মতিঝিল-হিরাঝিল
০১
সেদিন গেলাম ক্যাফে ঝিলে ঢাকা শহরের অনেক ক্যাফেতেই চা, কফি খেয়েছি ক্যাফে ঝিলের চিত্র বিরল। মানুষ হুমড়ি খেয়ে আসে মনে হল, হরেক পেশার মানুষ। যেহেতু অভিজাত রেস্টুরেন্ট বড়লোক দের সংখ্যাই বেশি। আমার সাথে ছিল খোকন ও এসেছিল ট্রেনিং করতে। ন্যাশনাল ব্যাংকে ওর চাকুরী হয়েছে। খোকন আশ্চর্য হল একটা রিক্সাঅলা কে এক ফুল চিকেন গ্রিল অর্ডার দিতে দেখে। আমি মোটেও আশ্চর্য হইনি কারণ আমরা যদি কলেজে পড়া অবস্থায় ত্রিশ টকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে বার টাকা দামের চা খেতে মতিঝিল আসতে পারি। ঐ রিক্সাঅলা সারাদিন রোজগার করে কেন একশ আশি টাকা দামের গ্রিল খেতে পারবেনা। আমি খুশি হলাম একটি দৃশ্য দেখে যে, একটু পরে একটি খুব অল্প বয়স্ক সুন্দরী মেয়ে এসে বসল যখন বসে পড়ল বালিকাটি তখনও মোবাইলে কারো সাথে ফোনালাপ করছে। খোকন ভেবেছিল এটি অন্য কেউ একা এসেছে বলেই লুঙ্গি পরা রিক্সাঅলার সামনে একই টেবিলে হয়ত বসেছে। কিন্তু আশ্চর্য হতে ওর দেরি হলনা যখন দেখল কাঁটা চামচ ছুরি নিয়ে ওরা একসাথে খেতে শুরু করেছে। ও বলল মেয়েটি হয়তবা লোকটির মেয়ে সম্পর্কীয় নিকটাত্নীয়। সে শেষ বারের মত আশ্চর্য হল। যখন মেয়েটি অসংখ্য প্রেমালাপের ফাঁকে লোকটির কাছে কিছু টাকা চাইল।
টাকা কিন্তু সে ধার হিসেবে চেয়েছে বলা যায়না কারণ ও বলছে সামনে পরীক্ষা তাই টাকাটা দরকার।
আমরা বসেছি ওদের টেবিলের ঠিক পেছনে আমার চেয়ারের পিঠের অংশটি মেয়েটির চেয়ারের সাথে লাগানো। ওর মুখটা ঢুকতে যেই দেখেছি আর দেখিনি। আমি কিন্তু মনোযোগি শ্রোতার মত সব শুনে যাচ্ছি। খোকন আমার বিপরীত দিক থেকে মেয়েটির পিঠের অনাবৃত অংশ দেখে কিছুটা ইতস্তত।
বিশ্বাস কর আমি মেয়েটির কথা কিংবা আচরণ কোনটা দেখেই আশ্চর্য হইনি। কারন এমন দৃশ্য কল্পনায় আমি প্রতিনিয়ত দেখি। এবং মানুষ কে আমরা খোলা চোখে দেখি মানুষ যে প্রয়োজনে সব করতে পারে এমনটাও আমরা বিশ্বাস করি।
সেদিনের পর আর একবার লোকটিকে দেখলাম কমলাপুর রেল স্টেশানের কন্টেইনার ডিপোর পাশে অনেক গুলো লোকের সাথে ভলিবল খেলছে। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি একা বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছি। ইচ্ছে করেই অনেকক্ষন দেরি করলাম। ইচ্ছে লোকটার গল্প শোনা। ভাগ্য ভাল একা পেয়েও গেলাম। আমার ভাব দেখে সে নিজেই দাঁড়াল। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম চেনা মনে হয় কি? উত্তর দিল ক্যাফে ঝিলে দেখেছিলাম, বাকী জন কোথায় আমি বললাম রিয়াদ চলে গেছে লোকটি অবিশ্বাসের স্বরে বলল মাত্র ১০-১২ দিনে রিয়াদ যাওয়া যায়। এই প্রথমবার আমি আশ্চর্য হলাম রিয়াদ শব্দটা সে চিনেগেল বলে। ভ্রম হল ও রিক্সাঅলা?
গল্প শুরু করে দিলাম ভাই সেদিনের মেয়েটি কে?
ও আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো সেদিনের কথা শুনে কিছুই অনুভব করতে পারেন নি।
আসলে ধাঁধাঁ ময় মানুষ কে আমি ভয় এবং শ্রদ্ধা করি তাই কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক আগে থেকে বলার চেষ্টা করিনা। আপনি কি পত্রিকার লোক?
