্রুততায়, খসড়া করেছেন সমান্তরাল ভূমিতে, হেঁটে বেড়িয়েছেন এর ওপর; একাধারে ২-৩টিতে হাত বসিয়েছেন তিনি। আধুনিক এ্যাকশন পেইন্টারদের মতো। তার কোনো ছবিই যেন পূর্ণাঙ্গ নয়, অকথিত বা অপরিচিত থেকে যায় তা। ফর্ম ও রং শক্তি ও সাহস সঞ্চার করে দর্শকের মনে, নাড়া দিয়ে যায়। ফিদা গল্প লিখতেন, শায়েরি করতেন। শখের বশে করতেন এমনটা বলা যায় না, জীবনের সাথে মিশে গিয়েছিল এই লেখার সংস্কৃতি। দিল্লি কী করে ভুলতে পারেন তিনি। নাজিমুদ্দিন ধাবা’র চায়ের দোকান কোথায় পাবেন? আর সেই চা? ইংরেজিতেও লিখতেন কবিতা। অক্টাভিউ পাজ তাঁর কবিতার একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন মেক্সিকোতে। নানান চরিত্রের সঙ্গমে জঙ্গম মুহূর্তেও তিনি ছবি এঁকেছেন। মৌলবাদীদের উন্মাদনায় ছেড়েছেন নিজের মাতৃভূমি, পড়েছিলেন সাগরপারের মরুহাওয়ায়, অভিমানে। অপমান ছাড়া ভারত তাকে শেষবেলা আর কিছুই দিতে পারেনি।
সময়ের যে হেরফের তার শেষ কার হাতে বোঝা মুশকিল। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে জীবনের শেষ আশা পূর্ণ না হয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। বড় আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে দাফনের জন্যে দুই গজ মাটিও জুটলো না নিজ দেশে। রেঙ্গুনে নির্বাসিত হয়ে সেখানেই সমাহিত হন তিনি। জাফরের সে আক্ষেপটি ফিদার ছিল কিনা জানি না। বলতেন স্মৃতিকাতর হয়ে নানান কথা। স্মৃতি ছুঁয়ে যায় মনকে নিজের মত করে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভারতে কাটালেন। ভারত থেকে তবু তাকে বিচ্ছিন্ন করবে এমন সাধ্য কার। বলতেন সেলফোন ও কম্পিউটারের কথা, পৃথিবী এতে কতো ছোট হয়ে এলো। যার সাথে যখন খুশি কথা বলার সুযোগ, কোনো দূরত্ব থাকছে না দূরে থেকেও। কিছুর অভাব বোধ হবার হাত থেকে বেঁচে যাবার জন্যে কী এমন বললেন তিনি? জানতেন না কবে ভারত ফিরে যাবেন। আদৌ ফিরবেন কি না। তবে যেখানেই ছিলেন ভারত ছিল তার সঙ্গে এটা ভাবতেন। আজ তিনি নেই যখন, তখনো ভারত কি দূরে থেকেই কাছে আছে তাঁর?
১৭.৬.২০১১
দৈনিক ইত্তেফাক
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১১ রাত ২:২০