এই কথাটা শুনে আমি হাসলাম এবং নিশ্চিত হলাম লোকটা আসলেই রিক্সাঅলা তবে একটু তো আলাদা বটে। সে তার গল্প বলা শুরু করল আর,কে, মিশন রোড়ে মেয়েদের বাড়ি। ইডেন কলেজে পড়ে। পরীক্ষার নাম করে আমার কাছে টাকা চায় অথচ ওদের টাকার অভাব নেই। আমি ও যখন যা চায় দেই। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় আরো ৫ বছর আগে তখন সে স্কুলের ছাত্রী নিয়মিত রিক্সায় করে মা, মেয়ে কে স্কুলে নেয়া, বাসায় আনা আমার সাথে চুক্তি ছিল। মাস শেষে বেতন দিত। টানা তিন বছর পার্ট টাইম ওদের চাকুরি করেছি। ধীরে ধীরে ওদের বাসায় যাওয়া আসা শুরু করলাম কর্তা ও আমাকে বেশ আদর করত। প্রতিটি সকালে কর্তাকে নিয়ে বাজারে যাওয়া হত। আসা যাওয়ার পথে বেচারা তার স্ত্রীর নামে নানা বদনাম করত।
একদিন বাপ, বেটি ও কাজের মেয়েটা ওদের গ্রামের বাড়িতে গেল। সেদিন সকালে বাজার নিয়ে যখন বাসায় যাই দেখলাম ভদ্র মহিলা সিগারেট খাচ্ছে। আজকাল কিছু কিছু ,মেয়ে খায় তাই কিছু মনে করলাম না। মহিলা সন্ধায় আমাকে আসতে বলল। যথারীতি দিন শেষে আসলাম। ও আমাকে বলল আজ থেকে আমাকে ভাবী ডাকবে। নো খালাম্মা বুজলি। আসলে আমার বয়স ছত্রিশ। আমি উনাকে খালা কিংবা ভাবী যা ইচ্ছা ডাকতে পারি কিন্তু সুমি তো আমাকে ছোটকাল থেকেই আসলাম ভাই বলে ডাকে। আজ এতদিন পরে উনাকে ভাবী ডাকতে ইচ্ছে হলনা তবুও ডাকলাম। মহিলা একা তাই সে রাতে আমাকে বাসায় থাকতে বলল। নিরুপায় হয়ে রাজি হলাম। রাতে মহিলা নিজের ঘরে না থেকে আমার সাথে সোফার ঘরেই থাকল। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে গালাগাল করতে লাগল। শেষে এও সাবধান করে দিল আজই তুই গ্রামে চলে যাবি ঢাকা শহরে যাতে তোকে আর না দেখি। আমি একই মহিলার দিন ও রাত্রির ভিন্ন রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে। প্রাণ ভয়ে ঢাকা ছাড়লাম।
০২
বেশ কিছুদিন গ্রামে থাকার পর ক্ষুদার তাড়নায় আবার ঢাকায় আসি এখন থাকি হল মান্ডায়। হঠাৎ ইডেনের সামনে একদিন মেয়েটির সাথে দেখা হল।
আসলাম ভাই বাসায় চল আম্মু তোমাকে অনেক খুজেছে। কাউকে কিছু না বলে চলে গেলে কেন? তুমি কি দেশে গিয়ে বিয়ে করেছ আম্মু বলে মনে হয় বিয়ে করার জন্য তুমি বাড়ি গেছ হয়ত! তবে আমাদের দাওয়াত দাওনি যে। ওর একসাথে এত গুলো প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি শুধু বললাম বিয়ে করিনি। হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে বাড়ি গেছি এটাই।
-আসলাম ভাই আমাকে তোমার কেমন লাগে?
-বললাম ভাল, কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?
-তুমি বুজবেনা, ভাল লাগে কিনা সেটা বল।
-আমি আবার বললাম অবশ্যই ভাল লাগে।
-সেটাই আমাকে কার না ভাল লাগে! আচ্ছা চল বাসায় চল।
আমি কিন্তু আজ ওদের বাসায় যেতে পারিনি আমার মন বাধা দেয়। পরে ও আব্দার করল তাহলে চল ক্রিসেন্ট গার্ড়েনে।
সেদিন ই আমি প্রথম ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকলাম। এর পর থেকে কতদিন কত গার্ডেনে যাই। কত কিছু ওর আব্দার রাখি। আজ এটা কাল সেটা। একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুজতে পারিনা যে ওর মত মেয়ে আমাকে তুমি বলে ডাকবে কেন? আর ওকে আমার ভাল লাগে কিনা এ কথাটা বারবার করে জানতে চায় কেন? আমি আমার মতই চলি এবং বিশ্বাস করি ও আমাকে চিরকাল ভাললাগে কিনা এটাই জিজ্ঞাসা করে যাবে। ভালবাসি কিনা সেটা নয়। আর ওর মত একটা মেয়েকে আমার পক্ষে ভালবাসাই সম্ভব অন্য কিছু নয়। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই মা ও মেয়েতে কত তফাত।
আসল কথাটা জানলাম সেদিন, সে আমাকে নিয়ে গেল বলদা গার্ডেনে একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল এই ছেলেটিকে আমি অনেক ভালবাসতাম। জীবনে একটি ছেলেকেই আমি ভালবেসেছি সে আমার সাথে প্রতারণা করল। আজ শেষ বারের মত ওর সামনে আমরা ভালবাসার অভিনয় করব। এবং কাল থেকে তোমাকে আঙ্কেল বলে ডাকব।
এতক্ষনে আমি বুজলাম আমি আর খোকন যেদিন ওদের কে ক্যাফে ঝিলে দেখেছিলাম, সেদিন ও ওরা অভিনয় করেছিল পাশে বসা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে। ইদানিং মেয়েটা নাকি মোবাইল ফোন ব্যাবহার করেনা ওর আঙ্কেল বলে দিয়েছে সে আর অভিনয় করতে পারবেনা।
আজিজুল হক
১১০/১, দক্ষিণ কমলাপুর
মতিঝিল, ঢাকা
ই-মেইল: [email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




